
বাংলা সিনেমার জাদুকর মৃণাল সেন আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে, স্তব্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছেন অল্প কিছুদিন হল। আমাদের সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হাতে নিয়ে আলোকবর্তিকা এগিয়ে এসেছেন আরেক মৃণাল, স্যার মৃণাল হক।
তাঁর কিছু অসম্ভব সম্ভাবনাময় কাজ নিয়ে এক শ্রেণীর দুষ্ট পোলাপান ইদানীং না বুঝে স্যাটায়ার করলেও প্রকৃত শিল্পবোদ্ধারা এহেন বেয়াদবিতে বেশ নাখোশ। এই দুই শ্রেণীর মানুষকেই সন্মান জানিয়ে আজ বলতে চাই, মৃণাল হকের ভাস্কর্যের মর্ম এবং শিল্পজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম বা অনুভবের জন্য নূন্যতম বোধ-জ্ঞান এই সময়ের দুষ্ট ছেলেপেলের হয়নাই। আমরা তো ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসোই বুঝি না, মৃণাল হক কিভাবে বুঝবো? একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় গুন হল সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখে তিনি ভিন্নভাবে বা সেই বিষয়ের অদেখা একটা বিষয়কেই শিল্পের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলেন। এই যেমন শিল্প বিষয়ে চায়ের আড্ডায় এক বড়ভাই সেদিন বললেন,
– বুঝলে, রবীন্দ্রনাথের কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল, অনেকেই সেটা জানতো না, যারা জানতো তারাও মানুষের ভয়ে সেটা নিয়ে মুখ খোলেনি।
– কী বলেন ভাই, কি সমস্যা ছিল?
– আরে বোকা কবিগুরুর গলা বা ঘাড় বলতে কিছু ছিল না। ধড়ের উপর জাস্ট খালি মাথাটা বসানো ছিল, সৃস্টিকর্তার লীলা বুঝছো? তাঁকে এতকিছু দিয়েছেন খালি গলাটা দেননাই। কিন্তু তাঁর কাঁধ হিল বিশাল চওড়া, শরীরের অর্ধেক।
– ধূর ভাই, এইসব কি কন?
– আরে বোকা, এই জন্যই তিনি সারাজীবন লম্বা লম্বা চুল দাঁড়ি রেখে গলা-ঘাড় ঢেকে রাখতেন। তুমি কখনো দেখছো তাঁরে খালি গায়ে চুল দাঁড়ি ছাড়া?
অনেকক্ষণ ভাবলাম, দেখেছি কি? তারপরেও ভয়ে ভয়ে ভাইরে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন? ইয়ে, মানে বলছিলাম কি কোন রেফারেন্স আছে এই ব্যাপারে?
ভাই রেগে গেলেন, মুহুর্তেই মৃণাল স্যারের বানানো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিখ্যাত ভাস্কর্যটি খুলে দেখালেন,
– এই দ্যাখ বেটা, তুই কি মৃণাল হকের চাইতে বেশি বুঝোস?
অতিকায় অতিমানব বিশ্বকবি
যাই হোক, নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত আমি সেদিনের পর থেকে মৃণাল স্যার আর তাঁর শিল্পকর্মের প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসা অনুভব করা শুরু করেছি, নতুন করে দেখছি এই মহান শিল্পীকে। মাদাম তুসোর মোমের জাদুঘরের আদলে তাঁর বানানো মোমকৃতি দেখতে দেখতে গর্বে অহংকারে আমার বুক পেট দুইটাই দশহাত ফুলে উটেছে। উচ্চমানের শিল্প মানেই বিমূর্ত একটা ব্যাপার, এই মনে হবে বুঝেছেন আবার মনে হবে, না। এইজন্যই পিকাসোর আঁকাবুকা দেখে বুজে না বুঝেও মাথা নাড়ান। যারা স্যারকে বুঝতে পারেননাই তাদেরকে বলছি, এখানে ব্যাপারটা ঠিক তাই। সারা পৃথিবী বানাক না মাদাম তুসো, সবাই তো আর মৃণাল হক না।
এই যেমন তিনি শাহরুখ খানের আদলে হিরো আলমকে বানাইছেন, আপনারা কি কখনো এর মাহাত্ম্য ভেবে দেখেছেন? এটা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদি তথাকথিত আপার ক্লাসের শিল্পবোদ্ধাদের মুখে একধরণের চপোটাঘাত। তিনি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খান ভিনদেশি অভিজাত ক্লাসের প্রতিনিধি হতেই পারেন, হিরো আলম ফেলনা নয়। গতবছর হিরো আলমকে গুগলে শাহরুখ খানের চাইতেও বেশি খোঁজা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি এখানে দুই প্রতিবেশী দেশের মেলবন্ধনের একটা ইঙ্গিতও কিন্তু চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
শাহ্ আলমরুখ খান, মেসিনানন্দ দাস
আবার মেসি বিশ্বমাতানো ফুটবলার, তিনি ফুটবলের কবি, তাঁর পায়ে আছে কবিতার ছন্দ। তাই আমাদের প্রাণের কবি জীবনানন্দ দাসের চেহারার আদলে তিনি মেসিকে গড়েছেন। সেইসাথে আর্জেন্টিনার টি শার্টের সাথে তাঁকে স্বদেশী আরামবাগ ক্রীড়া চক্রের প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছেন। বাহ মৃণাল বাহ !
তিনি বাংলা মুভির ভীষণ ভক্ত, তাইতো জেলখানার দৃশ্যে অসহায় ওমর সানীকে বানিয়েছেন তাঁর প্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসানের মত করে।আবার অনেকে বলেন একইসাথে তিনি প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বিপ্লব এবং প্রিয় খেলোয়াড় শোয়েব আখতারের ছোঁয়াও রেখেছেন। নিন্দুকেরা বুঝতে না পেরে এই মহান কর্ম কাজী নজরুল বলে গুলিয়ে ফেলেছে যদিও। এমনকি আপনি যদি নবাব আনোয়ার হোসেন কিংবা ‘নয়নের আলো’ সিনেমার জাফর ইকবাল’কে খুঁজে পান দোষ দেয়া যাবে না।
জেলখানায় বন্দি শিল্পী, শমী ব্ল্যাক উইডো
অসম্ভব দেশপ্রেমিক এই শিল্পীর কাজগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন, আবেগে কেঁদে ফেলবেন। তিনি আমাদের শমী কায়সারের ম্যুরাল বানিয়েছেন, কিন্তু কমিক লাভাররা ঠিক মারভেলের ব্ল্যাক উইডো খুঁজে পাবেন। অনেকে মাধুরী দীক্ষিত, জেনিফার লোপেজ এমনকি কেউ কেউ শাকিরাকেও নাকি দেখেছেন।
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ম্যুরাল দিয়ে শেষ করবো। এই অতি চমৎকার ম্যুরালটি আবহমান বাংলার বাউল গানকে রিপ্রেজেন্ট করে, আপনি এক দেখাতেই আমাদের কুদ্দুস বয়াতিকে খুঁজে পাবেন। ভালো করে খুঁজলে আর্কের হাসানকেও পাবেন। আর যদি আপনি অনেক বেশি কল্পনাবিলাসী হোন তাহলে, শুধু তাহলেই অনেক মনযোগ দিয়ে দেখলে আরেকজন লেজেন্ডকে অনুভব করতে পারবেন। আর তিনি হলেন অমর শিল্পী বব মার্লে।
কুদ্দুছ বয়াতি
এছাড়া তিনি বাঙ্গালির চিন্তায় ক্রন্দনরত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বানিয়েছেন, দিলারা জামানকে প্রধানমন্ত্রীর বেশে জাতিসংঘ অধিবেশনে পাঠিয়েছেন। টেলি সামাদের আদলে মিঃ বিন কিংবা হৃত্বিক রোশনের আদলে চে গুয়েভারা এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে, বলে শেষ করা যাবে না। শুধু এটুকু বলবো, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যদি মৃণাল সাহেবের মত ভালোসব কাজ করে শেষবয়সে এসে এই ধরণের ছড়া লিখতেন তাও এতোটা জনপ্রিয় হতে পারতেন না।
“আয় সখি খেলি, আমি-তুই জলকেলি
তোর নাম বেলি, আমি খাই জেলি।“
তারপরেও আপনারা স্যার মৃণাল হকের আর কোন অবদান অস্বীকার করবেন? বলুন চৌধুরী সাহেব, জবাব দিন।
পাদটীকাঃ এই এতোসব বলছি মনে একটা সুপ্ত বাসনা নিয়ে। স্বপ্ন দেখি স্যার একদিন আমার এই লেখা দেখে খুশি হয়ে আমারো একটা ম্যুরাল বানিয়ে দেবেন। দেখতে আমার মতই হবে কিন্তু সেখানে খুব সহজেই ‘ব্লাড ডায়মন্ড’এর লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এবং ওয়েস্টার্ন সিনেমা ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড এন্ড দ্য আগলি’র অল্পবয়সি ক্লিন্ট ইস্টউডকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
(আপনাদের শিল্পী মনের বিকাশে মৃণাল হকের অসম্ভব কিছু শিল্পকর্মের ছবি এখানে দেয়া হল। অনিবার্য কারণবশত বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী’র শিল্পকর্মের ছবি এখানে দেয়া হয় নি। আগ্রহী বোদ্ধারা অনলাইনে কিংবা মৃণাল হকের ফেসবুকে খুঁজে দেখতে পারেন। ধন্যবাদ)