ইউ আর আ হিরো, ইউ আর এ লিজেন্ড রাজ্জাক ভাই -আব্দুল্লাহ আল নোমান শামীম

  
    

রাজ্জাক ভাই, এক কথায় সিডনির সবাই চেনেন, জানেন। উনার সাথে আমার পরিচয় সিডনিতে পড়তে আসার গোড়ার দিকে, একদম প্রথম দিকেই। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর নেহাল ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে। তখন আমি কেবল স্টুডেন্ট, নেহাল ভাইয়ের সাথে কাজ করি একুশে একাডেমীতে আর বঙ্গবন্ধু পরিষদে, যে যা বলে তাই করি। রাজ্জাক ভাই একদিন মাসকটের কাওয়ার্ড স্ট্রীটের হলে জাতীয় শোক দিবসের প্রোগ্রামে আমাকে এদিক ওদিকে দৌড়াতে দেখে ডাকলেন, বললেন, নেহাল ভালো ছেলে। আমি নেহাল ভাইয়ের সাথে আঠার মতো আরো লেগে গেলাম।

সাহসী মানুষ দেখেছি, সিডনিতে রাজ্জাক ভাইয়ের মতো গাটসি মানুষ আজো দেখি নাই। স্বপ্নবাজ মানুষ দেখেছি বেশ কয়েকজন, কিন্তু অনেকের জন্য যা অসম্ভব, তা হাতের আয়েশ আঙ্গুলে একদম সহজ সিদ্ধান্তে করে দেখিয়েছেন রাজ্জাক ভাই। অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি হবে, আমার বাসায় বিরাট মিটিং, রথী-মহারথীরা ভিড় করে আছে আমাদের লাউঞ্জে, কে নেই? কিন্তু দ্বায়িত্ব নিবে কে, বিড়ালের গলায় ঘন্টা লাগাবে কে? মুরব্বী একজন শেষ মুহুর্তে উলটো টান দিলেন, মিটিং ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থা ! সারা সিডনি থেকে ফোন আসছে, আমি এসএমএসে আপডেট দিচ্ছি। হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন রাজ্জাক ভাই, বললেন, এসব আমার কাছে কোনো ব্যাপারই না, তোমরা যদি ভয় পাও, আমি দায়িত্ব নিবো, আমাকে একজন ভালো সেক্রেটারী দাও।

ঝামেলায় পড়লে বা পরামর্শ নিতে গেলে, প্রতিপক্ষ্যকে এমনভাবে শব্দচয়নে বাঁধতেন, আমার মনে হতো, আরেদ্ধুস, ব্যাপারই না! এই যে নিজের ভেতরকার সাহস তিনি অবলীলায় কর্মীদের মধ্যে সঞ্চার করতেন, সিডনির খুব বেশী মানুষ নেই যিনি করতে পারেন। কি অসম্ভব তেজী ছিলেন! তাঁর বাসায় অনেক মিটিংয়ে গেছি, বন্ধুর মতো সব খুলে দিয়েছেন, ফ্রিজ, ভাত, তরকারী, অন্যান্য সব, যেন স্কুলের বন্ধু, আরে নাও, কি হবে! তোমরা ইয়াং মানুষ! আমার এতো ভালো লাগতো! প্রবাসে এসে খুব অল্প কিছু সৎ মানুষ, মেধা-মননে-কাজে, যা বলে সেটাতে বিশ্বাস করা ও সেখানে স্থির থাকা, আপনি রাজ্জাক ভাই। নেতাতো রাজ্জাক ভাই, যার কথায় শতভাগ আস্থা রাখা যায়, যিনি যা বলবেন সেটা থেকে নড়বেন না, সেটা করে দেখাবেন, আমরাতো এই রকম মানুষকেই শ্রদ্ধা করি, নেতা মানি। সিডনিতে নেতা কই, বেশীরভাগই পদের জন্য আছে। মিটিংএ তর্ক হলেই ব্যক্তিগতভাবে নেয়া, রাজ্জাক ভাই নিতেন না, তিনি লড়াই করতেন, বোঝাতেন বা শুনতেন। আমরাতো এখানে কোনো ব্যক্তির রাজনীতি করি না, আমরাতো বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার রাজনীতি করি। রাজ্জাক ভাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধু উনাকে এমপি ইকেলশন করতে বলেছিলেন, উনি দলবাজী পছন্দ করেন না বলে শিক্ষকতার কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। সেই রাজ্জাক ভাই, মিটিং-এ আসার আগে আমাকে বা আলোক ভাইকে ফোন দিতেন, আচ্ছা, তুমি একটা কাজ করতে পারো? আচ্ছা বলতো, ঐযে টিটোর দোকান কখন বন্ধ হবে? আমি বলতাম কেনো রাজ্জাক ভাই? উনি বলতেন, কয়েকটা পান-পরাগ নিয়ে রেখো।

অনেক কিছু মাখিয়ে একটা দারুন সুগন্ধিযুক্ত পান মশলা বানাতেন, আমরা হাত পেতে নিতাম। উনি মুখের কোনায় এক চিলতে হাসি ধরে রেখে প্রসাদ বিলাতেন। কতদিন গেছে উনাকে বাসা থেকে নিয়ে এসেছি মিটিংয়ে, যাওয়ার আগে ফোন দিতাম, লিডার আসছি। উনি এক্সাক্টলি ঘড়ি ধরে সুন্দর জামা পড়ে অপেক্ষা করতেন, আমার দেরী হলে বলতেন, তুমি লেট করেছো। আমি উত্তর দিতাম, ট্রাফিক, বাসা ইত্যাদি। অনেক লম্বা পথ, কথা বলতে পছন্দ করতেন, অনর্গল। সিডনির রাজনীতি আর ঢাকার সুশীল সমাজের রাজনীতি উনার নখদর্পনে, অনর্গল বলতেন। কথা বলতে বলতে মিটিং-এ নিয়ে আসতাম, মিটিং শেষ করে বাসায় দিয়ে আসতাম। বলতেন আমার স্ত্রী সাথীর কথা, বাচ্চারা কেমন আছে? ওদের সাথে দেখা হলে দুষ্টুমি করতেন, কত স্মৃতি রাজ্জাক ভাই। আমি উনাকে এতো দূর থেকে নিয়ে আসতাম, উনি মনে হয় কিছুটা লজ্জা পেতেন, সারা জীবন যে মানূষ কারো কাছে হাত পাতেননি, সেই মানুষকে একজন জুনিয়র এতোদুর থেকে নিয়ে আসছে, বাসায় দিয়ে যাচ্ছে! আমার কিন্তু কিছু কষ্ট হতো না রাজ্জাক ভাই, আমার বেশ লাগতো, এটাতো আপনার প্রাপ্য। অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের মিটিং হলে উনাকে নিয়ে আসার জন্য মিল্টন ভাই আমাকে বলতেন, আমি মিল্টন ভাইকে বলতাম, কোনো সমস্যা নাই, নিয়ে আসছি, উনার দায়িত্ব আমার। আপনার হাতটা শেষ দিকে খুব নরম আর ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছিলো, সেই হাত যখন ধরতাম, ভাবতাম, এই হাতেই সিডনির কালো শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, জিতেছেন আর এক মেলা দিয়েই বাংলাদেশ কম্যুনিটিকে ভারতীয়, পাকিস্তানী আর শ্রীলংকান কম্যুনিটির বস বানিয়ে দিয়েছেন। অলিম্পিক পার্কের প্রথম মেলার ভাড়া মেলা ছিলো, তখন সেটা কোনো বাঙ্গালীর পক্ষ্যে দেয়াটা স্বাভাবিকভাবে চিন্তারও বাইরে ছিলো, আপনি আর শেখ শামীম ভাই ছাড়া তেমন কেউই পারছিলো না কন্ট্রিবিউট করতে, চ্যালেঞ্জটা আপনি নিলেন, এক ক্রেডিট কার্ড থেকেই বিশাল রিস্ক নিলেন, মেলা দাঁড়িয়ে গেলো, আপনি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। লিডার, সিডনির বাঙ্গালী মনে করে, আপনার শরীর থেকে কলিজার সাইজটা বড়ো ছিলো।

কত স্মৃতি আর গল্প আপনাকে নিয়ে, সিডনির মিথে পরিনত হয়েছিলেন, সব যায়গায় আছেন, কিন্তু কোথায়ও তেমন যান না। সরাসরি সত্য বলেছেন যার তাঁর মুখের উপরে। রেগে যেতেন বাংলাদেশ, বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ বিন্দুমাত্র কিছু বললে, ঢাকতেন না রাগ, এতো চমৎকার করে শক্ত কথা বলতেন। আর কি কেউ বলবে, এই মঞ্চে নাটক হবে, সিডনি নাটক দেখলো। আর কি কেউ বলবে, এই মঞ্চে নাচ হবে, নাচও হলো? উজ্জ্বল ভাই, আপনি, গামা ভাই, শেখ শামীম ভাই, কতকিছুই না করেছেন বাংলাদেশকে ভালোবেসে। রাজ্জাক ভাই সত্যিকার নেতাদের মতো ওউন করতেন নিজের মানুষদেরকে, আমাকেও। আপনার নিজের মানুষরা কতটা প্রশ্রয় পেতো তা একদম নিজের চোখে দেখা, যেন একজন মহীরুহ। আপনার এই শুন্যতা কি পূরণ হবে? কেউ কি আর নির্ভরতার ঠিকানা হয়ে উঠতে পারবে আমাদের কাছে?

রিভারস্টোন সেমিট্রির শেষ ঠিকানায় ড. রাজ্জাক, ছবি: ফাহাদ আসমার

শেষ বিদায়ে আমি ছিলাম আপনার সাথে, আমার দুই ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম রাজ্জাক ভাই আজ, চোখের জলে ভিজে যাচ্ছি।
হাসপাতালে আপনার সাদা কাপড়ে মোড়া নিষ্প্রাণ দেহের দিকে তাকাই নি, তাকিয়ে ছিলাম আপনার সেই ক্ষুরধার চোখের দিকে, নিঃস্পাপ চেহারায় প্রায় নির্মিলিত চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজেছে লিডার, কিন্তু আপনি সাড়া দেননি। আপনাকে সারা জীবন মনে রাখবো একজন পিতার মতো, বড় ভাই হিসেবে, বাংলাদেশের একজন অকৃত্তিম বন্ধু হিসেবে, আওয়ামী লীগের সাহসী কান্ডারী হিসেবে। ইউ আর আ হিরো, ইউ আর এ লিজেন্ড।

আপনার শেষ শরীরটা এতো হালকা লেগেছে, আমাদের একদম কষ্ট হয়নি রাজ্জাক ভাই আপনার শেষ সময়েও আপনি কাউকে কষ্ট দেননি, আপনার অনেক অগ্রজই আপনার শেষ সময়ে শেষ যাত্রায় একসাথে ছিলো। দেখা হবে প্রিয় রাজ্জাক ভাই, অন্য কোনো ভুবনে। আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুন, আপনার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে বেহেশত দরখাস্ত করছি।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

আব্দুল্লাহ আল নোমান শামীম
সম্পাদক, মাসিক মুক্তমঞ্চ
সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments