ইসমত শিল্পীর ‘বিকল্প ক্ষত’- আগামী বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি -আহমেদ শরীফ শুভ

  
    

কবি ইসমত শিল্পীর সাম্প্রতিক কবিতাগ্রন্থ ‘বিকল্প ক্ষত’ হাতে পেয়েছিলাম কবির বদান্যতায়। পড়তে গিয়ে মুগ্ধ হলাম। বিষয়বস্তু, ছন্দ, আধুনিকতা, কবিতার গাঁথুনি এবং পাঠের সাবলিলতায় এক কথায় অনবদ্য একটি কবিতাগ্রন্থ। তাঁর কবিতার সাথে অল্প পরিচয় ছিল আগেই। কিন্তু ‘বিকল্প ক্ষত’ পড়তে গিয়ে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। এই কবিতাগ্রন্থে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন একজন আপাদমস্তুক প্রেমের কবি হিসেবে। শুধু আত্মপ্রকাশই নয়, প্রেমের কবিতায় তিনি তাঁর শক্তিমত্তাও দেখিয়েছেন যথেষ্ঠ। তাই বলে কবির কবিতা শুধু প্রেমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উঠে এসেছে দেশ, সমাজ, যাপিত জীবন, জীবনের টানাপোড়েন এবং সমকালের চালচিত্র। যদিও এগুলো ‘বিকল্প ক্ষত’র মূল সুর নয়; এসেছে অনুষঙ্গ হিসেবে।

ইসমত শিল্পীর কবিতায় যা সবার সবচেয়ে ভালোলাগবে তা হচ্ছে তাঁর ছন্দ। কবিতা পড়ার সময় তিনটি বৈশিষ্ট্যে আমি প্রাধান্য দেইঃ ১। শ্রুতিগ্রাহ্যতা, ২। আধুনিকতা এবং ৩। পাঠের সাবলিলতা, অর্থাৎ কোথাও হোঁচট না খাওয়া। এই তিনের সমন্বয়ে ‘বিকল্প ক্ষত’র কবিতাগুলো সত্যিকারের পছন্দের কবিতা হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ কবিতাই চমৎকার আবৃত্তিযোগ্য। তিনি খুব সহজেই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, চিত্রকল্প আর রূপকে পাঠকে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। ‘বিকল্প ক্ষত’র কবিতাগুলো সহজবোধ্যতাকে বিসর্জন না দিয়েই আধুনিক হয়ে উঠেছে আবার পাঠে সাবলিল হয়েই আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করেছে। এই সক্ষমতাই ইসমত শিল্পীকে পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।

চার ফর্মার এই বইটিতে উদ্ধৃতিযোগ্য কবিতা কিংবা পংক্তির অভাব নেই। তবু কিছু কিছু সহভাগ করার লোভ সামলাতে পারছি না।
তিনি  হয়তো ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেননি বেশি। কিন্তু সনাতন ধারায় পারদর্শিতা দেখালে পাঠক তাঁকে ছন্দ নিয়ে অন্য কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার পরীক্ষায় দেখতে চাইবেন বলে মনে হয় না।

‘ওপারের কার্নিসে
পড়ন্ত সুখ
শালিকের মুখ
জলে ধোয়া বুক
ছুড়ে দেয়া শব্দের অহেতুক সুখ
বুনেছিলে?
বোনোনি তো- ফসলের রূপ
এপাশের বইগুলো বরাবরই চুপ
জ্বেলেছিলে? জ্বালোনি তো দীপ
উঠোনের এক পাশে ক্ষয়ে যাওয়া ধূপ’
(ইতিকথা)

কিংবা

‘তোমার চোখে ঝরতে থাকা রাগ
রাতের ফাঁদে আটকে থাকা চাঁদ
ধুলোর মাঝে আটকে থাকে ভাষা
আমার অধির বধির ভালোবাসা
……………
আকাশ সমান আমার যত বলা
গড়িয়ে পড়ে অঢেল অবহেলা’
(অভিমান)
এই কবিতায় শুধু ছন্দের মাধুর্যই দ্রষ্টব্য নয়, অভিমান চিত্রায়িত করেছেন চমৎকার রূপক আর উপমায়।

অথবা

‘কেন যে তুই মোমের মতো অহরহ পোড়াস তোকে
রাতের বেলায় জোৎস্না ঢালিস অমাবস্যার ঘোর বিপাকে
কেন যে তুই গুমরে উঠিস মাঝে মাঝে
অমল ধবল সুখের ত্রাসে, ভুল অসুখে
কেন যে তুই পোড়াস তোকে
কেন রে তুই পালিয়ে বেড়াস ঝিমিয়ে পড়া নদীর স্রোতে
শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা এলে- কেন যে তুই হারিয়ে যাস
বারে বারে!’
(মাটি ও মোমের গল্প)

এবং

‘আসবে আসবে করে বসে থাকে ঠাঁই
জল ধোয়া পাখনায় একাকী চড়াই।
………………….
ক্ষতগুলো ঢেকে নেয় সরব সকাল
মনোহারি রোদ আর অচেনা মরাল’
(নিষাদ)

এখানেও ছন্দের কারুকাজের পাশাপাশি চিত্রকল্প বিনির্মাণেও কবি তাঁর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তবে চড়াই কি ‘ঠাঁই’ বসে থাকে, নাকি ‘ঠায়’ বসে থাকে এই নিয়ে কোন কোন পাঠকের প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু তাতে কবির ভাবাবেগ বুঝতে বা চিত্রকল্পটি বিশ্লেষন করতে কোন অসুবিধা হয় না।

শতধারে উৎসারিত প্রেম বিন্যস্ত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন কবিতার অবয়বে। যেমনঃ

‘নীল
সাধ ছিল- তোমাকে দেখার অপেক্ষা জাগা ভোরে
হলো না। না হোক
ভালো থেকো নীল টিপ, রাঙা হাসি ঠোঁট
ভালো থেকে প্রিয় চোখ; নীলের পীযুষ
ভালো থেকো পরিচিত দূরদেশ’ কাঁটার ছোবল।
ভালোবাসা ছোবলে মরে না তত
অবহেলায় মরে।
(ভালো থেকো দূরদেশ)

শেষ দুই লাইনে তিনি ভালোবাসার মৃত্যু নিয়ে যে দর্শন উপস্থাপন করেছেন তা পাঠককে নতুন করে নাড়িয়ে দেবে।

কিংবা

‘হাতের ভেতর উপচে পড়া আগুন দুপুর
তোর জন্যে রাখা আছে
চোখের ভেতর শেষ বিকেলের
চিলেকোঠার গল্পগুলো বাঁধা আছে
তুই কি নিবি?
………………………

শেষ বিকেলে ফুরিয়ে যাওয়া রোদের পুকুর
আমের পাতায় আছড়ে পড়া শুদ্ধ মুকূল
চিলে কোঠার চুরি হওয়া শব্দ নূপুর
বন্ধ দুপুর খুব যতনে বাঁধা আছে
তুই কি নিবি?

তোর কপালের গোপন ভাঁজের নোনা পানি
মুঠোর ভেতর আঁকছে ছবি সমুদ্দুরের
তুই কি যাবি?
(তোর জন্যে)

অসামান্য চিত্রকল্পে আঁকা এই কবিতা খুব সহজেই পাঠককে নিয়ে যায় কৈশোরের শেষ রাতে, যৌবনের প্রথম ভোরে, প্রেমের চপলতায়। তবে ‘মুকূল’ (মুকুল) বানানে মুদ্রন প্রমাদ লক্ষনীয়।

এবং

‘শুকনো কথায় জীবন যখন চলছিল না
সময়গুলো উচ্ছলতায় জ্বলছিল না
মনের ভেতর মিইয়ে থাকা গল্পগুলো
পথ হারিয়ে খালে বিলে ডুবছিল সব
রং-বেরঙের লাল সবুজের প্রহরগুলো
তখন থেকে আমিই তোমায় চিনিয়েছিলাম ভালোবাসা
ভুলে গেলে?
……………………

মুঠো ভরা উপচে পড়া হলুদ বিকেল
এক দুপুরে হঠাৎ কেমন ঢেলে দিলেম- শুকনো হাতের তালুর’পরে
ক্যালেন্ডারে ভাসতে থাকা সন্ধ্যে দুপুর
সুখের রোদে ভাসিয়ে দিয়ে চলে এলেম ফিরতি পথে
আলতোভাবে বলে এলেম ভালোবাসি!’
(ভালোবাসার কবিতা)

অথবা

‘জানো তো?
ভালোবাসার প্রথম কথা আসতে পারা, রাখতে পারা।
আমার ছবি তোমার কাছে না থাকলেও তোমার ছবি
খুব যত্নে দেয়াল জুড়ে রাখতে পারা।
ভালোবাসার প্রথম কথা বুঝতে পারা, শুনতে পাওয়া।
(ছবি)

ভালোবাসার এর চেয়ে সহজ সংজ্ঞা বোধ করি আর হয় না। তবে মনে হয়েছে এখানে প্রেমিকের ছবি নয়, ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করাই কবিতার মূল উপজীব্য। তাই কবিতার নামটি আরেকটু বিষয়ানুগ হলে ভালো লাগত।

আবার তিনি প্রেমের জন্য উন্মুখ হয়ে লিখেছেনঃ

‘আরেকটু এগোলেই বেহেশতি ফুলগুলো নত হতো
আজন্ম কুমকুম মেখে দিত নীল গন্ধমের গায়ে
ভেতরে চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভিজতো নদী,
গলতো পাথর।।
এগোলে না কেন???’
(আসক্ত)

প্রেমের এই তীব্র আসক্তির মাঝেও কবি কোথাও আবার দ্বিধার বীজ বপন করেছেন কিংবা উপলব্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেনঃ

‘এতদিন পরে-
আজ মনে হচ্ছে,
তোমাকে এতটা ভালোবাসা যায় না।
‘ভালোবাসা’কে ভালোবাসি বলেই তোমাকে
ভালোবাসা’।

পড়ে কারো কারো মনে হতে পারে, ‘তাইতো! এ যে আমারই কথা।‘

‘রক্তবৃষ্টি’ ও ‘কষ্টগুলো উড়ন্ত সব ডাহুক পাখি’ কবিতা দু’টি রূপক ব্যবহারের কবির পারদর্শিতার নিদর্শন। তবে ‘রক্তবৃষ্টি’ কবিতায় ‘পেন্সিল স্কেস্‌’ না হয়ে ‘পেন্সিল স্কেচ’ হলে যথার্থ হতো।

শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে লেখা ‘প্রিয়তম দেশ’ কবিতাটি গ্রন্থকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তবে কবিতার নামটি আরেকটু মানানসই হতে পারতো।

কয়েকটি কবিতা গদ্য ঢংয়ে লেখা। সেগুলোতে অন্যান্য অনুষঙ্গের সাথে উঠে এসেছে নদীর কান্না, সমাজ সচেতনতা, সমকালের চালচিত্র। তবে গদ্য ঢংয়ে লেখা হলেও তার অনেকাংশ জুড়েই প্রচ্ছন্ন ছন্দের মাতামাতি। ছন্দকে গদ্যের শরীরে ঢুকিয়েছেন চমৎকার পারদর্শিতায়। ‘আক্ষেপ’ এবং ‘নিষ্পত্তি’ তেমন দু’টি কবিতা। ‘নিষ্পত্তি’তে আবার উজাড় করে দিয়েছেন প্রেম। শুধু উজাড় করা প্রেমই নয় জীবনের অমোঘ উপলব্ধিও বটেঃ

‘প্রশ্নকে বিদ্ধ করতে নেই অন্য প্রশ্নে। কেবলমাত্র উত্তরেই তার ক্ষয়; নিষ্পত্তি।
আমার কাছে সবচেয়ে বড় উত্তর- তুমি। সব থেকে বড় গল্পও- তুমি’।

তাঁর গদ্য ঢংয়ে লেখা কবিতায় ছন্দের চমৎকার প্রচ্ছন্নতা দেখি, মুগ্ধকর চিত্রকল্প দেখি যখন পড়িঃ

‘ইতিহাস মনে রাখে সমস্ত কিছু, তোমরা ভুলে যেতে পারো। ভুলে যেতে পারো,
বৃষ্টির ফোঁটা মাড়িয়ে এক উঠোন জলের আগুনে পুড়ে মা হয়েছিলো একটি
দুপুর । ……’
(প থেকে পথ)।

কবি শুধু প্রেমেই মোহাচ্ছন্ন নন, বিপ্লবেও সঙ্গী হতে চান। যেমনটা বলেছেন;

‘উঠোনে বাতাসে বজ্রপাতের সাথে
বিপ্লব জেগেছে, বিপ্লব হচ্ছে হবে
অতীত এখনো জ্বলছে কন্ঠে চোখে
আগামী সকালে শত পোষ্টার হাতে
নাভীর গভীরে নাড়িতে জমছে কচ্ছপ
বিপ্লব মরেনি, ঘামের ভেতর বিপ্লব।
মাথাটা নোয়ালে কেনো কমরেড?
রাইফেল তাক করা আছে- থাকুক।‘
(মাথাটা নোয়ালে কেন করমরেড?)

তাঁর ‘হারানো হাতঘড়ি’ আর ‘দ্বন্দ্ব’ কবিতায় দেখি প্রকৃতিপ্রেম, যাপিত জীবন আর জীবনের টানাপোড়েনের গল্প। এ সবের জন্যই মূলতঃ প্রেমের কবিতাগ্রন্থ হয়েও ‘বিকল্প ক্ষত’ বহুমাত্রিকতার দাবিদার।

যদিও ছন্দ ইসমত শিল্পীর শক্তিমত্তার পরিচায়ক, তবুও কোথাও কোথাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পাঠক ছন্দপতনের সন্ধান পেতে পারেন। ‘পারিজাত’ ও ‘জলের শব্দ’ কবিতা দু’টোতে তেমন দু’ একটি ছন্দপতন খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে তা বাকি বিনির্মানের কাছে নিতান্তই চাঁদের কলঙ্ক মনে হবে।

কিছু কিছু মুদ্রণ প্রমাদের কথা আগেও বলেছি। তার বাইরেও বেশ কিছু ভ্রান্তি কিংবা মুদ্রণ প্রমাদ পাঠকের চোখে পড়বে। ‘পুরোনো হাতঘড়ি কবিতায়’ পুরোরো (পুরোনো), ‘যে রাতে ঘুম এলো না’তে এক্সাস্ট (এক্সস্ট), ‘নিষাদ’ কবিতায়’ ক্ষডুক (ক্ষণিক), ‘কষ্টগুলো সব ডাহুক পাখি’তে মুসড়ে পড়ে (মুষড়ে পড়ে) এমন কিছু ভুল দৃষ্টির সীমায় এসে পড়বে সহজেই। পরবর্তী সংস্করণে শুধরে যাবে সে প্রত্যাশা রইলো।

ইসমত শিল্পীর ‘বিকল্প ক্ষত’ আধুনিক কবিতাকে পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে যাবার এবং পাঠককে আধুনিক কবিতার পরিসীমায় টেনে আনার প্রতিশ্রুতিতে ভাস্বর। সেই প্রতিশ্রুতি আগামী বিনির্মানের। কবির পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ পাঠের প্রতীক্ষায় রইলাম।

সব্যসাচী হাজরার আঁকা চমৎকার প্রচ্ছদে মানসম্মত অঙ্গসজ্জার ‘বিকল্প ক্ষত’ প্রকাশ করেছে ‘শুদ্ধপ্রকাশ’। উদ্ধৃত মূল্য ১৬০ টাকা। গ্রন্থটির বহুলপাঠ ও বহুল প্রচার কামনা করি।

আহমেদ শরীফ শুভ
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক।
প্রকাশিত গ্রন্থ: মৃত্যুবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী খেলা, বিহঙ্গ উড়িয়ে দাও, স্বপ্নে দেখি তোমার মুখ, রাজকন্যার আহ্নিক, তৃষ্ণা ও জলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাবনা।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments