অয়নের আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বাড়িতে বকাবকি, স্যারদের চাঁনপুরী জোড়া-বেত হালের বলদের মতো তাড়ায়। স্কুল প্রায় চার পাঁচ মাইল হাঁটাপথ। অয়ন হাঁটছে। উত্তর ব্রাম্মন্দীর কাঁচা রাস্তা ধরে কুলপুদ্দি হয়ে মাদারীপুর নতুন শহরের পথে। শকুনী দীঘির পাড়। ইস! দীঘির কী নিটোল স্বচ্ছ জল! দেখলেই লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ভালোলাগে দীঘির জলে নিজের ছায়া এবং বসন্তের আকাশ। নরম ঝিরিঝিরি বাতাস। সুন্দর রোদেলা দিন। আকাশে বুনকা বুনকা মেঘের ধোঁয়া, দু’চারটা শকুনও উড়ছে। অয়ন কল্পনায় আকাশের মেঘের ধোঁয়া শ্যাওলার মতো সরাতে চায়। জলের বুকে, ঢিলের ঢেউয়ে শকুন খেদায়। মাইল দুয়েক দুরে আঁড়িয়াল খাঁ’র ধারে পুরান বাজারে আওয়ামী লীগের অফিস। বজ্রকন্ঠের সেই ভাষণ অনবরত ওদিকেই বাজছে, ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই….।’
এদেশে নাকি এই ভাষণ নিষিদ্ধ ছিল। কেউ নাকি প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নামটিও উচ্চারণ করতে সাহস পেত না। এসব ভেবে ভেবে অয়ন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। অয়নের চিন্তা-ভাবনা, কল্পনার জগৎ অন্যদের চেয়ে আলাদা। তাঁর বয়সী ছেলে-মেয়েরা ভুতের গল্প, অনেক রূপকথার গল্প জানে। কিন্তু অয়ন কোনো ভুতের কিংবা রূপকথার গল্প জানে না। কারণ তাঁর মা কোনো দিন তাঁকে ভুতের গল্প বলেননি, রূপকথার গল্পও শোনান নি। তাঁর মায়ের কাছে গল্প মানেই তাদের বিয়ের পরপর ফাল্গুন মাসের এক ভরা পূর্ণিমার রাতে স্বামী’র মুক্তিযুদ্ধে যাবার গল্প। একজন অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী’র স্বামীর জন্য পথ চাওয়া প্রতীক্ষার গল্প। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে কিন্তু স্বামী’র না ফেরার গল্প। দিন নাই রাত নেই অয়নকে শুধু দেশের গল্প, ভাষা আন্দোলনের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্পই বলেছেন। ছেলের সাথে কতবার যে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের গল্প করেছেন! তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সকাল নয়টা। স্মৃতিপথে হেঁটে হেঁটে অয়ন স্কুল গেটে। স্কুলের পুর্বমুখী গেটে প্রহরী কাশীনাথ নিত্য আছেই। বিহারী পাচু ধাঁঙ্গড় উর্দু ভাষায় কী যেন কি বলছে! ভাষণ আরো সুস্পষ্টভাবে কানে আসছে, ‘…তোমাদের যার যা কিছু আছে….’। নিমিষেই গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে যায়। রক্তে উন্মাদ উত্তেজনা! যে কোনো মূল্যে ঐ ভাষণের কাছে আজ যেতেই হবে। তবে কিছুতেই কাশীনাথের নজরে আসা যাবে না, এলেই দিনটা মাটি। কোথায় কি হচ্ছে, শহরময় আজ ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভাষণের এক-একটা শব্দ, কেমন জানি! একটা আরেকটার চেয়েও রক্তে শক্ত কামড় দেয়। কোথায় যেন নিয়ে যায়! অয়ন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। একজন মানুষের মুখের কথা কিভাবে এত প্রলয়ংকরী হতে পারে! অয়ন তা বুঝতেই পারে না। এত প্রবল প্রভাব! এত আদিগন্ত আবেদন! অয়নের মাথায় ঢোকে না।
কারা যেন স্কুলের বাইরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা পোস্টার লাগিয়েছে! সেই পোস্টারে অয়নের চোখ আটকায়। দিনটিকে আজ বড়দিনের চেয়েও বড় মনে হয়। ভীষণ খটকা লাগে, স্কুলে কোনো আয়োজন নেই কেন? তবে শুধু আজ কেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তো কখনই কোনো অনুষ্ঠান কিংবা আলোচনা হতে দেখেনি। অথচ স্কুলে ভর্তি হবার সময় মা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এই স্কুলে পড়তেন। সেই থেকে অয়ন অন্য স্কুলের বন্ধুদের সাথে বুক ফুলিয়ে কথা বলে। স্কুল নিয়ে তাঁর গর্বের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। অয়ন প্রায়ই স্বপ্নে দেখে বঙ্গবন্ধুর সাথে এসেম্বেলিতে দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে ক্লাস করছে। অথচ এই স্কুলের কোথাও বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি পর্যন্ত নেই। স্কুলের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢোকার আগে সাইনবোর্ডের দিকে একটু তাকায়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মাদারীপুর। বঙ্গবন্ধু যখন পড়তেন তখন এই স্কুলের নাম ছিল ‘ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’। অয়নের হাতে ক্ষমতা থাকলে স্কুলের আদি নামেই ফিরে যেত। তক্ষুনি গগন বিদারী কন্ঠের ধ্বনি ভেসে আসে ‘…তোমরা আমার ভাই…’ গর্বে বুকটা ভরে যায়।
স্কুলে ঢুকে বই-খাতাগুলো কোনোমতে বেঞ্চে রেখেই, হেড স্যারের রুমের দিকে যায়। হেড স্যারের রুমের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসে। ভয়ে হেড স্যারের রুমে সে যেতে পারে না। কিন্তু তাঁর মাথায় গুরুত্বপুর্ন একটা বিষয় এসেছে, সেটা তো হেড স্যারকেই বলতে হবে। তা ছাড়া হবে না। সমস্যা হচ্ছে, হেড স্যার খুবই বদ-মেজাজী মানুষ। তাই সাহসে কুলায় না। সারাক্ষণ কালো চশমা পরে থাকেন। আড়ালে-আবডালে মানুষ তাঁকে ‘কানা মাস্টার’ বলে।
কিন্তু অয়নের মাথায় কিছু একটা এলে, সেটা না বলা পর্যন্ত তাঁর বুকের মধ্যে কেমন জানি ধড়ফড় করে, কাঁপতে থাকে। অন্যান্য শিক্ষকদের ক্লাসেও কিছু জিজ্ঞেস করবে এমন চিন্তা করলেই তাঁর বুকের মধ্যে ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়। কথাটি বলা না পর্যন্ত এ অবস্থা থেকে তার মুক্তি নেই। আবার সেই বজ্রকন্ঠের ধ্বনি ‘…আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি…’ । কথাটি কানে আসা মাত্রই অয়ন নতুন উদ্যম ফিরে পায়। তাই সে আবার হেড স্যারের রুমের সামনে যায়। রুমের ভিতরে শো শো শব্দ করে সিলিং ফ্যান ঘুরছে, বাতাসে দরজার পর্দা মাঝে মাঝে একটু একটু ফাঁকা হয়, আবার বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ সিংহের মতো গর্জন করে হেড স্যার জিজ্ঞেস করলেন- ‘কে? ওখানে কে?’
অয়ন ভয়ে কোনো উত্তর দিতে পারলো না। স্যার ডাকলেন, ‘ভিতরে আসো’।
অয়ন ভিতরে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন- ‘কিছু বলতে চাও?’
‘জ্বি…জ্বি স্যার…’
‘বলো’।
অয়ন কাঁপা কাঁপা গলায় নিচু স্বরে বলল- ‘স্যার! আজ ১৭ মার্চ’।
‘হু, ১৭ মার্চ…তাতে কি হয়েছে?’
‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন…’
‘হু…’
‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের স্কুলে কিছু করা যায় না?’
স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। অয়ন সাংঘাতিক রকম ভয় পেয়ে গেল। তিনি কাছে এসে একটু উবু হয়ে অয়নের মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর পরম স্নেহে অয়নকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমার নাম কি বাবা?’
‘অয়ন’।
‘আমার ছাব্বিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তোমার মতো ছাত্র দেখি নাই’।
অয়ন কি বলবে? বুঝতে পারে না। স্যারের দিকে তাকায়, স্যারের চোখে জল টলমল। পকেট থেকে রুমাল বের করে স্যার চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘তুমি ক্লাসে যাও, বাবা’।
স্যার কেন কাঁদলেন? অয়ন তাও বুঝতে পারল না। ক্লাসে ফিরে গিয়ে সে কাউকে কিছু বলে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে জরুরি এসেম্বেলি কল করা হলো। হেড স্যার পা টেনে টেনে হেঁটে এসে একটা বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম এবং আত্মত্যাগের উপর এক আবেগঘন বক্তৃতা করলেন। পিনপতন নিরবতায় সবাই শুনলেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি অয়নকে ডেকে তাঁর পাশে বেঞ্চের উপর দাঁড়া করিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলেন, ‘আমার শিক্ষকতা জীবন আজ সার্থক। এই ছোট্ট ছেলেটি আমাকে আজকের এই বক্তৃতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে’। বক্তৃতা শেষে হেড স্যার একটি বিশেষ ঘোষনা দিলেন, ‘আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। দিনটিকে আমরা বিশেষভাবে উদযাপন করবো। কারণ বঙ্গবন্ধু এই স্কুলে এক সময় পড়ালেখা করেছেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সকলকে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি’।
বেলা বারোটায় পবিত্র কোরান, গীতা এবং বাইবেল থেকে পাঠ করে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধে সকল শহিদদের জন্য দোয়া করে অনুষ্ঠান শুরু হলো। তারপর একে একে কবিতা আবৃত্তি এবং দেশের গান পরিবেশন করা হলো। অতঃপর হেড স্যার তাঁর সমাপনী বক্তব্যে আর একটি ঘোষনা দিলেন, ‘এখন থেকে প্রতি বছর আমাদের স্কুলে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হবে। গান, কবিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হবে’। সব শেষে সবাইকে জিলাপির প্যাকেট দিয়ে, অর্ধদিবস স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন।
হেড স্যারের মতো কঠিন রাগী মানুষটার ভিতরে, এমন কোমল একটা হৃদয় থাকতে পারে! স্কুলের সবাই তা দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। স্কুলের প্রায় সবাই অয়নকে চিনে ফেলল। তখন থেকে হেড স্যারকে আর রাগী মনে হতো না, বন্ধুর মতো লাগত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা গেল বেড়ে, বহুগুণ। এক দেড় মাস পর একদিন তাঁর সহপাঠী আযম বিকৃতভাবে হেসে হেসে বলল- ‘তোর হেড স্যার তো ফিনিশ’।
‘মানে?’
‘মানে শ্যাষ’।
‘কি বলিস এসব? হেড স্যারের কি হয়েছে?’
‘যা খোঁজ নে…জানতে পারবি…’
হেড স্যারের রুমের দিকে অয়ন ছুটে যায়, কিন্তু রুমটি তালাবন্ধ। তিনি স্কুলে নেই। নেই কেন? স্যার কি অসুস্থ? নাকি আরো বড় কোনো বিপদ? স্কুলের পিয়নের কাছে জানতে পারলো, ক্রীড়া শিক্ষক করিম স্যার নাকি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়েছেন, তাই তাঁর কাছেই যায়। তিনি বললেন- ‘স্কুলে শিক্ষা কারিক্যুলাম বহির্ভুত কর্মকান্ড এবং তহবিল তসরুফের অভিযোগে উনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে’।
শিক্ষা কারিকুল্যাম বহির্ভুত কর্মকান্ড কি? আর তহবিল তসরুফ মানে কি? অয়ন এসবের কিছুই বোঝে না। তাই করিম স্যারকে জিজ্ঞেস করে। স্যার ধমকের স্বরে বললেন- ‘এটাও বোঝো না? বোঝোটা কি? কোন ক্লাসে পড়ো?’
‘এইটে’।
চোখে মুখে কুৎসিত ভঙ্গি করে করিম স্যার বললেন- ‘এইটে পড়ে! শেখ মুজিবের জন্মদিন পালন করা কি স্কুলের কাজ? এসব তো বাকশালীদের…আবার অর্ধদিবস ছুটিও দিয়ে দেয়! দরদ কত!’
অয়ন কেন জানি এসবের কোনো কিছুকে অপরাধ মনে করে না। তাই করিম স্যারের সামনে দাড়িয়েই থাকে। তিনি আবারো ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করেন- ‘কি? এখনো বোঝো নাই?’
‘স্যার… তহবিল?’
‘স্কুলের ফান্ডের টাকা দিয়ে জিলাপী খায়…পলিটিক্স করে! যাও… পোলাপানের এত কিছু বোঝার দরকার নাই। আর বেশি বুঝতে ইচ্ছে করলে, বাপেরে গিয়ে জিজ্ঞেস করো’।
অয়ন তাঁর বাবাকে পাবে কোথায়? বাবা তো মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন নি। করিম স্যার হঠাৎ করে কেমন জানি বদলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, হেড স্যারকে নিয়ে কী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন! অয়ন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। করিম স্যারের প্রতি তাঁর মধ্যে তীব্র ঘৃনার উদ্রেক হলো। তাই আর কথা না বাড়িয়ে হেড স্যারের ঘনিষ্ট বন্ধু আশরাফ স্যারের কাছে যায়। আশরাফ স্যার চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি অয়নের দিকে তাকাচ্ছেন না। কখন জানি চোখের জলে অয়নের গাল ভিজে যায়! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে জিজ্ঞেস করে- ‘এটা কি হলো স্যার?’ আশরাফ স্যার ঠিক করেছিলেন হেড স্যারের বিষয়ে কাউকে কিছু বলবেন না। কিন্তু অয়নকে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন-
“হেড স্যার কাউকে কিছু না বলে গতকাল রাতে চলে গেছেন। আজ সকালে স্কুলে আসার পর পিয়ন আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলল- ‘হেড স্যার আপনাকে এটা দিতে বলেছেন’। চিঠিতে লেখা- ‘আমার জীবনে এসব নতুন কিছু নয়। ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনের কথা বলে অনেক দিন আগে একবার বরখাস্ত হয়েছিলাম! কিন্তু দমে যাই নি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। যুদ্ধে আমার একটি চোখ হারিয়েছি, একটি পা পঙ্গু। তাতে কি? দেশ তো স্বাধীন করেছি। ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমাকে বরখাস্ত করে কি হবে? এদেশের কোটি কোটি মানুষকে কোথা থেকে বরখাস্ত করবে? শাস্তি দিয়ে কখনো ভালোবাসা থামানো যায়?”
শাখাওয়াৎ নয়ন
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক