ঈদের সেকাল একাল । পিয়ারা বেগম

  
    

ঈদ! দুটো অক্ষরের একটি শব্দ ৷ কিন্তু এর অন্তর্নিহিত আনন্দ অপরিমেয়। তা সেকাল কিংবা একাল। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে উৎসব আমেজে ধরন-ধারন পরিবর্তিত হলেও মূল প্রকৃতি রয়েছে এখনো অপরিবর্তিত। সংখ্যা গরিষ্ঠতার বিচারে বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। তাই আবহমান কাল থেকেই ঈদ উৎসব পালন করে আসছে যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।  ঈদের প্রধান আকর্ষণ ঈদগাহে সম্মিলিতভাবে নামাজ আদায় করা। নতুন পোশাকে, চোখে সুরমা, গায়ে সুবাসিত আতর মেখে ঈদগাহে যেত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। এতে মুসলিম উম্মার পরস্পরের সাথে পরস্পরের একাত্মতা ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে ভাব বিনিময় হতো। এটি মূলত এক পুনর্মিলনীর প্রতীক। 

সেকালে ঈদ আয়োজন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা ও অনাড়ম্বর। কিন্তু আনন্দ ছিল ভরপুর। রমজানের শেষদিকে শুরু হতো গ্রামীণ কালচারে ধোঁয়া-মোছার মহোৎসব। ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র নদী বা খালের পানিতে ধৌত করা হতো সাবান বা সোডা দিয়ে। ঘরদোরের ঝুলঝাড়া ও লেপাপোঁছা করা হতো জরুরি ভিত্তিতে। ঝকঝকে তকতকে দেখাত বাড়িঘর। বাড়ির গৃহিণীর কাজের চাপ বেড়ে যেত। ছোটরাও বসে থাকত না। মায়ের সাথে হাত মেলাত গৃহের টুকটাক ফুটফরমাসে। একালের ঈদেও এগুলো করা হয়। তবে পরিবর্তন এসেছে অনেক কিছুতেই। এখন গ্রামেও উন্নত মানের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। গোসল করতে এখন নদী বা পুকুরে যেতে হয় না। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার প্রতি সচেতনতা বেড়েছে।   

ঈদ পোশাক প্রসঙ্গ- সেকালে ঈদে মেয়েরা ফ্রক, ঘাগড়া পরত । বড়রা শাড়ি পরত। কোমড়ে বিছা পরার প্রচলনও ছিল। পায়ে আলতা, চুলের বিনুনিতে  লাল ফিতা, হাতে চুড়ি ছিল ঈদের সাজ। বাটা মেহেদি রংয়ে রাঙা নকশা আঁকা হতো হাতে। চোখে দিত হাতে করা কাজল। তখনকার সময়ে ফ্যাশান-ট্যাশান ছিল না। তবুও সুন্দর ও লাবন্য আভায় আলোকিত হতো মেয়েদের মুখশ্রী। সেকালে ছিলনা রেডিমেড পোশাক। আগে দরজীর কাছে মাপ নিয়ে জেনে নিত কতটুক কাপড় লাগে ফ্রক, পায়জামা বা শার্ট-প্যান্টে। বাজার থেকে কাপড় এনে দরজীর কাছে দেওয়া হতো। কখন নতুন ফ্রক বা শার্ট-প্যান্ট তৈরি হতো ছোটরা দর্জিবাড়ি গিয়ে চুপিচুপি উঁকিঝুঁকি দিত হররোজ। এটা ছিল শিশুমনের এক অদম্য চাওয়ার অগণন আনন্দের উৎস। ওরা লুকিয়ে রাখত ঈদ পোশাক। কারণ,  দেখাদেখিতে নতুনের জৌলুশ কমে যেত। এটা দেখে যদি কেউ এমন পোশাক কিনে ফেলে এই ভয়টাও ছিল তাদের। তবে নিম্নবিত্ত পরিবারে অনেকেই পুরানো পিড়ান ধুয়ে ঈদে পরত। এতে তারা মনোকষ্ট চেপে স্বাভাবিক ঈদ উৎসব পালন করত।

একালে পোশাকের সে কী বাহার! ফ্যাশন জগতে এক অনিন্দ্য সুন্দর পোশাকে বাজার সয়লাব ঈদ আয়োজনে। সেকালে মা-বাবা যা কিনে দিত তাতেই খুশি থাকত। এখন শিশুরা শপিংমলে যায়। নিজেদের পছন্দসই পোশাক নির্বাচন করে। একাধিক সেট নেওয়ার প্রচলন এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এখন উপজেলা পর্যায়ে শপিংমলেও আধুনিক পোশাকের ছড়াছড়ি। মেয়েদের থ্রি পিছ৷ লেহেঙ্গা আর ছেলেদের পাঞ্জাবি শার্ট-প্যান্ট, আগেও ছিল এখনও আছে। পোশাকের সাথে ম্যাচিং করে গহনা পরাও এখন ফ্যাশান !      

আগে চাঁদ দেখার আনন্দ উপভোগ করত  দলবদ্ধভাবে। হঠাৎ চাঁদ নজরে এলে  হৈ-হুল্লোড় করে জানান দিত সকলকে। বাঁকা চাঁদের স্নিগ্ধতা ঈদের মাধুর্যতার মূল অনুঘটক। তাই তো ঐ রাতকে বলা হতো চান রাত। চাঁনরাতেই হাতে মেহেদী পরার হিড়িক পড়ত। শহর থেকে কর্মজীবী কারো বাবা বা ভাইয়েরা বাড়িতে আসত। ঐ পরিবারে অপেক্ষায় থাকাটা ঈদ আনন্দে নতুন মাত্রা পেত। এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা ততোটা উন্নত ছিল না। লঞ্চ, ট্রেন বা বাস থেকে নেমে শীত মৌসুমে পায়ে হেঁটে আসতে হতো। অথবা বর্ষাকালে   কেরায়া নৌকা বা কোষা নৌকা দিয়ে আসতে হতো বাড়িতে। ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে বাড়ি আসার একটা অন্যরকম অনুভূতিতে আন্দোলিত হতো।

তবে এখন আগের চেয়ে বাড়ি যাওয়া প্রবণতা বেড়েছে। এবার খাবার প্রসঙ্গ- সেকালে ঈদ আয়োজনে প্রধান আকর্ষণ দুধসেমাই। শহরে থাকলেও গ্রামে লাচ্ছার প্রচলন ছিলনা। গ্রামে ময়দা কিনে হাতে বানাতো সেমাই। বউঝিরা ঘরের কামকাজ শেষ করে একসাথে বসে বানাত। রোদে শুকাত। ঈদের দিন গরুর দুধে ফুটাত। এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক। আরো এক ধরনের সেমাই তৈরি করত যা কাঁচা সেওই বা হাতের সেওই বলে পরিচিত ছিল৷ এখনো শীত মওসুমে গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে। চালের গুড়া কাই করে পিঁড়িতে নিয়ে হাতে বানানো হতো। এগুলো খেঁজুর রস বা খেজুরের গুড় বা তালের গুড় দিয়ে রান্না করলে হাত চেটেপুটে খেলেও এর স্বাদের তৃপ্তি মিটতনা। আখের গুড় দিয়েও রান্না করা যেতো। রান্না শেষে  দুধ মেশানো হতো। তাছাড়া ভাত দিয়ে লোহার চালুনে চেপে ঝুড়ি সেমাইয়ের প্রচলন ছিল অঞ্চলভেদে। তা রোদে শুকনো হতো। তারপর এগুলো মুড়ি ভাজার মতো ভেজে গুড় দিয়ে পাকানো হতো। সাথে দিত খই। এটা অত্যন্ত মুখরোচক ও সুস্বাদু এই ঝুড়ি সেমাই। এখন এগুলোও বিলুপ্তপ্রায়। একেবারে গরীব তাদের ঘরেও সাধ্যমতো ভালোমন্দ রান্না হতো।  ‘শিরনী’ ছিল সেকালের ঈদের অন্যতম আকর্ষণ। এর মূল উপাদান আতপচাল গুড় আর নারকেল। নারকেল ছাড়াও রান্না করা হতো। ঈদে শিরনী বাসী করে খেতে দারুণ স্বাদ লাগত। সচ্ছল পরিবারে  মুরগী গোশত আর লেটকা খিচুড়ি ছিল দুপুরের আয়োজন। পোলাওয়ের প্রচলনও তেমন ছিল না। তবে কখনোসখনো পাড়া বা মহল্লায় মিলেমিশে গরু কিনে আনত। জবাই করে ভাগবাটোয়ারা করে টাকার হার অনুসারে গোশত নিত। ঈদে সবার বাড়িতে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল ঈদের আনন্দের আরেকটা উৎস। 

একালের ঈদে লাচ্ছি সেমাই, ফিরনি-পায়েস, পোলাও-কোরমা, রোস্ট ফ্রাই এবং গরুর রেজালা। কাচ্চিবিরিয়ানিও করা হয়। চাইনীজ সবজি, নুডলস, স্যুপ, হালিম, চটপটি এবং ফুসকাও তৈরি করা হয়। আরো আছে রকমারি পিঠা আয়োজন । তবে উচ্চবিত্তরা বাইরে কোন অভিজাত রেস্টুরেন্টেও ঈদের খাবার খেতে যায়। 

 সেকালে ঈদ, সালামী রেওয়াজ পালিত হতো জোরেশোরে। তবে এর পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। দু’টাকার নতুন নোট পেলে এর আনন্দ এখনকার পাঁচশ টাকার কড়েকড়ে নোটের চেয়েও বেশি। পাঁচ বা দশ টাকাই ছিল সর্বোচ্চ সেলামী। মেয়ে জামাইকে ঈদ সেলামী দেওয়ার রেওয়াজ ছিল মূলত বাধ্যবাধকতাই বলা চলে। 

দলবদ্ধভাবে নতুন পোশাকে সাজুগুজু করে বাড়িবাড়ি ঘুরতে যাওয়ার রেওয়াজে এখন ভাটা। রাস্তাঘাটে উন্নয়নে অটোতে করে ঘুরাঘুরি করা এখন হালের ঈদ আকর্ষণ। আগে ঈদে নতুন সিনেমা মুক্তির হুড়োহুড়ি লাগত। ঈদে হাউসফুল হতো সিনেমা হল। কালোবাজারি থেকে কেনা টিকেট দিয়ে ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবি দেখার মজাই আলাদা। এখন টিভি তে সপ্তাহব্যাপী থাকে ঈদ আয়োজনে ভিন্নমাত্রা অনুষ্ঠানমালা। বিভিন্ন চ্যানেলে আগ থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠানমালার আকর্ষণীয় এ্যাড। প্রতিযোগিতায় টিভি চ্যানেলের প্যাকেজ নির্মাতাদের টানাটানিতে দর্শকরা হিমশিম খায়। তাই কমেছে বাইরে সিনেমা দেখার আগ্রহ আড়ম্বরতা।   

উচ্চবিত্তরা সপরিবারে কেউকেউ ঈদ উদযাপন করতে পাড়ি জামান বিদেশে। কেউ বা বিদেশে যায় ঈদ মার্কেটিংয়ে। তবে ঈদে বাড়ি ফেরা বেড়েছে অতীতের তুলনায় দ্বিগুণ। বাড়িমুখো মানুষ এখন গ্রামেই পায় ঈদ আনন্দের মধুর নিবিড়তার স্বাদ। সেকালে গ্রামে ঋতুভেদে ঈদে নৌকা বাইচ, হাডুডু, কাবাডি, ভলিবল, ফুটবল খেলার প্রচলন ছিল। আরো একটা আকর্ষণীয় খেলা ছিল গরুদৌড় প্রতিযোগিতা। এগুলো এখন প্রায়ই বিলুপ্তির পথে। এখন ক্রিকেট খেলার প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। তাছাড়া শহর বা গ্রামে এখন খেলার মাঠ আর আগের মতো নেই। 

এখন পোশাকের সাথে ঈদে চাই নতুন মোবাইল। ঈদ ঘুরাঘুরিতে হাতে মোবাইল না থাকলে কী চলে? ছবি ওঠানোও একটা ফ্যাশানে রূপ নিয়েছে। রমজানের ঈদে যাকাত দেওয়া ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। সেকালে যাকাত দেওয়া অতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে দেওয়া হতো না। ডান হাতে দান করলে বাম হাত যেন না জানে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে মানুষ দান করত। একালের যাকাত দেওয়ায় লৌকিকতাই বেশি। 

তবুও বলব, সবকিছু মিলে ঈদের দিন হয়ে ওঠে এক আনন্দময় সূচনার প্রতীক। এটি যেন চিরঞ্জীব আনন্দের ফল্গুধারা ঈদ উৎসব প্রতি বৎসর নবায়ন ঘটে এই দিনটিতে। তাই তো বিচিত্র আঙ্গিকে ঈদ হয়ে ওঠুক আরো নতুন মাত্রায়, নতুন জৌলুশে। রমজানের মাসব্যাপী সংযম ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হোক সবার জীবন এটাই প্রত্যাশা। 

পিয়ারা বেগম : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments