ঈদ নিয়ে স্মৃতি কথা
নতুন জামা
নতুন কাপড় পড়তে কেমন লাগে?
আমার কিন্তু খুবই ভাল লাগে। আমার বাড়িতে নতুন কাপড় একদিনের বেশী প্যাকেটে থাকতে পারে না। আমি কাপড়গুলোকে না ডাকলেও ঐ কাপড়গুলো আমাকে ডাকে, ‘আয়, কাছে আয়’। আমি টুপ করে প্যাকেট খুলি তারপর আয়নার সামনে গিয়ে তাকিয়ে থাকি। নতুন কাপড়ের গন্ধ আমাকে ঘুমাতে দেয় না। তা সেই কাপড় হাতের কাছেই থাক কিংবা আগে পড়ে ফেলব সেই ভয়ে সেটা কেউ কোথাও লুকিয়ে রাখুক।
মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রতিমাসে তো আর নতুন জামা পাওয়া যায় না। তাই ঐ বিশেষ উৎসব ছাড়া নতুন জামার কথা ভাবতে পারতাম না। ঈদের দিনে সকালে উঠে নতুন কাপড় পড়ে বাইরে ঘোরার যে আনন্দ তা কি দিয়ে মাপা যায়? নিজেকে তো তখন রাজা বাদশা মতই মনে হয়। আচ্ছা, নতুন কাপড় আর প্রিয় খাবার খেলে কি মন ভাল হয়? মনে আনন্দ হয়? এখন তো এগুলো নিয়ে রীতিমত গবেষণা হয়েছে। মানুষের মন ভাল করার কত তরিকা। এই যেমন মনের মত সিনেমা দেখা, গান শোনা, প্রিয় মানুষের গল্প করা থেকে শুরু করে ঐ নতুন জামা কেনা এবং ওটা গায়ে দিয়ে ঘুরাও সেই লিস্টে আছে। কিন্তু খেয়াল করবেন,ইদের দিনে নতুন জামা পড়া আর অন্য দিনে ঐ একই রকম জামা পড়ার আনন্দ কিন্তু এক হয় না। হবে কি করে? ঈদ কি আর প্রতিদিন হয়? ঈদের দিনে একটু বেশী ফুর্তি লাগে কারণ তখন সবাই নতুন জামা পড়ে। সবার মনে ফুর্তির ভাব লেগেই থাকে। কি আশ্চর্য এই আনন্দ শুধু যারা নতুন কাপড় কিনতে পারে তাদের কাছেই আটকে থাকে না । যারা কিনতে পারে না – তারাও এই আনন্দে ঠিক একইভাবে যোগ দেয়।
আমার বাড়ির পাশেই ছিল একটি বস্তি। বস্তির ছেলেমেয়েগুলোর সাথে আমার বেশ ভাব। আমার বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ির সামনে খেলতে গেলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কারণ একটাই – নতুন বল আর নতুন সাইকেলে একটু চড়া যাবে। আমাকে অনেকই বলত, ‘এই পোলাপানের লগে না খেইলা কিছু লেখা পড়া শিখান’। আমি হাসতাম। সবাই যদি সারাদিন লেখা পড়া করে তাহলে রাস্তায় খেলবে কে? আমি কারো কথা তোয়াক্কা করিনি। দিব্য খেলেছি।
একবার ঈদের সময় ওদের জড়ো করলাম। জিজ্ঞেস করলাম ঈদের দিন কে কি করবে? সবাই লম্বা লিস্টি দিল। নামাজ পড়া থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই চাইবে। তারপর বিকেল বেলা সাইকেল ভাড়া করে চালাবে। আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাইকেল কই থিকা ভাড়া করবি’?
‘ক্যান ভাইজান। আপনার পোলার সাইকেলটা ভাড়া লমু’।
আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমার ছেলের সাইকেল আমি কবে ভাড়া দেব বলেছি?
‘ভাইজান ঘণ্টা হিসাবে আপনারে পোষায় দিমু’।
আরেকজন বলে, ‘ভাইজান, আপনি ঈদের দিন কুন কাপড় পরবেন? আপনার পোলাটা কি পড়বো’?
আমি বললাম, ‘নতুন পাঞ্জাবী কিনছি। আর পোলার লিগা ও নতুন জামা কিনছি’।
সেই পিচ্চি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমরাও কাইলকা নতুন জামা পরুম। দেইখেন’।
তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে আমি নতুন প্ল্যান করি। আমার ছেলের সাইকেল ভাড়া না দিয়ে কি ভাবে অন্য কোথা থেকে সাইকেল ভাড়া করা যায়।
পরের দিন গোটা দশেক পিচ্চি আমার বাড়ির সামনে হাজির। ওদের বয়স কত হবে? মনে হয় সাত আট থেকে শুরু করে খুব বেশী হলে বারো বছর হবে। আমি আর আমার ছেলে ওদের সাথে বাড়ির সামনে দেখা করলাম।
‘ভাইজান দেখেন তো আমার জামাটা কেমন হইছে’?
এবার সবগুলো পিচ্চি প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। কে আগে ওর নতুন জামা দেখাবে? আমার ছেলে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘বাবা, ওরা তো নতুন জামা পড়ে নি। দেখ ওগুলো ওদের পুরাণ জামা’।
আমিও জানি ওগুলো ওদের পুরানো জামা। কিন্তু ঈদের দিনে পড়বে বলে ওরা পরিষ্কার করে ধুয়ে, বালিশের নীচে রেখে ইস্ত্রি করে ঈদের দিনে গায়ে দিয়েছে। কারণ আজ ঈদ। আজ খুশির দিন। আজ এমনিতেই মনে ফুর্তি লেগে আছে। আমি ছেলেকে বলি, ‘মনে ফুর্তির জন্য নতুন জামা দরকার হয় না। শুধু ভাবলেই হয়’।
এই সকল উৎসব কি আশ্চর্য ভাবে মানুষের মনে আনন্দের বৃষ্টি এনে দেয়। এই একদিন, সবাই একই ভাবে, একই সুরে সেই বৃষ্টিতে স্নান করবে। আর এই কারণেই এই সকল উৎসব আমার ভারী প্রিয়।