আবার গোছাতে হবে সব; শুরু থেকে। বই-খাতা, পানির গ্লাস, কাঁধের ব্যাগ। নতুন সময়, নতুন গল্প। ঘরের পর্দা, পাপোশ, কলিং বেল। হাত ঘড়িটায় দম দিতে হবে। হলুদ জামার মাঝখানের বোতামটা লাগাতে হবে। চটি জোড়া ফেলে শক্তবেল্টের স্যান্ডেল জুড়তে হবে পায়। পকেটে হাত রাখা যাবে না। আপাতত: বাক্সপেটরা তোলা থাক। গলির মোড় বন্ধ। এবার ভেবেছি চুলের সিঁথিটা উল্টো দিকে করবো। দারোয়ানকে বলবো- সব দেখে রেখো ঠিকঠাক।
অনেক কিছুই মুছে যায়, ধুয়ে যায়। আলগা হয় শাড়ির কুচি, মুখ, স্মৃতি। মায়াভরা চোখে আলো কমে আসে। জানালায় কড়া নেড়ে রোজ যে শিরিষ ঘুম ভাঙ্গাতো, রোদ এসে বসতো চোখের পাতায়, ওরা লোকটাকে খুঁজবে। পাশের বাড়ির ছেলে দুটো ‘হালুম’ বলে রোজকার মতো ভয় দেখাবে। মাঝবয়সী যে নারী বারান্দায় আসার আগে দেখে নিতো চোরাচোখে, সেও অবাক হবে একবার। কে কবে কোথায় উধাও হয়ে যায়, কখন কার গন্তব্য কোনদিকে মোড় নেয়, সে সব গল্প তোলা থাক তাকে, ঘুলঘুলিতে। আজ ভীষণ ঝড়। ভীষণ তাড়া। বাতাসে উড়ে যাচ্ছে চালচুলো, হাতের কব্জি, পায়ের নুপুর।
মাঝখানে অনেক বছর, অনেক ওলোটপালোট, অনেক বদল। অপেক্ষায় থেকে থেকে প্রিয়তম বন্ধুরা ফিরে গেছে ঘরে। ঘর বেধেছে প্রিয়তমারা। শেষ যে মেয়েটি শেষসময় বেঁধে দিয়েছিল, সেই শেষটুকুও শেষ। ওরা এখন সংসার করে। সন্তানন্তুতি পালে। হাসিমুখ বারান্দায় রেকর্ডের গান শোনে। বাতাসে চুল নেড়ে ফর্দ আটে বাজারের, জীবন যাপনের। গান গায়, সুর বাধে, ঝগড়া করে।
কাল বাড়ি খুঁজতে হবে। চেনা জানা থেকে খানিকটা দূরে, নিভৃতে হলে ভালো হয়। নিরব নিরবচ্ছিন্ন সুনসান একটা গলি থাকবে। গলির মাথায় এদোডোবা। তার খানিকটা পরেই মুদির দোকান। আরেকটু এগোলেই ‘পথ শেষ’ সাইনবোর্ড। এমন একটা গলির মুখে এমন একটা চিলেকোঠা, যেখান থেকে আর ফেরা নেই, ফিরতে হবে না।
একটা দ্বীপ পেলে ভালো হতো। এক চিলতে এক টুকরো পাথরের ওপর নির্বাসিত জীবন। জল খেলতো, মন খেলতো। জলে জলে ভেসে যেত স্বপ্নে বোনা নোনা সাধ-আহলাদ, বাসনা। টুকরো টুকরো ছবিগুলো পাথরে টক্কর খেয়ে খেয়ে নৌকা হতো, কাগজের নৌকা। ভাসতে ভাসতে ভিজতে ভিজতে কোনো এক ছেড়াদ্বীপে এক সবুজ বিকেলে ডুব দিতো অলক্ষ্যে। পাড়ে বসে লোকে ভাবতো- লোকটা ঠিক জেগে উঠবে, চল আমরা বাড়ি ফিরি।
মনকে নিয়ে ভাবি। বলি, মন শান্ত হও; সন্ধ্যার কালোজল পুকুরের মতো সুস্থির, শান্ত। মেঘে ভেজা কাপাস তুলোর মতো নীলাভ আকাশের বড় দুর্দিন আজ। বড় মিথ্যা চারপাশ। ভুল মানুষের ভুল ঠিকানার ভীষণ ছড়াছড়ি। কোত্থেকে হঠাৎ বাজখাঁই মুখোশমুখ সব লন্ডভন্ড করে দেবে; লহমায় হাতিয়ে নেবে বাজার-হাট, সওদাপাতি, হাতের থলে- তুমি তার কিছুই টের পাবে না। কেবল বুকের ভেতর এক চিনচিনে ব্যথা, কন্ঠে দলা পাকিয়ে এক টুকরো অস্ফুট স্বর, তোমাকে বেদনাহত করবে, তুমি কাঁদবে।
ছেলেটাও কাঁদবে নিশ্চয়। সায়েন্স বক্স বের করে ‘পাওয়ার পিনটা দাও তো’- বলে চোখ বাড়িয়েই দেখবে একটা ছায়া পড়ে আছে; মৃত, অস্পষ্ট ছায়া। মানুষটা কোথায় গেল, আবার কি আসবে, নাকি- ভাবতে ভাবতে ঠাণ্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়বে। স্বপ্ন দেখবে। সওয়ার হয়ে পিঠে চেপে বসবে। ‘হাট’ ‘হাট’ বলে মুখের চাবুক ছুড়বে। পাহাড়া সমুদ্র ডিঙ্গিয়ে, জলকাদা পায়ে, যুদ্ধ-হাঙ্গামা শেষে নামতে গিয়েই আবার হোচট খাবে ছেলেটা। সব গল্প স্মৃতি খামচে দেবে ওর মুখ চোখ নাক। শিশুটা কাঁদবে। ওর জলে জলে ভেসে যাবে লোকটার পিঠ, বুক, জামা। সাঁতার না জানা লোকটা বুকসমান সে জলেই ডুবে মরবে।
রঙে রঙে সাজানো যে ঘর, সেখানে নতুন রঙ পড়বে। ঝুলকালি মুছবে, মাকড়সা ঝাড়বে, সঙ্গে দেয়ালের ছবিটাও। ছবিতে কতকগুলো রেখা ছিল। হাসির রেখা। সেখানে আলো পড়লেই ছবিটা হাসতো। সুষমায় ভরে যেত ঘর। লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতো। এখন বারান্দার অন্ধকার কার্ণিশে রেখাগুলো ঝুলকালিরর মতো কেবলই চক্রব্যুহ রচনা করবে।
অনেককিছুই তো ভেঙ্গে যায়। সম্পর্ক, বন্ধন, জোড়া দেওয়া দাগ। সুতো কেটে গেলে ঘুড়ি ভেসে যায় হাওয়ায়, মেঘে মেঘে। দিনে দিনে, রঙে রঙে, শেষবেলায় কোন গল্পটা শেষঅবধি একান্তই নিজের হয়ে থাকে, কে জানে। এক জীবনে কত গল্পইতো শোনা হলো, বোনা হলো। রক্ত-ঘাম দিয়ে, কায়ক্লেসে গতরে খেটে, কত পুঁজি পাট্টা দিয়ে, যে ময়ুরপঙ্খি নাও গড়িয়েছিলাম, সেখানে এখন জরীর জামা গায় ভুল মানুষের স্রোত। ভুলভাল মন্ত্র জপে, উল্টো দাড় টেনে, ওদের এখন ভাটির টানে টান। উজানে পড়ে থাকে হীরা মুক্তা, রাজকুমারীর বসনবাসন, দাড়ি মাল্লা গান । উজানে পড়ে থাকে উল্টো স্রোত, উল্টো বানে পা ডুবে যাওয়া বালির গর্ত। উজানে পড়ে থাকে বানভাসি একজন মানুষ!
৭ জুন ২০২০
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।