‘কোথায় গেলা নদের চাঁদ, কোথায় মহুয়া, এইখানে কান্দিসে রাধে, আইসো দেখিয়া’ । প্রতীক ইজাজ
‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ বা ‘যুবতী রাধে’- খুবই জনপ্রিয় একটি লোকগান। বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে গানটি খুবই আদৃত। মঞ্চ, টেলিভিশনের পাশাপাশি ইউটিউবে এই গানের শ্রোতা অসংখ্য। যারা লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে এই গানের সাহিত্যিক মুল্য অনেক বেশি। বিশেষ করে বাংলার আদি লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমান সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের নিবিড় যোগসূত্র এই গান।
কিন্তু এই গানের মুল রচয়িতা কে, কার পদ বা গীত; কবে কিভাবে গানটি রচিত হয়েছে; এখন যেভাবে গাওয়া হচ্ছে, সেটাই মুল সুর কি না, কিংবা গানের আদি সূর কেমন, গাইবার মুল ভঙ্গি-ই-বা কি; এসবের কোন সঠিক তথ্য জানা নেই কারো। যেটুকু জানা, তা ভাসা ভাসা, অস্পষ্ট।
আমি ব্যক্তিগতভাবে লোকগান ও গানের কথা সংগ্রহ করি। দুই বাংলার বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, এমনকি বিভিন্ন দেশের নানা ভাষার লোকগান শুনি। যে সব গান মন স্পর্শ করে, তাল-লয় মনে ধরে, গাইবার ধরণ পছন্দ হয়, সে সব গানই আমার সংগ্রহের তালিকায়। আমি আমার জন্য এসব গানের মধ্যে কিছু গানের কন্ঠ ও দম, আবেগ ও রীতি অনুযায়ি এক ধরণের গীতরীতি দাঁড় করেছি। নিজের মতো করে গাই। মাঝেমধ্যে কাউকে কাউকে শোনানোর চেষ্টাও করি।
এসব করতে গিয়ে কিছু বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আমি দেখেছি, দেশ ও শিল্পীভেদে একই গান একেকভাবে গাওয়া হয়েছে। তবে বেশির ভাগেরই গাইবার রীতি অভিন্ন। গানের কথাতেও ভিন্নতা এসেছে। একই গানের অন্তরা, বাক্য বা শব্দ একেকরকম। কোন কোন গানে নতুন পদ যুক্ত হয়েছে। এমনকি কিছু গানের সুর একই রেখে বদলে ফেলা হয়েছে পুরো গানের পদ।

বেশ কিছু বাংলা লোকগানের পদকর্তা বা রচয়িতা নিয়ে ঝামেলাটা সবচেয়ে বেশি। ইউটিউবে বা টেলিভিশনের পর্দায় বা মঞ্চে শিল্পীরা কিছু গানের কথা ‘সংগৃহীত’ বা ‘অজানা’ বলে উল্লেখ করেন। পরে অনেক খোঁজ করে দেখেছি এবং গাইবার পাশাপাশি যে সব শিল্পী ও সাধক লোকগান নিয়ে চর্চা করেন, তারাও গানগুলোর রচয়িতা বা গীতিকার বা পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। এমনকি তারা এসব গানের পেছনের ইতিহাসও বর্ণনা করেন মাঝেমধ্যে।
‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটিও বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি প্রাচীন উপাদান। সম্প্রতি এই গানের রচয়িতা বা পদকর্তা এবং স্বত্ব নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক উঠেছে। গত ২০ অক্টোবর আইপিডিসি ফিন্যান্স লিমিটেড নামে এক বেসকরকারি সংস্থা তাদের ওয়েবপেজে এই গানের একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। গেয়েছেন দুই কন্ঠ-অভিনয় শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী। বিপত্তি বেঁধেছে গানের কথা ‘সংগৃহীত’ শব্দটি নিয়ে।
পরদিন বুধবার এতে আপত্তি জানায় ‘সরলপুর’ নামে একটি গানের দল। তাদের দাবি গানটি ওই দলের নিজস্ব এবং এই গানের সরকারি কপিরাইটও আছে তাদের। তাদের আইনগত ব্যাখ্যার মুখে তাৎক্ষনিকভাবে নিজেদের ওয়েবপেজ থেকে গানের ভিডিওটি সরিয়ে নেয় আইপিডিসি। কিন্তু প্রকাশের পরপরই গানটি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং বিভিন্ন ইউটিউবে প্রচার হতে দেখা যায়। রীতিমত হইচই পড়ে যায়।
এ নিয়ে এখনো বেশ আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কে মুখর সংস্কৃতি অঙ্গন।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরলপুর গানের দল জানায়, গানটি মৈমনসিংহগীতিকা থেকে সংগৃহীত বলে মানুষের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, তা সঠিক নয়। মূলত দলের প্রতিষ্ঠাতা ভোকাল ও গিটারিস্ট তারিকুল ইসলাম তপন ও সদস্য আল আমিনের লেখা ও সুর করা। রাধা কৃষ্ণের গল্প থেকে বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা, শব্দচয়ন সংগ্রহ করে গানটি রচনা করেছেন তারা। কোথাও থেকে কোনো হুবহু কথা সংগ্রহ করেননি। এমনকি এ গানের সঙ্গে কোথাও কোনো গানের হুবহু মিল নেই বলেও জানায় দলটি। বিভ্রান্তি এড়াতে ২০১৮ সালে গানের কপিরাইটও সংগ্রহ করে দলটি।
গানের প্রসঙ্গে কন্ঠশিল্পী সুমি মির্জার নামও আসছে। তিনি এই গানটি গেয়েছেন এবং তার কন্ঠেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সরলপুর কপিরাইট চাইলে তখনই প্রশ্ন তোলেন তিনি। তারমতে গানটি মৈমনসিংহগীতিকার মহুয়া বা গোয়ালিনী গান। পরে দুইপক্ষের শুনানী শেষে সরলপুরকে কপিরাইট দেয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
এমন বিতর্কের মুখে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানের ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য দেন সুমি মির্জা। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, গানটি তিনি প্রথম শোনেন যাযাবর ব্যান্ডের সদস্য রাসেলের কন্ঠে। পরে তিনি গানটি নিজে গান। ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল তার কন্ঠে গাওয়া গানের ভিডিও লেজার ভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ হয় এবং বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এমন অবস্থায় সে বছরের ৪ জুন সরলপুর গানটি নিজেদের নামে কপিরাইট করে নেয়। পরে সুমি মির্জা গানটি নতুন করে তৈরি করে ‘বিনোদিনী রাই’ নামে কপিরাইট করে নেয়। সুমি অবশ্য এমনও স্বীকার করেছেন, এই গানের প্রথম আট লাইন তিনি নিজে লিখেছেন। লেখার জন্য সহায়তা নিয়েছেন মৈমনসিংহ গীতিকা, মহুয়াপালাসহ আরো দু-একটি লোকজ অনুষঙ্গের।
অবশ্য সরলপুর দলের প্রধান ভোকাল মার্জিয়া তুরিন নিজেও এই গানের ৩০ শতাংশ সংগ্রহ বলে স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, ২০০৮ সালে বকশীগঞ্জের এক সাধুর কাছ থেকে গানটি পান। তখন ওই বাউল খুবই বৃদ্ধ এবং তার সঙ্গে একজন সাধন সঙ্গিনীও ছিলেন। সেই সাধুর থেকে এই গানের ৩০ শতাংশ পান তারা। পরে দলের সদস্য আল আমিন এবং দলের প্রধান গিটারিস্ট ও তুরিনের স্বামী তরিকুল ইসলাম তপন বাকি সত্তর শতাংশ গান রচনা করেন। পরে গানটির কম্পোজিশন করেন তপন। ২০১২ সালে গানটি রেকর্ড করেন তারা। তবে কোথাও সরলপুর মৈমনসিংহগীতিকা থেকে ভাববিশেষ বা অংশবিশেষ নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি।
চঞ্চল চৌধুরীও মুখ খুলেছেন। তারমতে, আমাদের লোকগানের পদরচয়িতা কে বা কারা, তা জানা যায় না। লোকমুখে শুনতে শুনতে একটা পর্যায়ে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী পদগুলো আমাদের সংস্কৃতির বিশাল শক্তি। এটাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। চুরি–ডাকাতি করে নিজের দখলে নেওয়া, আমি করেছি কিংবা লিখেছি, এমন ভাব দেখানো মোটেও উচিত না। চাইলেই কোনো মানুষ এই ধরনের পদ লিখতে পারে না! এই ধরনের পদ, একটু কারেকশন করে আমার বলা খুবই অন্যায়। এ রকম অসংখ্য গান, কবিতা ছোটবেলায় প্রচুর শুনেছি। সবার মুখে মুখে ছড়িয়েও আছে। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে নিজের বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে সেটা খুবই দুঃখজনক। তিনি এমন দাবিও করেছেন, ৩০ ভাগ না, গানটির ৭০ ভাগ সরলপুরের সংগৃহীত। অর্থাৎ মুল গানটি তারা সংগ্রহ করেছেন। তা হলেও সেই গান নিজেদের হয় কি করে?
কথা বলেছেন কপিরাইট অফিসের কর্মকর্তারাও। কপিরাইট নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, সরলপুর ব্যান্ড ‘যুবতী রাধে’ গানটি নিজেদের লেখা, সুর করা ও তৈরি হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ জুন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নেয়। কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল সুমি মির্জা নামের একজন শিল্পী আপত্তি তুলে বলেন, গানটি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’–এর ‘যুবতী রাধে’ গানের নকল। এরপর কয়েকটি শুনানি হয়। তখন সরলপুর ব্যান্ড ২০১২ সালের একটি রেফারেন্স দেয়, যেখানে দেখা যায়, চ্যানেল নাইনের একটি অনুষ্ঠানে তারা গানটি গাওয়ার সময় বলেছে, এই গানের ৩০ পারসেন্ট তাদের সংগ্রহ আর ৭০ পারসেন্ট তাদের রিমেক করা।
তারমানে এই গানের কপিরাইট দুইপক্ষের কাছেই আছে ভিন্ন নামে, কথা ও সুর একই। দুজনই স্বীকার করেছেন তারা মুল গান ও সুর অবলম্বন করে বাকিটা লিখেছেন ও সুর করেছেন। সঙ্গত কারণে দুটি প্রশ্ন বা জানার আকাঙ্খা সামনে চলে আসছে। এক- এই গানের মুল রচয়িতা বা পদকর্তা কে? সেই গানের সুরই-বা কেমন? দুই- সংগৃহীত একটি গানের কপিরাইট ব্যক্তি বা দলের নামে মন্ত্রণালয় দেয় কিভাবে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে লোকগানের লিরিক সংগ্রহ করে গিয়ে দেখেছি, বেশ কিছু গানের একটি বা দুটি অন্তরা, কিংবা গানের মুখটুকু পাওয়া যায়। মানে অসম্পুর্ণ। কোন কোন শিল্পী যেটুকু পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে মিল রেখে গানটি সম্পুর্ণ করেছেন এবং গেয়েছেন। সেখানে তারা মুল পদকর্তা বা রচয়িতা বা গীতিকারের নাম দিয়েছেন। পাশাপাশি যে অংশটুকু নিজেদের সেটুকুর কথাও উল্লেখ করেছেন। আমি নিজেও এমন কিছু গান পেয়েছি, যার মাত্র একটি অন্তরা আছে, কিংবা পুরো পদ সম্পুর্ণ না, একটি বা দু’তিনটি লাইন পাওয়া যাচ্ছে না, বা মিলছে না। সেখানে আমি নিজেও পদ ও সুর ঠিক করে কিছু লাইন বা অন্তরা লিখেছি। মুল পদকর্তা বা গীতিকার সাধকের নাম উল্লেখ করে নিজের অংশটুকু চিহ্নিত করে দিয়েছি।
সঙ্গত কারণেই এখন জানাটা খুব জরুরি যে এই গানের মুল পদকর্তা বা রচয়িতা বা গীতিকার কে? আমার নিজের আগ্রহ থেকেই আমি গত কয়েকদিনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ও অনলাইনে অনুসন্ধান করেছি। কথাও বলেছি গান নিয়ে যারা কাজ করেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে।
কেউ বলছেন, এই গানের স্রষ্টা রাধা রমন। সোনেলা দিগন্ত ব্লগে ২০ অক্টোবর ২০১৩ সালে একজন লিখেছেন- ‘কোথায় পাব হার কলসি/ কোথায় পাব দড়ি?/ তুমি হও যমুনা রাধে/ আমি ডুইবা মরি – রাধা কৃষ্ণের একটি মজাদার গান শুনুন । কত কাকুতি মিনতি রাধার কাছে । আহা রাধার কত ভাগ্য । সর্বত মন গল রাধে বিনোদিনী রায়।
তবে বেশিরভাগ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই গানটা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গীতিকা ধারায় প্রণীত কবি দ্বিজ কানাই এর মৈমনসিংহগীতিকার “মহুয়া” পালা থেকে নেওয়া। দ্বিজ কানাই প্রায় ৩৭০ বছর পূর্বে এই পালাগানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে ‘নদের চাঁদ ও মহুয়া’র পালা বা গাথা নামে পরিচিত। আর এটি সংগ্রহ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।
সাত বছর আগে সাউন্ডক্লাউডে গানটি আপলোড করা হয়। সেখানে লিখা আছে- ‘সরলপুর, যুবতী রাধে, কণ্ঠ : তপন ও শাওন, কথা : তপন ও আল আমিন, সংগীতায়োজন : সরলপুর।’ ুনিচে মন্তব্য করেছেন একজন- ‘নতুন ব্যান্ড “সরলপুর” এই গানটি গেয়েছিল চ্যানেল নাইন এর `উই আর দ্যা ব্যান্ড’ প্রোগ্রামে। গানটার অনেকগুলো ভার্সনের মধ্যে এটা বেশ ভালো। এটা মূলত মৈমনসিংহ গীতিকার `মহুয়া নদের চাঁদ ও গাঙের গল্প’ পালাগান থেকে নেয়া।
আবার ব্লগার কামরুল হাসান কিরন তার এক পোস্টে বলেছেন, ‘এটা নাকি “গোয়ালী” সূরের গান। একসময় গ্রামে এক ধরনের গায়ক আসতো যারা এই সুরে গান গাইতো, এরা সব সময় গোয়াল ঘরের দরজার বসে গান গাইতো এবং এর উদ্দেশ্য ছিল গৃহপালিত পশুর উপর থেকে আপদ (খারাপ কিছু) দূর করা। এরা আসতো আঊস বা আমন মৌসুমে ধান কাটার সময়, বিনিময়ে এরা ধান বা চাল নিত। এ কারনে এদের “গোয়ালী” বলা হতো ‘।
সেই ব্লগারের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিচে লিমন পারভেজ নামে একজন লিখেছেন- লিরিকটার নিচের ডেসক্রিপশন পড়ে বুঝলাম । হ্যাঁ গোয়ালে এরকন গান হতে দেখেছি । ১ জন বৃদ্ধ এসে আমাদের গোয়ালে এরকম গান গাইতো , কিন্তু সেগুলো হিন্দু ধর্ম রিলেটেড হইতো । দাদার কোলে বসে গান শুনেছিলাম মনে আছে এখনো। ( ১২ বছর আগের সৃতি তে ফিরে গেলাম কিছুক্ষনের জন্য )।
চঞ্চল চৌধুরীও গণমাধ্যমকে বলেছেন, গানটি সরলপুর ব্যান্ডের মৌলিক সৃষ্টি নয়। এটি বহু বছর আগের প্রচলিত একটি গান। সরলপুরের গানটির বেশিরভাগই লাইন মধ্যযুগের কবি দ্বিজ কানাইয়ের লেখা মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া গানের পদের মতো।
মৈমনসিংহগীতিকার উইকিপিডিয়াতে এই গানের একটি অংশ পাওয়া গেছে। সেখানে লিখা হয়েছে- ‘বাংলার লোকগীতি বা গীতিকার ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। কবি দ্বিজ কানাই প্রণীত “মহুয়া” পালাটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গীতিকা ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। দ্বিজ কানাই প্রায় ৩৭০ বছর পূর্বে এই পালাগানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে ‘নদের চাঁদ ও মহুয়া’র পালা বা গাথা নামে পরিচিত। এটি একটি দৃশ্য কাব্য (প্রাচীন পল্লীনাটিকা)। মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে এটি অন্যতম। দীনেশ্চন্দ্র সেন রায়বাহাদুর সংকলিত এবং ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র প্রথম খন্ড- থেকে এ পালাটি গদ্যে রুপান্তর করে গৃহীত হয়েছে। পালাটিতে মহুয়ার দুর্জয় প্রেমশক্তি ও বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় কীভাবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ধ্বংস হয়ে গেল তারই মরমী কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গীতিকাটির কাহিনি গড়ে উঠেছে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক প্রণয়কে কেন্দ্র করে। একদিকে ছয় মাস বয়সী চুরি হওয়া কন্যা অনিন্দ্যকান্তি মহুয়া, অন্যদিকে জমিদারপুত্র নদের চাঁদ। তাদের অদম্য প্রেম সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বেদে সরদার হুম্রা সামাজিক, বৈষয়িক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে এ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। মৃত্যুই হয় তাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ‘।
এখানে ‘মহুয়া’ পালার বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখা হয়েছে- মহুয়া কপট রাগ প্রদর্শন করে তিরস্কার করে নদের চাঁদকে-
‘লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর,
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুইব্যা মর।’
–
‘কোথায় পাইবাম কলসী কইন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি,
তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।’
আবার সরলপুর ও সুমি মির্জা যে গানটি গেয়েছেন, সেখানে মহুয়া পালার সঙ্গে অন্তত চারটি লাইন বেশ মিলে যায়। তাদের লিরিকে রয়েছে-
আমার মতো সুন্দর রাধে যদি পেতে চাও
গলায় কলসি বেধে যমুনাতে যাও
–
কোথায় পাবো হাড় কলসি কোথায় পাবো দড়ি
তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি
তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি
অর্থাৎ দ্বিজ কানাইয়ের ‘মহুয়ার পালা’র গীত শহুরে শব্দে রূপান্তর করেই রচিত হয়েছে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ বা ‘যুবতী রাধে’ গানটি। অথচ সেই পালায় কী নিখুত শব্দচয়ন করেছেন দ্বিজ কানাই। ভাবা যায়, সাড়ে তিনশ বছর আগের মৈমনসিংহগীতিকার ‘মহুয়া’ পালার সেই শব্দ বা পদ এখনো কত পরিচিত, মধুর । কানে বাজে, বুকে টান তোলে। আদি পদে গাইলে কতটা নিবিড়ভাবে বর্ণনা করা যায় নর-নারীর লোকায়ত প্রেমকাহিন!
এমন সার্বজনীন লোকসম্পদ নিয়ে এমন বিতর্ক বা স্বত্বযুদ্ধে, ক্ষোভে বেদনায়, নতুন পদ আসছে মনে, গলা ছেড়ে আমার গাইতে ইচ্ছে করছে- ‘কোথায় গেলা নদের চাঁদ, কোথায় মহুয়া, এইখানে কান্দিসে রাধে, আইসো দেখিয়া’।
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
২৫ অক্টোবর ২০২০ সাল।