উৎসব ভালো লাগে, টানে, প্রাণ পাই। উৎসবের রঙ দোলা দেয় মনে, আন্দোলিত হই, আনন্দ জাগে। এত এত মানুষকে একসঙ্গে এক উৎসবে দেখলে শক্তি পাই। কাজে প্রকাশে, নানা প্রকরণে, যে সংহতি অসাম্প্রদায়িকতা মুক্তচিন্তা ও প্রগতির কথা ভাবি, প্রকাশ করি- উৎসব, প্রকৃতি ও মানুষের সম্মিলন, সেই শক্তির নতুন বার্তা দেয়। আমরা আমাদের জাগরণকে দীর্ঘায়িত করি।
কাল ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। শেষ দিন, বছরের শেষ। কায়মনে প্রার্থনা ছিল- দূর হোক বালামসিবত, জরাব্যাধি। বছর জুড়ে যে শ্রম স্বপ্ন, তার আলো থাক ঘরে, মনে। চোখ ভরুক আলোয়, মঙ্গলে।
আজ নববর্ষ। বাংলা নতুন বছর ১৪২৮। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। মঙ্গল আরতি নিয়ে আজ গাইবে মন কল্যানের বাণী। মানুষে মানুষে ভেদ ভুলে, মানুষ গাইবে গান মানুষের। শুভ রঙ – রাঙাবে পৃথিবী। আলো-বাতাস, বৃক্ষ-লতা-মাছ, সংহত ঐক্য টান, আজ ফের জাগবে মন শুভ সংকল্পবোধে।
মহামারীর কাল। সংকট, সংবরণে আছি। প্রতিদিন করোনায় মানুষ মরছে, আক্রান্ত হচ্ছে। স্বজন বন্ধু প্রিয়জনের কান্না, চিন্তামুখ- উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। রাতে ঘুমুতে গেলে হারিয়ে যাওয়া স্বজনের ছবি ভাসছে ছাদের কার্ণিশে। গান শুনি, নাটক দেখি, টেলিভিশনে আটকে রাখি চোখ; কিন্তু মন তো মানে না, সায় দেয় না। মন ঘুরে ফিরে মৃত্যু দেখে, রোগ-জরা দেখে।
গতবছরও উৎসব হয়নি। বর্ষবরণে রাঙেনি চারুকলা, দোয়েল চত্ত্বর, রমনার সবুজ মাঠ। পাতার বাঁশি বাজিয়ে সেবারও মঙ্গলশোভাযাত্রায় যোগ দেওয়া হয়নি আমাদের। গলা উচু বক, লম্বা ঢ্যাং ধূসর সারস, আকাশছুঁই বাঘ দেখা হয়নি। ভোরের আলোয় মিশে বকুলের রঙ, কেউ বরণ করেনি আমাদের। খই মুড়কি বাতাসার গন্ধ, নকশা আঁকা প্রতিবেশীর উঠোন, নতুন ডালায় সাজিয়ে পূজোর পসরা- কেউ ডাকেনি কাউকে। গলা চড়িয়ে সোহরাওয়ার্দীর ভীড় উদ্যানে, কেউ গায়নি গলাভাঙা গান।
এবারও উৎসব নেই, রঙ নেই। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে স্মৃতির গল্প। বুকের ভেতর চাপ চাপ ব্যাথা, কষ্টকথা। কাকে বলবো, কি বলবো- সব বেদনার রঙ নীল, সব বেদনায় মিশে থাকে চোখের পাতায়। রাতে যখন জানালা খুলে বাইরে চোখ রাখি, পেঁচা ডাকে, ভুতুড়ে তার কন্ঠ। পাশের জানালার বয়স্ক লোকটি আড়চোখে দেখে পর্দা নামায়। রাতভর কেবল অ্যাম্বুলেন্স শুনি আমরা।
নিশ্চয় এই সংকট কাটবে। অমাবস্যা কেটে পূর্ণিমার আলোয় ফের ভাসবে বসন্ত-উঠোন। গোল হয়ে ছাঁদে, আবার গাইবে মানুষ জাগানিয়া গান। ফের হুল্লোড় বাঁধবে, তর্কবিতর্কে, গল্প-পদ্যে ফের নাচবে মানুষ বৃত্তাকারে। কল্যানে, মঙ্গলে, আবার জাগবে মন, জারুলের বন।
তবুও বলি- আজ আমাদের উৎসব, বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। বোশেখ, বসন্ত, ঈদ, দূর্গাপূজা- সবেরই অহিংস রীতি আছে; ধর্ম বর্ণ পাহাড় সমতলে- সর্বত্রই সাম্য আছে। সর্ব-আচরণে ও প্রকরণে মঙ্গল নীহিত। উৎসবের রঙ-রূপ-রস- সবই কল্যানকর।
এমন কালো মেঘে ঢাকা দিনেও আমরা সর্বশক্তি নিয়ে গাইবো সেই কালজয়ী কল্যাণবাণী- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। এ তো শুধু গান নয়; ভেঙে পড়া মানুষের ফের জাগবার ধ্বনি, অমোঘ শক্তি। এ গান বাঙালির চেতনায়, প্রাণে ও বোধে, প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যায়, দাঁড়াতে বলে। তাই তো শত সংকট পেরিয়ে, বারবার সম্ভাবনায় জাগে বাঙালি- আত্ম-পরিচয়ে, সম্মানে, সাম্যতায়।
যে স্বজনরা চলে গেছে, হেরে গেছে রোগ-শোক যুদ্ধে; তাদের স্মরণে বরণে আমরা অজেয় রঙ ছড়াবো এবার শোকব্যাধি জয়ের। হারবো না। পরাজয় মানবো না। বুকসমান কষ্ট নিয়েই ভালবাসা বিলাবো ঘরে ঘরে, দুরে কাছে, সর্বতমঙ্গলে।
যে শিশু ঘরবন্দি বহুদিন; যে শ্রমিক গায়ের ঘামে কারখানার চাকায় বোনে না উৎপাদনের গল্প, সামান্য সবজি নিয়ে যে মানুষ পথের পাশে বহুদিন মেলে না পসরা; যে বৃদ্ধ ভোরের আলোয় খুকখুক কাশে না, মাঝরাতে রিকসার টুংটাং ধ্বনি কেড়ে নেয় যে অ্যাম্বুলেন্স চালক; যে প্রেমিক বহুদিন ফুলহাতে নিবেদন করে না প্রেমঅঞ্জলি, যে মিছিলে বহুদিন জ্বলে না আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া-
আমি তোমাদের বলছি- সুদিন ফিরবে, ফিরবে, ফিরবে নিশ্চয়। শুভ নববর্ষ।
প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক, লেখক
ঢাকা, বাংলাদেশ।