গল্পটি শুরু করছি।
আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাটক করেছি। মঞ্চে অভিনয় করেছি নিশ্চিন্তে। আমাদের নাটকের বক্তব্য ছিল ধারালো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আমাদের নাটক দেখে অনেকেই বলেছে, ‘নাটক করতে গিয়ে শহীদ হয়ে যাবেন না যেন। ‘
একবার তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে মঞ্চ বানিয়ে ‘এই দেশে এই বেশে’ নাটক করার আমন্ত্রণ এলো। তখন জামাত বেশ সক্রিয়। আমাদের নাটকটি ছিল ওই যুদ্ধাপরাধীদের চক্ষুশূল। নাটক শুরুর আগে থেকেই কানাঘুষা শুনছিলাম। আমাদের নাটক করতে দিবে না। কিন্তু আমাদের থামায় সেই শক্তি কার আছে? আমরা ঠিকই সন্ধ্যায় মেক আপ নিয়ে হাজির। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছিলো, আমার আর শাহীনের মুখ তত শুকিয়ে যাচ্ছিলো। ততক্ষণে আমাদের কাছে খবর চলে এসেছে যে জামাতীরা নাটক শুরু হলে মঞ্চে বোমা মারবে। আমার আর শাহীনের ভয় তো আরো বেড়ে গেল। সোলায়মান ভাই বললেন, ‘শো মাস্ট গো অন’।
আমাদের যা প্রস্তুতি নেয়া দরকার নাদের সব ঠিক করলো। মঞ্চের বা দিকে ছিল দেয়াল আর ঠিক দেয়ালের পাশেই বড়ো রাস্তা। নাদের কয়েকজন ছেলেকে ওখানে পাহারায় বসাল। নাটকে আমি আর শাহীন নানা-নাতির অভিনয় করতাম মূল মঞ্চের বাইরে ছোট্ট একটি এক্সটেনশন ব্লকে। ওটা একদম ওই দেয়ালের পাশে। আমরা হিসাব কষলাম যে বোমা যদি ছুড়ে মারে তবে ওটা প্রথমে আমাদের উপরই পড়বে। এবার মুখ চুপসে গেল। সোলায়মান ভাই ডেকে বললো, ‘চোখ-কান খোলা রেখে ডায়লগ বলবা। আর যতটা পারো স্টেজের ভিতরে থাইকো। ‘
আমরা শো করলাম। সারাক্ষণ বোমার ভয় নিয়ে মঞ্চে থাকলাম। আর শো শেষে নিজেদের বেশ ‘বীর’ মনে হচ্ছিলো।
কিন্তু এখন যে অভিনেত্রীর গল্প বলবো তাঁর ঘটনা শুনে নিজেরদের সেই ‘স্বঘোষিত বীরত্বের’ কথা মনে করে লজ্জা লাগছিলো। আমরা অভিনয় করেছিলাম স্বাধীন দেশে। যুদ্ধের ময়দানে নয়। পাকিস্তানী বাহিনীর কড়া নজর এড়িয়ে আমরা অভিনয় করিনি। কিন্তু সেই অভিনেত্রী নিখুঁত মেকআপ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে, পাকিস্তানী আর্মির ক্যাম্পের ভিতরে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিনয় করেছে। শুধু মাত্র তাঁর দেশের জন্য।
আমি একজন বীর প্রতীকের কথা বলছি।
আমি একজন সাহসী মহিলার কথা বলছি।
আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলছি।
আমি তারামন বিবির কথা বলছি।
মাত্র চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে। পুকুরে শাপলা ফুল তুলছিলো। রান্না করে খাবে। এক মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মুহিত মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মা তুমি কি করো?’
তারপর মেয়েটির নতুন জীবনের গল্প শুরু হলো।
মেয়েটির মা গ্রামে থাকে। এই কাঁচা বয়সের মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করতে পাঠালে – গ্রামের লোক কি বলবে? আর মেয়েটিকে কি কেউ বিয়ে করবে?
দরিদ্র মা তো এই কথাই ভাববে। গ্রামের মেয়েদের বিয়ে ছাড়া কি আর ভাগ্যে কিছু আছে?
মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মুহিত তার সন্তানকে রেখে যুদ্ধে এসেছে। তার কি তখন সেই সন্তানের কথা মনে হয়েছিলো? নাকি দেশের জন্য এক অজানা টানে এই অজ-পাড়াগাঁয়ের চোদ্দ বছরের মেয়েকে সন্তান হিসাবে বুকে টেনে নেয়? দেশের জন্য এ কোন ভালোবাসা মুহিতের বুকে সাদা বরফের মতো জমে উঠলো?
তারামনের দরিদ্র মা তার মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিয়ে দিলেন। তারামনের নতুন থাকার জায়গা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে এই কিশোরী তারামন এক্কা -দোক্কা না খেলে রান্না করেছে ক্যাম্পের সব মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য। পরিষ্কার করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র। কিন্তু তারামন যে দেশের জন্য এর চেয়ে ও বেশি কিছু করতে চায়। ওর বাবা মুহিত মেয়েকে হাত ধরে শিখালো রাইফেল আর মেশিনগান চালানোর কায়দা। তারামন ভীষণ চৌকস মেয়ে। হাবিলদার মুহিত ভাবলো এই মেয়েকে দিয়ে গুপ্তচরের কাজ করলে কেমন হয়। মেয়েকে বলতেই মেয়ে রাজি। কিন্তু এই কাজে অনেক ঝুঁকি। পাকিস্তানী ক্যাম্পে কড়া পাহাড়া। ধরা পড়লে শুধু কি প্রাণ যাবে? মেরে ফেলার আগে এই চোদ্দ বছরের মেয়েটিকে ছিঁড়ে খাবে। হাবিলদার মুহিত সব জানে। তারপরও দেশের জন্য বাবা-মা সন্তানদের এই ভাবে উৎসর্গ করে। তারামন বিবি বাবার কথায় রাজি হয়। সাঁতার কেটে নদী পাড় হয়। তারপর গায়ের জামা বদলে ছিঁড়া শাড়ি পড়ে। মুখে কালী মাখে। মাথার বড় বড় চুল মুখের সামনে দিয়ে এলোমেলো করে দেয়। তারপরও তারামনের মনে ভয় জাগে। ওর মেকআপ কি সত্যিই পাগলীর মতো হয়েছে? গায়ে একটু মাটি মাখালে কেমন হয়? তারামন গায়ে মাটি মাখে, শাড়িতে গোবর মাখে। এবার ওকে ঠিকই পাগলীর মতো মনে হয়। বুকে সাহস নিয়ে ও পাকিস্তানী মিলিটারির ক্যাম্পের দিকে ধীরে ধীরে যায়।
মিলিটারিদের ক্যাম্প দূর থেকে দেখে ওর কি হঠাৎ ভয় লেগেছিল ? হাতে তো আর আয়না নেই। বুঝবে কি করে যে ওর মেকআপ কত নিখুঁত হয়েছে? ও জানে ধরা পড়লে ওই পশুগুলো ওকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। তারামন একটু ভাবলো। তারপর জগতের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর মতো মেকআপ মাখালো। যেন কেউ, কোনো ভাবেই ওর আসল পরিচয় বুঝতে না পারে। তারামন নির্দ্বিধায় মানুষের মল নিজের চুলে মেখে ক্যাম্পের দিকে হাটা শুরু করলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের জানা দরকার ওই মিলিটারী ক্যাম্পে কোথায় কি কি আছে ? কোথায় এল এম জি, কোথায় অস্ত্র – ওদের সব জানা দরকার। তারামনের চোখ তখন শকুনের মতো তীক্ষ্ন হয়ে উঠে। পাগলী তারামন ক্যাম্পের ভিতরে গড়িয়ে, ‘হাপুর পেড়ে’ ঢুকে। চারিদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মনে মনে হিসাব কষে নেয়। হঠাৎ মিলিটারি ওকে আটকায়। ও কথা বলে না। পাগলী আবার কি কথা বলবে? তারামনের গায়ের দুর্গন্ধে কেউ কাছে আছে না। হয়তো একজন মিলিটারি জোরে ধমক দেয়, ‘এই লাড়কী। ‘
তারামনের ভিতরটি কেঁপে উঠে। ওরা কি ওর অভিনয় বুঝে ফেললো ?
তারামন কথা বলে না। হঠাৎ জোড়ে চিৎকার করে হেসে উঠে, ‘হি হি হি হি। ‘
একজন বলে, ‘হেই খালি পাগল হয় , কথা নাহি বলে। ‘
ওরা তারামনকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেয়। আর তারামন ‘হাপড়া পাইরা পাইরা , উপুড় হইয়া, গৌড় পাইরা পাইরা ‘ ক্যাম্প থেকে বেড় হয়ে নদীর পাড়ে যায়। পাগলীর কাপড় বদলে নদী সাঁতার কেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে বলে দেয় সবকিছু।
– এই খানে এল এম জি , এইখানে মটর , এইখানে ট্যাংক।
মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। আর তারামন বিবি ততক্ষণ রান্না আর অস্ত্র পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছে।
শুধু গুপ্তচরের কাজ আর রান্না করে তারামন খুশী ছিল না। সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্ত্র হাতে সারাদিন লড়াই করেছে।
যুদ্ধের পর পালক বাবা আর মায়ের সাথে এক বছর ছিলেন ভিন্ন গ্রামে। তারপর একদিন নিজ গ্রামে চলে যায়। বিয়ে হয় সংসার করে। কিন্তু জানতে পারেনি তার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবের কথা। চব্বিশ বছর পর ১৯৯৫ এ এক গবেষক তাঁকে খুঁজে বেড় করেন। তারপর এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের ‘বীর প্রতীক’ খেতাব তুলে দেয়া হয়।
এ বছরের বিজয়ের মাসে তারামন বিবি এই দেশটি আমাদের হাতে জমা রেখে চলে গেছেন। আর বলে গেছেন , ‘এই দ্যাশ টা ভাইসা আসে নাই। ‘
এই গল্পগুলো আমরা অনেকদিন জানিনি। যেমন জানি না যুদ্ধের আরও কত গল্প। আজ তারামন বিবির গল্প জানলাম। তারামন বিবি কখনো জানলো না যে তাঁর বীরত্বের গল্প প্রশান্ত পাড়ের ছোট্ট একটি শহরে এই প্রজন্মের তের বছরের ছোট্ট একটি মেয়েকে কি ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখলো সারাদিন। ঋষিতা ইন্টারনেট ঘেঁটে তারামন বিবির গল্প লিখেছে। আগামী ১৫ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আমরা ‘লীভ মি এলোন’ নাটকটি উৎসর্গ করবো এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে। আপনিও আমাদের স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। নাটক শুরু হবে ঠিক রাত আটটায়। ওয়ালী পার্কের হরাইজন থিয়েটারে। আর এই প্রজন্মের একজন হয়ে ঋষিতা বলবে তারামন বিবির গল্প।
আমি অনুমান করি ঐ দিন এই বীরত্ব-গাঁথা ঋষিতার চোখ আর মনকে শাণিত করবে। শ্রদ্ধায় নমিত হবে । আর আমরা সেই বীরত্বের গল্প শুনে জোড় গলায় চিৎকার করে বলব –
এ দেশ কারো উপহার নয়
দেশটা কারো দয়ায় নয়
হঠাৎ অলৌকিক শক্তিতেও নয়
এ আমাদের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা।
টিকেট : https://trendyideas.com.au/pro
জন মার্টিন
অভিনেতা, নাট্যকার,
নির্দেশক, মনোবিজ্ঞানী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
ডিসেম্বর ২০১৮।