রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা জানার ইচ্ছে জাগে প্রায়ই। এটা আমি নিশ্চিত বাংলা বাঙালির জীবন যতোদিন ততোদিন রবীন্দ্রনাথ আছেন। অখন্ড ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী বাঙালি কবি আর কিছু না হোক কেবল গানের ভেতরেই বেঁচে যাবেন। তাঁর মতো সৃষ্টিশীল অপার মানুষের বেলায়ও আমরা নির্মম। আমাদের সমাজ ও রাজনীতি কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনিবার্য হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ আজ নতুন প্রজন্মের চোখে কি আসলেই ততোটা আপন?
করোনার ঠিক আগে ওপার বাংলায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। হয়তো আপনাদের অনেকের তা মনে আছে। উদ্ভট এক পাগল লোক সামাজিক মিডিয়ায় যা তা লিখে জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তা বাস্তবে ভূয়া। অসম্পাদিত একটি খোলা ডিজিটাল পাতা কোনকালেও মিডিয়া হতে পারে না। যেখানে এখন লিখে তখন মুছে দেয়া সম্ভব বা গালাগাল থেকে সালাম দেয়া সব জায়েজ সেটা কি করে মিডিয়া হয়? ঐ লোকটার নাম বোধকরি রোদ্দুর রায়। সে দিন দুজনে দুলেছিনু বনে ও চাঁদ উঠেছিল গগণে এই জনপ্রিয় প্রেমময় পংক্তিগুলোকে লোকটি সস্তা গালি আর বাংলা অসভ্য শব্দে লিখে তুলে দিলো তারুণ্যের হাতে। আর আশ্চর্যের বিষয় এই ছেলেদের চাইতে আগে তার শিকার হলো তরুণীরা। ভিডিওতে দেখা অশ্রাব্য সে প্যারোডি অসুস্থ হবার জন্য যথেষ্ট। পরে তারা মাফ চেয়ে পার পেলেও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ওপে দিয়ে বয়ে গেছে কলংকের কালো রেখা। আগেও বলেছি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর চারপাশে এখন অবাঙালির ভীড়। তারা কোন ঠাকুরকে চেনে না। আর এক ড্রাইভার আমাকে খুব গর্বের সাথে বলেছিল রবীন্দ্রনাথের একটা মেয়ে জীবিত আছেন। আমার তো চোখ কপালে। নাম কি? এই প্রশ্নের উত্তরে জেনেছিলাম সাইফ আলী খানের মা।
এদিকের অবস্থাও সুখকর না। এদের মানে আমাদের আগামী প্রজন্মের কানে বিষ ঢালার কাজ শেষ। সম্প্রতি যেটা ভয়ংকর ভাবে ঢুকেছে সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার আষাঢ়ে গল্প। একে অমুসলিম তায় আবার ওপার বাংলার মানুষ কাজেই রাগ হতে পারে। কী ভয়ংকর কথা তিনি না কি চাননি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক ! অথচ এই প্রজন্মকে কেউ বলে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম সবচেয়ে বড় জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধণা দেয়া হয় রবীন্দ্রনাথকে। আর তিনি এসেছিলেন আনন্দের সাথে তা গ্রহণ করতে। আরো একটা বিষয় এই যে সন তারিখ দিয়ে তাঁর নামে মিথ্যাচার করা হয় তখন কবি ছিলেন শয্যাশায়ী। শান্তিনিকেতন থেকে উড়ে আসলেও যা অসম্ভব সেটাই সত্য বলে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামকে স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। এই ধুমকেতুকে বই উৎসর্গ করেছিলেন অবলীলায়। আর নজরুল ছিলেন নিতান্ত বালক বয়সী। পরে কবির মৃত্যুর পর নজরুল লিখলেন অসাধারণ এক এলিজি। রবিহারা নামের সেই কবিতা বলে দেয় নজরুল কতোটা আপন মনে করতেন তাঁকে। অথচ এই সম্পর্কও পরিবেশন করা হয় বিষের গ্লাসে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে অপরিহার্য। সময় তাঁকে জন্ম দিয়েছিল আমাদের মানুষ করার জন্য। দু:খ করে কবি লিখেছিলেন, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। অথচ সারাজীবন তাঁর সাধনাই ছিলো বাঙালিকে বড় করে তোলা। আজ যখন এই দুনিয়া অশান্ত মারী, মহামারী, যুদ্ধ এসব নিয়ে ক্লান্ত তখন যে কোন বিবেকবান মানুষের আশ্রয় তিনি। এতো বহুমুখী একজন লেখক কবি গীতিকার নাট্যকার সব মিলিয়ে প্রকৃত সব্যসাচী ইতিহাসে বিরল। আমরা ভুলে যাই শান্ত ঋষিতুল্য রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে শান্তি খুঁজতে আসতেন স্বয়ং গান্ধীজী। নেহেরু তাঁর একমাত্র সন্তান ভারতের লৌহমানবী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধাত্রী মাতা ইন্দিরা গান্ধীকে পাঠিয়েছিলেন শান্তি নিকেতনে। যাতে মাটির কাছে থেকে মাটির মতো সহিষ্ণুতা আর শক্তি অর্জন করতে পারে। পেরেছিলেন বলেই পাকিস্তানীদের হারাতে পেরেছিলেন ইন্দিরা। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদের কতোটা ভালোবাসতেন সেটা নেতাজী সুভাষ বোস বা শ্রী অরবিন্দের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। তিনিই একমাত্র বাঙালি যাঁর সবটাই আন্তর্জাতিক আবার হৃদয় বাঙালির।
এখন পর্যন্ত কোন কিছুতেই তাঁকে না ডিঙাতে পেরেছেন কেউ না সমান হতে। বিস্ময় জাগে গানে কবিতায় ছবিতে সবকিছু মিলিয়ে কী আধুনিক তিনি। অকারণ বিরোধিতার ভেতর আমাদের শক্তির অপচয় ছাড়া আর কিছু নাই। তারুণ্য যতো তাঁর দিকে ধাবিত হবে ততো জানবে জীবনে একজন মানুষ কতোটা বেদনা আর দু:খ সহ্য করার পরও হয়ে উঠতে পারে সবার সেরা। মৃত্যুকে ভয় পেতেন। আবার তাকে আলিঙ্গনেও বাধা ছিলো না মনে। যখন তিনি লেখেন,
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ
আপনার পানে চাই।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
হে পূর্ণ তব চরণের কাছে
যাহা কিছু সব আছে, আছে, আছে,
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই,
নিশিদিন কাঁদি তাই।
এই আমাদের কবিগুরু। যিনি জন্ম থেকে মৃত্যু সবকিছুতে আমাদের পথের দিশারি। অন্তরের সাহস। আত্মার শক্তি।
বাইশে শ্রাবণে প্রণাম রবীন্দ্রনাথ।
সিডনি, ৫/৮/২১।
অজয় দাশগুপ্ত
ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
অস্ট্রেলিয়া।