একগুচ্ছ কবিতা । শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়

  
    

 

প্রেম

যে হাসির কণা হাওয়ায় হাওয়ায়
উড়িয়েছিল সে নিত্য
আজ তারা ভারী
হয়ে নেমে আসে
সকরুণ স্নেহে বসে তার পাশে
যে জলের ফোঁটা ব্যথা করা চোখে
ঘনিয়েছে উদ্বৃত্ত

যে নদীর ঘাটে সিঁড়ি নেমে যায়
যে শহর বাঁকে পুরোনো কথায়
প্রেমে পড়েছিল নতুন বয়স
ঘুরে গিয়েছিল ট্রাম
সেই ট্রাম আজও ফেরে মাঝরাতে
কথা দেওয়া ছিল ভীরু কাঁপা হাতে
বাইরে গহন তুমুল অঝোর
বৃষ্টি অবিশ্রাম।

 

ছায়া

সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে
লেপটে আছে পায়ে
নিয়নের আলো মেখে কালো হয়ে আছে
ভেঙে আছে নুয়ে আসা শরীরের পাশে

সব কিছু জানে ও
খররোদ আর অকাল বৃষ্টিপাত
ঘনঘোর নিঃশ্বাস, চড়াই উতরাই
কোন কাঁধে মাথা রেখে বিস্রস্ত আলাপ
কোন প্রত্যাখ্যান শেষে আজানের সুর
কোন খাদে গলা নামে নিষাদে আমার

প্রতিদিন প্রতি পল আবহমান
থেকে গেছে পাশে পাশে

সে আমারই ছায়া

কোলাহল শেষে
তার কাছে নতজানু আমি
তাকে হারাতে ভয় হয়
আজ অন্ধকারে যেতে বড় ভয় হয়।

নকশি কথা 

তুমি আমায় নুড়ি দিয়েছ, দিয়েছ জল ও ঝর্ণা
আর দিয়েছ নক্ষত্রলোকের বিস্ময়
শুনিয়েছ কর্ণের কবচকুণ্ডল আর
অর্জুনের গাণ্ডীবের  কথা
দিয়েছ সুখ-দুঃখ রাগ-বিরাগের নকশিকাঁথা
আর বারো মাসে তেরো পার্বণ স্মৃতি
গেঁথেছো প্রাণে পড়ন্ত  বিকেল, আজানের সুর।

দিয়েছ অন্তরালে চোখ মোছার টুকরো কাপড়খানি
কুরুশ কাঁটা, চকমকি পাথর আর দিগন্তে লীন মেঘ
নতজানু হওয়ার বীক্ষা দিয়েছ, আর দিয়েছ
বোঝা না বোঝার কড়ি ও কোমল রেখা।

তুমি অধিষ্ঠানের মাধুরি দিয়েছ
আর দিয়েছ ঝড়ের জানালা
ঘুমের ভিতর জেগে থাকে শোণিত মাটির পুতুল
হাত রেখে তার শিয়রে জাগে বর্ণমালা।

 

ছায়াপথ

কে যায় নিশির ডাকে
পঞ্চমীর নাগ পায়ে পায়ে
মাথার ওপর পান্ডুর চাঁদ
জোনাকিরা অন্ধ হয়ে ফেরে
কে মানুষ যায় নিশির ডাকে?

প্রান্তর পার হয়ে পৃথিবীর শেষ
সেইখানে থামে।
ঊর্দ্ধমুখ, কুঞ্চিত জঠর, প্রসারিত দুই হাতে
নক্ষত্রপুঞ্জের শ্বেত লাভা স্রোত নামে
ভেসে যায় তরঙ্গ মানুষ
মিশে যায় বনজোৎস্নাতে
ছায়াপথ ঘন হয় তারা ভরা রাতে।

পরদিন আলো ফোটে
বিছানায় ঘুম ভেঙে ওঠে
মানুষের বাকি সঞ্চয়।
ঘরে কিছু হাটে কিছু কেনাবেচা হয়
নেভে আলো,
দিন শেষে
জোনাকিরা আসে,
মনে মনে সেই ডাক অপেক্ষায় থাকে
সেই থেকে সব গ্রামে গ্রামে নিশি ডাকে।

 

বন্ধু

তুমি যে কথা বলতে পারোনি
সেটা যে শুনে নিল
সে বাতাসে ভর করে তোমার বাড়ি আসে
সে তোমার বন্ধু
তুমি সকালে চোখ মেলে দেখ
তোমার বাগানে অনেক ফুল
মৃদু হেসে রহস্য গোপন করছে
চোখের ইশারায়

কোলাহল, আস্ফালনে
যখন সম্পর্কমোচন হয়
ঝরে যায় বিশ্বাস
রিক্ত শাখায় যে বুলবুলিটি বসে
সে তোমার অন্তরের অন্তঃস্থল দেখতে পায়
সে তোমার বন্ধু
তার গানে তোমার অন্তর কাঁপে
যেন পদ্মপাতায় একফোঁটা জলে
সূর্যের প্রতিচ্ছবি

ব্যথা জমে পাহাড় হয়
বন্ধু পাহাড় ভেঙে উঠে
তোমার মৌনতায় হাত রাখে
তুমি অন্তঃসলিলা হও
সে কান পেতে শোনে স্রোতধ্বনি
তোমার হাসি ছড়িয়ে যায়
পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে

তুমি মনে মনে বলো
বাতাস, গাছ, পাহাড়, নদী
তোমরা আমার বন্ধুকে  ভালবেসো।
তোমরা আমার বন্ধুকে  ভাল রেখো।।

শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাণ্ডে বিজ্ঞানের ছাত্রী- পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। পেশাজীবিতায় বিজ্ঞান, কিন্তু সঙ্গীত তার সামগ্রিক নিমগ্নতার সিদ্ধভূমি। সুবিনয় রায়-এর সফল ও একনিষ্ঠ ছাত্রী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গানে নিজেকে নিত্য মোতায়েন করে রাখেন; সঙ্গীতে প্রাণ ফোটানোর ভিতরানা ষোল আনা জানা থাকলেও বাজার সংস্কৃতির নাকাল দৌড়ে নিজেকে যোগ্য করে তোলার বাহিরানা বরাবর তাঁর নাগালের বাইরে। ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্য একটি গানের অ্যালবাম- প্রবাসী পাখি’র পর আর  কোন গানের প্রকাশনার দিকে যাননি- যদিও গান ও কবিতার চর্চা কখনোই থেমে থাকেনি।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়  পরিসংখ্যানবিদ হিসাবে কাজ করেন, থাকেন ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মানিক বৈরাগী
মানিক বৈরাগী
10 months ago

৫টি কবিতাই অন্যরকম স্বাদ,অসাধারণ