
ভুবন গুরু
ঘড়ির মিনিটের কাঁটা ঘন্টার কাঁটাকে ছোঁয়, ঘন্টার কাঁটা মিনিটের কাঁটাকে স্পর্শ করেই সময় মাপার বাটকারা হয়।
মর্মের বাগানে গুরু একা মুরশিদ হয় না; ভুবন অর্থে তাতে অদল-বদল লাগে। গুরু যদি শিষ্য না হয় সেই গুরু সরকারি আমলার সামিল – তাতে ভরসার মধু মেলে না।
মানুষ সবচেয়ে বড় জ্ঞানী যখন সে অজ্ঞানী; একজন তখনই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক যখন তিনি সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র।
প্রকৃতির ভিতরে ও বাইরে ধ্যান,জ্ঞান, আর যত্নের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে মানুষকে একতরফাভাবে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণি আশরাফুল মাখলুকাত বলার কারণে।
নুহের প্লাবনের ভয়াল দুর্যোগকালে দেখি- বন্যার কবলে পড়ে মা নিজের সন্তানকে পায়ের নিচে ফেলে নিজে শ্বাস নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে; কিন্তু সামান্য পিঁপড়াদের দেখুন: বানের সময় পিঁপড়ার দল সহমর্মিতার নিরিখে নিজেরা জড়াজড়ি করে বাণ্ডিলের মতো হয়ে পানির উপর ভাসতেভাসতে যায়- পালা করে পিঁপড়ারা বাণ্ডিলের ভিতরবাহির করে যাতে শ্বাস নিয়ে দুঃসময়ে সবাই বেঁচে থাকতে পারে!
এক্ষেত্রে পিঁপড়া গুরু, মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করুক।
যে-তারা আকাশ থেকে খসে পড়ে সে একমুহূর্তের জন্যও তার উজ্জ্বলতা মলিন হতে দেয় না- মানুষ তো তার মৃত্যুকে বিমর্ষতা দিয়ে মোকাবেলা করে!
খসেপড়া নক্ষত্র- শিক্ষক আমার, তুমি আমাকে উজ্জ্বলতায় দীক্ষা দাও!
বড় অধিকার
হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মুখ এমন এক তীব্রতা নিয়ে আমাদের জীবনধারায় ফিরে আসে যে মনে হয়, সে প্রথম দিনের শিশুর অধিকারে, ভঙ্গুরতায় আমাদের অস্তিত্বে ভ্রূণ হয়ে জন্ম নিতে থাকে।
ফলে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের ধস ও রূপকথায় পুরুষ গর্ভবতী হয়, তার গর্ভে একটি শিশু প্রতিদিন বড় হতে থাকে।
নারীর জন্য তার অভিঘাত হয় উল্টো- তার কাছে মনে হয়, এ এমন এক আঘাত ও শূন্যতা যে তা’ গর্ভাবস্থার ভ্রূণ ভেঙে আলোর মধ্যে অদেখায় আঁধারের ভিতর আরো তমসায় ভেঙেভেঙে খসে পড়ে।
ফলে একান্ত প্রিয়জন হারানোর শোকে পুরুষ গর্ভবতী হয়, আর নারী হয় ভ্রূণ ভেঙে রক্তক্ষরণের হাহাকার!
মৈজুদ্দিন ও আজরাইল ফেরেশতা
মৈজুদ্দিন দৌড়ের উপর থাকে, যেমন আঙ্গুলের উপরে নখ, তেঁতুল গাছের মগডালে ভূত, নর্তকীর চোখের সামনে ইশারা, সাপের মাথার ফণার শীর্ষে মনি, তেমনি ডুক্কুডুক্কু মনগুডা – মৈজুদ্দিনের জন্মকর্ম জোয়ারভাটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে সত্য- দৌড়।
রীতিমত চার চারটা গ্রামের বড়, মাঝারি গৃহস্থ বাড়ির কর্তা,বৌঝিদের ফুটফরমাশ সবই মৈজুদ্দিনকে সামলাতে হয়; অমুকের বাড়ির নাকউঁচা মেয়েটির বিয়ে হয়েছে-সাত গেরাম পরে বরের বাড়িতে পিঠা নিয়ে যেতে হবে, ১০৩ বছরের বুড়ি হাঁটতে পারে না, মৈজুদ্দিনকে হাঁকাও সে বুড়িকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, নসরুল্লাহ মিয়ার দক্ষিণী পালানে যে ধান কাটার জন্য এতোগুলি মুনিষ নামানো হয়েছে তাদের দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাবে কে- আবার জিগায়- মৈজুদ্দিন! শারমিন ঢেকুর দিয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে- তার যে এখন অন্তর্বাস লাগবে শারমিনের মা ওই চার গ্রামে কাকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করে হাট থেকে অন্তর্বাস আনার জন্য বলতে পারে- ওই আবারো মৈজুদ্দিন!
এই সে মৈজুদ্দিন- তার এমনতো কখনো হয় না- তিনসন্ধ্যার মুখে দৌড়ের মধ্যেই আজ কৈলাগ গোরস্থানের কাছে নারকেল গাছের গোড়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গোত্তা খেয়ে বসে পড়ে! চিরদিনের স্বভাবে মৈজুদ্দিন মোচড় দিয়ে জেগে উঠে যেইনা আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করবে তখনই সে পাভাঙা কুকুরের মতো কেমন লেঙচিয়ে ওঠে, আর মনে হয় তার শরীরে কে যেন পেরেক ঠুকে দিয়েছে!
তাজ্জব ব্যাপার, এখনো তার কতো জায়গার কাজ সামলানো বাকি!
কেডায় তুমি, আমার উপর হামলাইয়া পড়ো, পথ ছাড়ো!
আমি আজরাইল!
আজরাইল হও, আর সাদ্দাম হোসেন হও- এখন ভাগো। পরে আইসো। কত মানুষের কতো কাম আমার হাতে পইড়া আছে, অহন ফুটো, পরে আইসো।
আমি জান বিনাশ করি।
মঙ্গলবারের আগে আমার সময় হইবো না, এহন সরো মিয়া!
আমি আজরাইল, আমি সরি না। আজই তোমার খেলা শেষ।
আমারে একটু সময় দেওন যায় না! এক দৌড়ে যামু, এক দৌড়ে আসুম। আগামী মঙ্গলবার ঠিক এইখানে, কথা দিই।
মানুষ সারাজীবনের লাগি চইলা গেলে তার আত্মীয় স্বজনরা কান্নাকাটি করে। আমি পুরাজনম এমন দৌড়ের উপর ছিলাম যে সয়সন্তান কিচ্ছু লইবার পারি নাই।
একটু সময় দেও ভাই, দেখি, নিজের লাগি নিজেই একফোঁটা চোখের পানি ফেলতে যদি পারি!
ন হন্যতে হন্যমানে
কৈ মাছ চাষাভুষা লোক- খানদানির কোন ব্যাপারই নেই তার মধ্যে: শক্তপোক্ত শরীর- পেটানো কাঠামো, গায়গতরে জেল্লার নামগন্ধ নেই, পুরো চামড়া খসখসে, সারা গায়ে কালশিটে দাগ, ঘষায়-বসায় রুক্ষসুক্ষ রুখ; অন্য পাড়ে মান্যবর ইলিশের ইস্ত্রিকরা মোলায়েম দেহবল্লরী, রীতিমত সুগন্ধিমাখা সাহেবসুবা লমলমা ইংরাজের বাচ্চা! অল্পেই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন, সল্পেই গা ছেড়ে দেন।
কৈ মাছ কামলা কামিন নামহীন গোত্রহীন প্রান্তিক অন্ত্যজ মানুষ- ডৌল নকশার ধার ধারে না, বর্ষার প্রথম নিনাদে ইলিশ যখন পারিষদবেষ্টিত ব্যূহের অন্তরালে ভীত,পাগলপারা কৈ মাছ সঙ্গীর খোঁজে কানকো বেয়ে উজানের দিকে ছোটে: সঙ্গীর বদলে তার জন্য উজানে অপেক্ষা করে কোঁচের তীক্ষ্ণ ফলা, কোঁচের ফলাকে কৈ মাছ ভাবে শ্রাবণ দিনের প্রথম কদমফুল!
কৈ মাছ নিজেই নিজের পক্ষ ও প্রতিপক্ষে হাজির, নিজেকে আহত করে, আর শুশ্রূষায় ছটফটানি বাড়ায়, বাতাসের সঙ্গে আয়ুর হিস্যার দেনদরবারে নিদারুণ তৎপর, নিজেই নিজের কবর খনন করে, কানকোর রক্তে তিলক পরে নিজের মৃতদেহ সজ্জিত করে তোলে!
আগামী বর্ষায় সে আবার অন্তর্গত উল্লাসে প্রেম ও মৃত্যুর অঙ্গুরি পরিতে উজান পন্থে আসিবে- বাদল দিনের প্রথম কদমফুল ফুটিলে আসিবে, না ফুটিলেও আসিবে- ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে!
সুফী ও একজন প্রজাপতি
দুঃখকে, বিচ্ছেদকে, প্রতীক্ষাকে যে উৎসবে পরিণত করতে পারে, সে-ই সুফী।
একজন সুফী ও একজন প্রজাপতি সহোদর ভাই। অজানা একটি বিন্দু- বোধ করি তার নাম জীবন- যে বিন্দু ঘটমান, চলমান, দৃশ্যমান দৃশ্যপরিধি থেকে দূরে অবস্থিতি করে; সেই বিন্দুটিতে স্পর্শের, নিমজ্জনের আলোকোদ্ভাসিত সমাপ্তির দুর্ভাগ্যে অবগাহন করাই তার একমাত্র বাসনা।
প্রজাপতি যে ফুলের রেণু থেকে আসে সেই ফুলের রেণুতে মুখ দেবার জন্যই কেইটারপিলার থেকে একের পর এক রক্তমধু ধাপ ও অভিজ্ঞান পার হয়ে পরিপূর্ণ প্রজাপতির উজ্জীবনে রঙিন হয়ে ওঠে!
যে-ই না শ্রীশ্রী প্রজাপতি বহুবর্ণিল রঙে ঝিলমিল- মুখ বাড়িয়ে দেয় পুষ্পের রেণুর মুখে!
এভাবেই প্রজাপতি পান করে প্রথম মধু, ও দ্বিতীয় ক্ষরণ; উড়েউড়ে যায় একজন সুফী, একজন রঙিন প্রজাপতি ; উড়ে যায় একজন পিপাসা অনর্গল এক চাঁদের রঙপ্রপাতের দিকে!
প্রজাপতি- একজন সুফী জীবনপাত অন্বেষা করে একটি ঘর – একটি ডিমের খোসা, জীবনের প্রারম্ভমুহূর্তেই কেইটারপিলার যে ঘরটি খেয়ে ফেলেছিল!
স্মৃতি যাদুঘর
জীবন এক স্মৃতির মিনার, স্মৃতি ইতিহাস, স্মৃতি দর্শন- বিজ্ঞানও স্মৃতিরই কারবারী। ধর্ম স্মৃতি রোমন্থনের প্রকল্প নিয়েই হাজির হয়।
বাইবেলে দেখুন, কোরান পড়ে যান, বেদে যাত্রা করুন, কী খুঁজেপেতে দেখুন যে-কোন সংখ্যাল্প ধর্ম সম্প্রদায়ের কাহিনি ও গ্রন্থ- সবখানেই পূর্বপুরুষের স্মৃতির বয়ান; বারবার আপনাকে স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করাবার চেষ্টা-ই মূল। ঈশ্বরও একটি সমন্বিত স্মৃতির প্রতিরূপ। যাকে আমরা অভিজ্ঞতা বলি তা-ও স্মৃতির সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার এক ফলিত বিন্যাস।
প্রতিটি মানুষ একেকটি স্মৃতির মিউজিয়াম – সে নিজে সেই যাদুঘরের কিউরেটর। মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে সকল প্রাণি ও প্রকৃতির যে এক স্পর্শকাতর লেনদেন তা-ই সময়ের ব্যাধির ওপর আকনমেন্দি পাতার সহমর্মিতা বুলিয়ে দেয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, স্মৃতি বিনির্মাণের এই মহান যজ্ঞে দু’টি জিনিস সংহারকের ভূমিকায় নেমেছে :
ক. কর্তৃত্ববাদী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের নৃশংসতা
খ. মুনাফাখোর বাজার অর্থনীতির লাগামহীন বিস্তার
আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানের নামে পিতামাতার কাছ থেকে হরণ করা হয়েছে; তারা এখন আর পারিবারিক একক নয় – একেকজন সুদখোর টেকনোলোজির বিনিয়োগের ইউনিট।
সংগঠিত ধর্ম ঐক্যবদ্ধ শোরগোলে, বা হিংস্র চকচকে নাঙা খুনলিপ্সার বল্লম ও তরবারিতে বধ করতে নেমেছে সকল ক্ষমার গুণ,সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বে নির্ভরতার স্মৃতি!
তরবারির প্রতিপক্ষে খুলে ধরুন আপনার স্মৃতির রেট্রোসপেকটিভ- আলগোছে মনে পড়ে যাবে কেউ একজন অতি কাছের, কেউ একজন কিছুটা দূরের- ব্যথা নিরাময়ে কেমন বুলিয়ে দিয়েছিলো ঈষদুষ্ণ আকনমেন্দির পাতা!
ঝরোখার উপরে আয়না
হাসির গমকে, ব্যথার নিরলে তিনি ফুটে থাকেন মর্মের গোলাপ, গরুর চোখের মায়ায় বয়ে চলা এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি- আর হাতে রণতূর্য!
তিনি কথা ও সুরে ফুল ফুটানোর বীজধ্বনি, অমৃত টঙ্কার -এই এক কবি, এমন এক মানুষ সুরই যাঁর ইমান, তিনি সুরের কৃষিজীবী- নিয়ত বপন করে যান সুরের বীজ ধান – মনসাধু তার উজান ও ভাটির ব্যাপারী।
গালাগালিকে গলাগলিতে রূপান্তর ঘটানো তাঁর সর্বৈব সাধনা।
মন তাঁর গণিত ও বিজ্ঞান, মনই তাঁর ধর্ম এবং ভাষাতত্ত্ব, এই মন পাতায় মোড়া। বুকে আছে ময়না পাখির বাসা, মুখে রসালু পানপাতা। পানপাতা মাটি ও মানুষের সঙ্গে এক সম্পর্কের সুইসুতা: তাঁর বিচারে ক্বলবেতে তুলে রাখি নাম সর্বোত্তম, নমঃ নমঃ নমঃ বাঙলাদেশ মম।
তিনি কেবল গালভরা বুলি আর জাতীয় কবির রঙিন ফানুসমাত্র নন, তাঁকে বানাতে হবে আমাদের ঝরোখার উপরে আয়না- যেখানে পুরো জাতিগোষ্ঠির মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠে। খেজুর ভেবে তাঁকে নিয়ে হৈহুল্লোড় ও মাতামাতি করা হয়, কিন্তু আসলে তিনি খেজুর নন- হরতকি, প্রথম গ্রহণে তেতো ও কষাকষা – যাকে সর্বতো বরণ করতে পারলে সবকিছুই স্বাদে উত্তুঙ্গ হতে পারে।
আমাদের জাতিসত্তার এমন একটি খাঁটি বিন্যাস জরুরি যাতে কৃষ্ণ মুহাম্মদের ইচ্ছামৃত্যু ঠেকানো যায়।
দুঃখের গহনে ডুবে, বীরত্ব বিনয়ে,ক্রোধ ও কৌতুকে, সাম্য আর সৌহার্দ্যে, কোমলে-কঠিনে, ধর্মে কর্মে, সংকল্প আর প্রেমে, দেশজতা এবং আন্তর্জাতিকতায়, অহম ও নিরহঙ্কারে, তেজে আর মরমিয়ায়, নুনেতে- ভাতেতে, কল্পনায় ও মাটিতে, সিঁদুরে ও নোলকে, পাহাড়ে আর ঢালুতে, সহজতম গভীরে মুক্তির সংগ্রাম এবং চেতনাকে সমুন্নত ও কার্যকর রাখার জন্য আমাদের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল সংবিধান দরকার।
সেই সংবিধানের নাম কাজী নজরুল ইসলাম!
সীমার মাঝে অসীম
এই যে ব্যাপকদীর্ঘ আপনার একটা জীবন- তাকে খুঁজতে যান- কোথাও পাবেন না। সবখানে আছে, তাই কোথাও নির্দিষ্টভাবে নেই।
আপনার সামান্য কিছুদিনের শৈশবটুকু খু্ঁজে পেতে যান- তার সবটুকু আছে, কিছুই হারিয়ে যায় নি!
ব্যাপারটা অনেকটা এ-রকম: আপনি এখন বিশাল সমুদ্রের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন- আপনার চোখের জলের ফোঁটা যে এই সাগরে পড়েছিল খুঁজতে গেলে কোথায় আপনি তার হদিশ পাবেন, কোথাও পাবেন না!
আপনার চোখের মধ্যে যে জল তিরতির করে তার মধ্যে সাগর খুঁজুন-পাবেন। একফোঁটা চোখের জলে কী অথৈ সাগর টলমল করে!
অন্য কেউ
প্রত্যেকটি ছেলে প্রতিদিন একজন ঘুমন্ত পরীকে জাগিয়ে তোলে; প্রত্যেকটি মেয়ের একজন রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোথাও পরী নেই, রাজকুমার কবেই কালের গর্ভে হারিয়ে বিলীন।
নারী-পুরুষ বহুদিন কীভাবে একসঙ্গে থাকে? ভয়ডর, লাজলজ্জা, মানসম্মান ও আইনের অয়োময় নিগড়ের আতংকের কথা নয়, এখানে ভাবা হচ্ছে জীবন্তভাবে, মেধায় মননে কল্পনায় বাস্তবে একাকার একসঙ্গে থাকার কথা।
জীবনের জান্তব কাঠিন্যে ছেলেটি দেখে মেয়ের মধ্যে অনেকগুলো চিত্র ও চিত্রকল্প, অনেক পথ ও পথের মোড়, বহু আশা আর কল্পনা এসে জড়ো হয় : মনে হয়, এ-তো কেবল রক্তমাংসের একজন নারীমাত্র নয়; জননী না হয়েও সে বহন করে মাতৃত্বের মায়া, বোন না হয়েও নীরবে ধারণ করে ভগ্নীর মিনতি ও উদ্বেগ ; চকিতে তার মাঝে ঘনীভূত হয়ে ওঠে বুঝিবা পূর্বপুরুষের কোন একরোখা বুড়ি দাদিমা; কালিঝুলি ক্লেশ ও দুর্ভাবনার মধ্যে কোন জাদুকাঠির স্পর্শে অন্তর্বাহী ফল্গুধারার মূর্ছনায় জেগে ওঠে এক অমিতসুন্দর পরী!
মাতলা মাথায় এক যুবক, কারখানার চাকাঘোরানো তরুণ, কাজের ভারে ন্যুব্জ অফিস পাড়ার কেরানি- ঘরের নারীর কাছে উন্মোচিত করে না-থাকা হীরা জহরতের ডালি- সে ঘর্মাক্ত,নিয়ত খাদের নিচে পড়তে থাকা আটপৌরে লোকটি আর থাকে না- তার ভিতর মোচড় দিয়ে জেগে ওঠে অচেনা রাজকুমার এক!
জীবন আনন্দ আর বিষাদে এ-ভাবেই ফলবান : যার সাথে দেখা হয়- তার সঙ্গে দেখা হয় না!
কবি ও সাধক
একজন সাধক তাঁর সৃষ্টিশীল সজ্ঞার ঝলকটি গোপন করেন, কেননা তিনি ঝিনুকের মুক্তাটি নিজের ভিতরে ধারণ করে থাকেন; কিন্তু একজন কবি তাঁর সজ্ঞা কৃষকের স্বভাবে চাষ করে যান – যাতে তার ফসল গোলায় উঠতে পারে। ফলে বড় পার্থক্য হয়: সাধক গোপন করার পক্ষে, আর কবি তা প্রকাশ করেন।
সাধক তাঁর সঙ্গীত, চিত্র ও চিত্রকল্পের স্পর্শ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একটি চূড়ান্ত বাতিঘর প্রাপ্তির আশায় বাতিটি নিভিয়ে দেন; কবি একটি একটি করে তাঁর সঙ্গীত, চিত্র ও চিত্রকল্পের স্পর্শ একেকটি বাতির শিখায় জ্বালিয়ে ধরেন – তাঁর প্রকল্প সবগুলো আলো জ্বালিয়ে ফেলার পর একটি চূড়ান্ত ফলবতী তমসা বিনির্মাণ।
সাধক নিরন্তর একজন গর্ভবতী নারী; কবি একজন জননী।
অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা।