একজন মহীরুহ’র সঙ্গে – আরিফুর রহমান

  
    

কন্যা লীলাবতী মারা যাওয়ার পর তাকে বনানীতে দাফনের বন্দোবস্ত হয়েছিলো। হুমায়ূন আহমেদ শুনে রাগ করলেন। তিনি বললেন, লীলাবতী থাকবে আজিমপুরে, তার ভাই রাশেদ হুমায়ূন যেখানে সেখানে। দুই ভাইবোন একসঙ্গে খেলাধুলা করবে, হাত ধরাধরি করে হাটবে। পরে লীলাবতীকে আজিমপুরে তার ভাইয়ের কাছে সমাহিত করা হয়েছিলো।

রাত পোহালেই দেশে চলে যাবেন প্রিয় মানুষ জাফর ইকবাল স্যার ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন ম্যাডাম। প্রায় এক সপ্তাহ হলো তাঁরা সিডনি এসেছেন। আজ ওয়ালীপার্কের থিয়েটারে তাঁরা দেখলেন জন মার্টিনের মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চের নাটক ‘লিভ মি এলোন’। সেই নাটকও দেখলাম স্যার ও ম্যাডামের সঙ্গে। তারপর মিলিত হয়েছি আমাদের প্রাত্যহিক আড্ডার স্থান গ্রামীণ চটপটিতে। ফুটপাতের ওপর টেবিল চেয়ারে বসে রুবেল, ফাহাদ, নামিদ ভাই, ফয়সাল আজাদ ভাই, ফয়সাল চৌধুরী ভাই, এনাম ভাই, মাসুম ভাই, নাহিয়ান ভাই, শান্তনু দাদা সবার সঙ্গে আড্ডা ও চা পানের ফাঁকে বার বার কথা হচ্ছিল জাফর স্যার কে নিয়েই। এরই মধ্যে যোগ দেন গ্রামীণের কর্নধার আশরাফ ভাই। তার আসাতেই আমার মনে পড়ে যায় তাদের রেস্টুরেন্টের দোতলায় পার্থ প্রতিমের আঁকানো দুর্দান্ত প্রতিকৃতিটির কথা। সেই প্রতিকৃতি আর কারো নয় আমাদের সকলের প্রাণের মানুষ যাদুকরী কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের।সমস্ত দেয়াল জুড়ে ছবিটি আঁকানোর কথা আশরাফ ভাই যখন ভাবেন তখন আমাকে বলেন, আমি ভীষন ভাবে অবাক হই একজন ব্যবসায়ীর এরকম সাহিত্যিক মনোভাব পুষে রাখার গল্প জেনে।আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে সমর্থন দেই ছবিটি সত্যিই এখানে বেশ মানাবে। আশরাফ ভাইও শুরু করেন তার কর্মযোগ্য। ঐ সময় বাংলাদেশ থেকে সিডনিতে বেড়াতে আসেন খুলনা চারুকলার শিক্ষক পার্থ প্রতিম মজুমদার। শিল্পী অভাবনীয় কর্মযোগ্য শুরু করেন। তখন প্রায় প্রতিদিন শিল্পীর তুলিতে বেড়ে উঠা হুমায়ুন স্যারকে দেখতে থাকি। এভাবে টানা কয়েক সপ্তাহে শিল্পীর তুলিতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে আমাদের বাংলা সাহিত্যের মহান পুরুষ হুমায়ুন আহমেদ।

বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের প্রতিকৃতির পাশে জাফর ইকবাল দম্পতি।

আজ সেই হুমায়ুন আহমেদ স্যারের ছোট ভাই তাঁর সবচাইতে যোগ্য উত্তরসূরি সবার প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষ জাফর ইকবাল স্যার সিডনিতে অবস্থান করছেন। যিনি আমাদের বা এখনকার প্রজন্মের সবাইকে সবসময় বলে আসছেন, বাংলাদেশ কেমন হওয়া উচিত, মুক্তিযুদ্ধ কেমন ছিলো, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি করলে ছেলেমেয়েরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, রাজাকারদের আসল রুপ কেমন ইত্যাদি। স্যার অসাধারন একজন মানুষ। এমন বিনয়ী এবং সাদা মনের মানুষ আমাদের দেশে সত্যিই বিরল। আমি লেখালেখি করি বলে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, খুশি হলাম লিখে যাও।আমি তখন লজ্জায় মাথা অবনত দাঁড়িয়ে ছিলাম । কি অবাক কান্ড কি সব লিখি ! অথচ তিনি আমাকে বলছেন লিখে যাও।

লাকেম্বা সিডনিতে আমাদের ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। অধিকাংশ বাংলাদেশি এই এলাকায় পুরো রাস্তার পাশে ব্যবসা খুলে বসেছেন। এখানে আমাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয় কাউন্সিল থেকে অনুমোদন নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে ।দু’বছর ধরে পুরো রাস্তা জুড়ে আল্পনাও করা হয়। স্যার কিন্তু লাকেম্বাতে এখনও আসেননি। দেয়াল জুড়ে তাঁর ভাইয়ের বিশাল আকৃতির সেই প্রতিকৃতি না দেখে জাফর স্যার চলে যাবেন এটা যেন মানতে পারছিলাম না। আমার মনে হলো এই ছবিটা দেখে নিশ্চয়ই স্যারের ভালো লাগবে।

সিডনির নাগরিক সন্ধ্যায় আয়োজক ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সঙ্গে জাফর ইকবাল দম্পতি।

স্যারকে এ দৃশ্য দেখানোর জন্য আমাদের সালেহ জামী ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে স্যার রয়েছেন রকডেল ওল্ড টাউন স্টার কাবাবে এবং সঙ্গে আছেন শাহজালাল ইউনিভার্সিটির সাজ্জাদ ভাই। আমি সঙ্গে থাকা বন্ধু ফাহাদ আসমারকে অনুরোধ করলাম ফোন দিতে। ফাহাদ ফোন দিয়েছিলো। তাঁকে বলা হলো প্রশান্তিকা থেকে বলছি, স্যারকে একবার লাকেম্বা নিয়ে আসুন প্লিজ। তিনি রাজী হলেন, স্যারও রাজী হয়ে গেলেন।

আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো স্যার তাঁর ভাইয়ের ছবিটা দেখে কেমন করে সেই দৃশ্য দেখার। আমিও স্যারের সঙ্গে দোতলায় উঠলাম। আমি শুধু স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি তার অনুভূতি দেখব বলে। তিনি ছবিটা দেখে শুধু বললেন,’এই আমি কি দেখছি ! তোমরা এটা কি করেছো ?’ স্যার পুরো দেয়ালের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ ছলছল করছে। তিনি ইয়াসমিন ম্যাডামকে বললেন, এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হবে এবং আমাদের ছবি তুলতে বললেন। আমরাও চান্স হাত ছাড়া করলাম না। অামিও ছবি উঠে গেলাম অন্যরকম এক ইতিহাসের স্বাক্ষী হবার জন্য।
আমার তখনি মনে হতে লাগলো লীলাবতীর মতো তার প্রিয় চাচা তাঁর ভাইয়ের কাছে এসেছেন, এখনি হয়তো তাঁর হাত ধরে বলবেন, ‘বাড়ি চলেন ভাইজান’। লাকেম্বার মতো ছোট্ট একটি বাংলাদেশে আমরা হুমায়ূন আহমেদের একটি প্রতিকৃতি করে রেখেছি। প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে মানুষজন এসে কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদকে সামনে রেখে ডিনার করেন, লাঞ্চ করেন। প্রায় ৬ মাস হয়ে গেছে ছবিটার রঙ এতোটুকু বদলায়নি, আশেপাশে ময়লা লাগেনি। তাঁর ছোট ভাই লাকেম্বা এসে বড়ভাইকে দেখে গেলেন। এই ভেবে আমরা যে স্বস্তি পেয়েছি, সেটার জন্য খেটে খাওয়া প্রবাস জীবন আরও বাড়াতে এতটুকু কষ্ট হবেনা।

আগেই বলেছি লাকেম্বা আসার আগে স্যার দেখতে গিয়েছিলেন নাট্যজন জন মার্টিন নির্দেশিত মঞ্চ নাটক ‘ লিভ মি এলোন’। নাটকে প্রবাসে বেড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধার এক মেয়ের গল্প। যে মেয়েটিকে বাবা সারাজীবন বলে এসেছেন মা তাকে জন্ম দেবার সময় মারা গিয়েছেন এবং মেয়েটি সারাজীবন তা বিশ্বাস করে এসেছে। মেয়েটি এও বিশ্বাস করে এসেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। কিন্তু মেয়েটি বাবার সঙ্গে দেশে গিয়ে দেখে ভিন্ন চিত্র। সারা দেশ জুড়ে ছেয়ে গেছে রাজাকার, ধর্ম , মিথ্যা। যা তাকে বিমর্ষ করে তোলে। সে তার বাবাকে প্রশ্ন করে তার মা কিভাবে মারা গিয়েছেন? তারপর বেরিয়ে আসে নির্মম ইতিহাস।

লীভ মি এলোন নাটকের কলাকুশলীদের সঙ্গে জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক।

আমার সৌভাগ্য হয় নাটকটি স্যারের পাশে বসে দেখার। স্যার নাটকটি দেখে চোখের জল ফেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। তখন কেবলি মনে হচ্ছিল স্যার এতোটা ভালোবাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে। নাটক শেষে অভিনেত্রী মৌসুমী মার্টিনকে কাছে ডেকে বললেন, আই উইল নট লিভ ইউ এলোন। তখনও জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন ম্যাডাম চোখের জল মুচ্ছিলেন।

২৮ এপ্রিল রোববার সন্ধ্যায় জাফর ইকবাল স্যার সস্ত্রীক এসেছিলেন সিডনির এক নাগরিক সন্ধ্যায় কথা বলার জন্য। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলো শাহজালাল ইউনিভার্সিটি এলামনাই ও নতুন পত্রিকা প্রভাত ফেরী। অনুষ্ঠান পরিচালনা ও গ্রন্থনার দায়িত্বে ছিলেন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ এলামনাই বা রেমিয়ান্সের সদস্যরা। সিডনির সুধী সমাজ, লেখক, পাঠক ও ভক্তদের ভীড়ে ব্যাংকসটাউনের থিয়েটার হলটি জনাকীর্ন ছিলো। পলাশ বসাকের কন্ঠে একটি দেশাত্ববোধক গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর বিগ স্ক্রিনে হঠাৎ করেই অনুষ্ঠানের স্পন্সর প্রভাত ফেরী ও তাদের সহযোগীদের বিজ্ঞাপন শুরু হয়। এটি খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে। কাগজটির সম্পাদক প্রায় দীর্ঘ একটি বক্তব্য দেবার পরেও মঞ্চে একে একে তাদের সব সদস্যকে ডেকে তোলেন। এটি দেখে মনে হয়েছে আমরা বোধহয় কাগজটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে এসেছি, ড. জাফর ইকবালের নাগরিক সন্ধ্যায় নয়। অবশ্য তারপর মঞ্চে আসেন সিডনির লেখক সালেহ্ জামী তার উপস্থাপনা নিয়ে। সালেহ্ জামী তার দুর্দান্ত ভরাট কন্ঠে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান জাফর ইকবাল স্যার এবং ইয়াসমিন ম্যাডামকে। ম্যাডামের কথা শোনার সৌভাগ্য আগে হয়নি। তাই ওতোটা ধারনা ছিলোনা তিনি কি এমন কথা বলবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুরু করলেন তাদের জীবনের গল্প। স্যারের সঙ্গে পথ চলার প্রবাস জীবনের নানা গল্প।

এবার স্যারের কথা বলার পালা। তিনি তার সেই সহজ সরল ভঙ্গিতে শুরু করলেন শৈশবের গল্প। তার ভাই বোনের গল্প। গল্প করতে করতে দর্শকদের কখনও কখনও আবেগে আক্রান্ত করেন আবার কখনও হাসিতে ভরে তোলেন।আমি ভীষন ভাবে অপেক্ষা করছিলাম তাঁর মুখে মুক্তিযুদ্ধের আর হুমায়ুন আহমেদ স্যারের গল্প শোনার। গল্প বলার এক পর্যায়ে তুলে ধরেন তাঁর বাবার শহীদ হবার কাহিনী। হুমায়ুন আহমেদের গল্প শুনতে শুনতে অনেকেই আপ্লুত হয়ে যায়, আবার মজাও পায়। একটি ঘটনা বলার পরে তো পুরো হল জুড়ে হাসির রোল পরে। ঘটনাটি ছিলো এমন, “একজন অনেক দূর থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি শুনেছি আপনি এখানে এসেছেন৷ সেটা শুনে সেই কতদূর থেকে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷ এ রকম পরিবেশে মুখে যে রকম বিনয় ফোটানোর কথা আমি সে রকম বিনয় ফুটিয়ে ধরে আছি৷ ভদ্রলোক বললেন, আমি কী আপনার হাতটা একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি? আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, নিন৷ ভদ্রলোক আমার হাতটা টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে আবেগে বিগলিত হয়ে বললেন, ইশ! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাইয়ের হাতটা আমি ধরতে পেরেছি!”

স্যার ও ম্যাডামকে মধ্যমনি করে শুরু হয় প্রশ্নত্তোর পর্ব । প্রথমেই প্রশ্ন করেন লেখক ও কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত। তারপর বৈশাখী মেলার কর্নধার শেখ শামীমুল হক, আইনজীবি নির্মল্য তালুকদার, ডাক্তার সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান, লেখিকা অনীলা পারভিন এবং প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ। সম্মানীত অতিথি দ্বয় চমৎকার ভাবে এই পর্বে অংশ নেন এবং আলোচনা প্রানবন্ত করে তোলেন।

অনুষ্ঠান শেষে স্যার ও ম্যাডাম হাসিমুখে তাদের ভক্ত ও পাঠকদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। তখন তাদের একদম ক্লান্ত মনে হয়নি। তখন আমার কেবলি মনে হচ্ছিল যেন এক ভালোবাসার মিলনমেলায় এসেছি।ভালো থাকবেন স্যার।
আর দেশের সরকার ও মানুষের কাছে মিনতি আমাদের এই প্রিয় মানুষকে নিরাপদে রাখবেন।

আরিফুর রহমান
ঔপন্যাসিক, 
বার্তা সম্পাদক, প্রশান্তিকা। 
সিডনি, ২ মে ২০১৯।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments