একটি অদ্ভুত ভালোবাসার গল্প । পিয়ারা বেগম

  
    

ভালোবাসা! ভালোবাসা!! এই ভালোবাসা শব্দটার মধ্যে আসলে মস্ত এক দুর্বোধ্য রহস্য যেন লুকিয়ে আছে। আর আছে অব্যাখ্যায়িত একটা তীব্র আকর্ষণ! আছে অন্তহীন রকমফের সুখানুভূতি!! আরো আছে নিবিড়বোধ এবং উপলব্ধির অমৃত স্পর্শানুরণন। যার চৌম্বকীয় আবেশে মানুষ মাত্রই মানুষকে কাছে টানে। শুধু মানুষ কেন, পশুপাখির মধ্যেও ভালোবাসার অনুভূতির অনুরণন একইরকম। আর ভালোবাসার সৌন্দর্য? এ যেন সমুদ্রের রঙিন প্রবালের মতই সুন্দর, উপভোগ্য। তাই তো প্রতিটি জীবের কাছেই ভালোবাসা সার্বজনীন ভাবে প্রার্থিত আর আরাধ্য তো বটেই।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, আজ আমি ভালোবাসার এমনি একটা গল্প লিখব। যা গল্প হলেও সত্যি। তবে মানুষের ভালোবাসার গল্প নয়, লিখব পাখির ভালোবাসার গল্প।

প্রায় ৩৪ বছর আগেকার কথা। আমার স্বামীর শখ ছিল কবুতর পোষা। বিভিন্ন জাতের কবুতর ছিল তার সংগ্রহে। তবে একটার নাম আমার মনে আছে তা হলো গিরিবাজ। গিরিবাজের দ্রুত উপরে ওঠে দূর আকাশে ওড়ার মুগ্ধকর দৃশ্য প্রায়ই উপভোগ করতাম। উপভোগ করতাম কবুতর দম্পতিদের নির্মোহ ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করে। আরো উপভোগ করতাম তাদের মনোভঙ্গির গভীরতা দেখে। ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে ওদের ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি দেখে। আসলে তাদের মাঝে সার্বক্ষণিক ভালোবাসা আর রোমান্স যেন লেগেই থাকত। যা দেখলে বুঝা যেত তাদের ভালোবাসা মানুষের ভালোবাসার চেয়ে আরো মানবিক আরো উদার।
এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে একটি আকস্মিক ঘটনায়। হঠাৎ একদিন আমাদের শখের এক জোড়া কবুতর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরেনি। এই কবুতর দম্পতির ছিল এক জোড়া নাদুসনুদুস বাচ্চা। তাদের বয়স ছিল সম্ভবত পনের ষোল দিন। এমতাবস্থায় আমার স্বামীর মাথায় যেন বাজ পড়লো। কবুতরের তুলতুলে বাচ্চাগুলো পিটপিট করে তাকাচ্ছে। আর তাদের মা-বাবাকে খুঁজছে। তাহলে কী হবে এ বাচ্চা দুটোর? তাই হন্তদন্ত হয়ে কবুতরের সব কয়টা খুপরি তল্লাসি করল। কোথাও নেই। তক্ষুনি ছুটে গেলেন পাড়া-প্রতিবেশি যারা কবুতর পোষেণ তাদের বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও কোনো হদিস পান নি। তার বদ্ধমূল ধারণা নিশ্চয়ই কেউ তাদের আটকে রেখেছে। সাধারণত না আটকালে কবুতর দূরে গেলেও পথভ্রষ্ট হয় না। আর সহজে মালিকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করে না। কোন না কোন উপায়ে ছাড়া পেলে ছয়মাস পরেও ফিরে আসে, এমন উদাহরণও আছে।

আমরা দুজনেই শোকে ম্যূহমান! বেদনাভারে জর্জরিত!! কারণ, বাচ্চা দুটোর জন্যই বেশী চিন্তা? এমনিতেই পোষা প্রাণী হারালে বড্ড কষ্ট হয়। প্রবাদ আছে, “পালা প্রাণীর জ্বালা বেশি।” তাছাড়া শখের জিনিস বলে কথা! শুরু হলো শোক দিবস পালন! সাথে চলল খোঁজাখুঁজির পালাও। বাচ্চা দুটো মা-বাবার জন্য পাখা ঝাপটায়ে কিচিরমিচির করে কাঁদছে। দুদিন পর গলার আওয়াজ কমে আসছে। খুপরির মুখ খোলার আওয়াজ পেলেই ওরা এগিয়ে আসে। গলা উঁচিয়ে হা করে খাবার চায়। মনটা তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে! মানুষ হলে এতক্ষণে থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা কতকিছু  হতো। মানববন্ধন হতো! কিন্তু ওরা তো পাখি? তবে ওদের তিরোধানে আমাদের মনে কষ্টের বোঝাটা একেবারে কম নয়। তত্ত্ব-তালাশের ঘাটতিও নেই। বাচ্চাগুলোর প্রতিও যত্নআত্তিতে এতটুকু অবহেলা করছি না। করছি মূলত দায়িত্ববোধের চেয়ে মমত্ববোধের কারণেই।

এ কয় দিন পাতলা পুরানো কাপড়ে পুটলিতে কেনা খাবার ভরে পুটলি ছিদ্র করেছি। বাচ্চাদের ঠোঁট পুটলির ছিদ্রপথ ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। পানিও খাওয়াচ্ছি। তবুও বাচ্চাগুলোর নাদুসনুদুস ভাব আর নেই। তাদের মসৃণ পালকে শুষ্কতা দৃশ্যমান। দিন দিন বাচ্চাগুলো যেন শুকিয়ে চিপসে গেছে। শেষমেশ ছয় সাত দিন পর বাচ্চা দুটো মারা যায়। আমাদের আহত হৃদয়ের ক্ষতটা আরো দগদগে হলো। অনেকে বলেছিল, জবাই করে খেয়ে ফেলেন। কিন্তু এতিম বাচ্চা দুটোর প্রতি যত্ন-আত্তির সুবাদে এ কয়দিনে একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। ওদের চাহনিতে ছিল একটা করুণ-কাতর আকুতি। তাই পারলাম না তাদের গলায় ছুড়ি চালাতে। তাদের মৃত্যুতে মনটা আরো শোকে কাতর হলো।

অবশেষে আমাদের শোক দিবস, মাস পূর্তি হল। একমাস, দু’মাস। আমরাও জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এক আকস্মিক মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনমাসের মাথায় হঠাৎ পায়রা কবুতরটি ফিরে এল। সাথে সাথে আমাদেরও দৃষ্টি পড়ল ওর ওপর। এসেই আমাদের চৌয়ারী ঘরের চালায় বসল। উদাস   তার দৃষ্টি! উদ়্ভ্রান্ত, পাগলপ্রায় পায়রাটি ঘুরেফিরে খুঁজছে তার প্রিয়তমা পায়রিকে। খুঁজছে তাদের আদুরে সন্তানদের। না পেয়ে নিজের খুপরিতে এসে ঢুকার চেষ্টা করছে। ভাবছে হয়তো খুপরিতে তার আদুরে ছানা দুটো তাদের মায়ের পাখার নিচে ওম নিচ্ছে।
কিন্তু সেই খুপরি তো এখন অন্য কবুতর দম্পতির দখলে। তারা এখন ডিমে তা দিচ্ছে।তারা পায়রাটিকে ঠুকরে ঠুকরে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। অবশেষে নাজেহাল হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে গিয়ে বসল আমাদের কাঁঠাল গাছে। স্ত্রী সন্তান বিহনে শোক-তাপ আর বিরহ যাতনায় সে প্রায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কারণ, তার বাসস্থানও এখন অন্যের দখলে। বেচারা পায়রা! মনোকষ্টে দিশেহারা!! পায়রাটি কেমন একটা অদ্ভুত ও অসহায় দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমাদের প্রতি তার মনে যে অনেক প্রশ্ন? এটা তার অভিব্যক্তিতে স্পস্ট প্রকাশ পাচ্ছে। এতটকু বুঝলাম, পশুপাখির শোক-তাপের অনুভুতিও মানুষের মতোই। কিন্তু আমরা তো তার ব্যথা, তার কষ্ট অনুধাবন করছি। কিন্তু তাকে এটা বুঝানোর কোন কৌশল আমাদের জানা নেই। অবশেষে সন্ধ্যায় তাকে খাঁচাবন্দী করা হলো। খাঁচাবন্দি পায়রার জোড়া মেলাতে ক্রয় করা হলো একটা মানানসই নতুন পায়রি। একই খাঁচায় তাদের দু’টিকে রাখা হলো। কিন্তু সাতদিনেও তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। নতুন পায়রি, পায়রার ভালোবাসা পাবার জন্য তার ঠোঁটে, মুখে, চঞ্চুতে চঞ্চু মেলায়। কিন্তু পায়রাটি ওর ভালোবাসায় সাড়া দিচ্ছে না। তবুও ওর নিঃস্পৃহতায় সে হাল ছাড়ে নি। তার গভীর আকুতি মেশানো আদর ও ভালোবাসা নিবেদন করেই চলেছে। কিন্তু পায়রাটি তবুও অনড়, অবিচল। আর পায়রি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষান্তিহীন নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালাচ্ছে নিরন্তর।
এটা তো মানতেই হবে যে, জীবমাত্রই একটা অদম্য চাহিদা থাকে আর এটাকে উপেক্ষা করার কোনো শক্তি তাদের নেই। একসময় দেখা গেল তাদের দু’টি মন কাছে আসল। সংসার পাতল, ডিম দিল, বাচ্চাও ফুটাল। আমরা ভাবছি, যাক ওরা সুখী এখন। কিন্তু পায়রা কবুতরটির মনমরা আর বিমর্ষতা ভাব এখনো কাটেনি।

আসলে, প্রার্থীত জীবন সঙ্গীর পরিবর্তনে সংসার জীবন হয় তো চলে। তবে তাতে থাকে না কোন প্রাণের স্পন্দন।  থাকে না সেই আবেগ-অনুভূতির আনন্দ মদির উচ্ছ্বাস। মানুষের মাঝেও তা দেখেছি। কিন্তু অবাক করার বিষয় পায়রা কবুতরটিরও সেই একই অবস্থা।
দিন যায়, মাস যায়। তাদের নতুন দাম্পত্য জীবনের তিনমাস পর সেই হারানো পুরনো পায়রি ফিরে এল। এসেই নিজের খুপরিতে ঢুকার চেষ্টায় ব্যর্থ হলো। নতুন পায়রি তাকে ঠুকরিয়ে, ঝেঁটিয়ে বিদায় করল। কিন্তু পায়রাটি? পায়রাটি তো তার প্রিয়তমা পায়রি কে চিনে ফেলল। ভালোবাসার টানে খুপরি থেকে বেরিয়ে এল। পুরোনো পায়রির সাথে গা ঘেঁষে বসল। উভয়ই পারস্পারিক সুখ-দুঃখের স্মৃতিচারণায় মশগুল। দীর্ঘ ছয়মাস পর উভয়-উভয়কে কে কাছে পেল। তাদের সে কি  আনন্দ-উচ্ছ্বাস! দীর্ঘ বিরহে উভয়ই প্রেমস্পদের সান্নিধ্যে পাবার সে কী আকুলতা! মূহুর্মহু আবেগ-বিভোরে, মদির-মত্ততায়, উন্মাদনায় উন্মাতাল তারা। উভয়েই উভয়ের চঞ্চুতে চঞ্চু, ঠোঁট-মুখে মাখামাখি করছে। তাদের এতদিনকার বিরহপীড়িত ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে উন্মনায় উদ্বেলিত হয়ে। পায়রা-পায়রি আত্মনিবেদিত হয়ে উপভোগ করছে মিলন তিথির স্পর্শানুভূতি! হায়রে ভালবাসা!! পাখির মধ্যেও যে এমন অনুভূতি সক্রিয় থাকে তা দেখে আমরা  নিজেও বিস্ময়ে বিমূঢ়! আর এদিকে টের পেয়ে নতুন পায়রি বেরিয়ে এল। তার সে কী অগ্নিমূর্তি রূপ! তাদের দু’টোর মাঝে পাহাড়সম বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। শুরু হলো ভালোবাসার দখলসত্ত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা। বেচারা পায়রা? সে কি করুণ অবস্থা! একবার ওর দিকে, একবার এর দিকে মুখ ঘোরাচ্ছে। বেকায়দায় পড়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আর দুই পায়রির সে কি ঝগড়া! পাখা ঝাপটায়ে একে অপরকে অধিকারচ্যুত করার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছে। হায় রে পায়রা, তুমি এখন কার? আমরাও তা প্রত্যক্ষ করে একেবারে বিস্ময়াভিভূত! মানুষ হলে হয় তো আইনানুগ বিচার সালিশির মাধ্যমে একটা সমঝোতায় আসা যেত। কিন্তু এটার সমাধান কীভাবে করব? আগের পায়রির প্রতি পায়রার ভালোবাসার গভীরতা পরখ করছি, উপলব্ধিও করছি।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে নতুন পায়রিটিকে খাঁচাবন্দী করা হলো। পরে বিক্রি করে দেওয়া হলো নতুন পায়রিকে। সাধ্যসাধনা করে পাওয়া নতুন পায়রির স্বপ্নের বাসর ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। এতেও আমাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না।

আর পুরানো পায়রা-পায়রি একে অপরকে পেল  ভালোবাসার মাপকাঠির নিরঙ্কুশ বিচারে। তাদের প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রকাশের ঘটনা স্বচক্ষে দেখে আকণ্ঠ ডুবে ছিলাম মুগ্ধতায়। আবার তারা নতুন করে সাজাল তাদের সুখের সংসার।
জীবনের ধর্ম এই, একজনকে সুখি করতে গিয়ে অন্যজনকে বঞ্চিত করতে হয়। জানি না, সে পায়রি তার প্রেমিক পায়রাকে ভুলতে পেরেছে কী না? হয়তো বা বিরহ-যাতনা সয়ে-সয়ে একসময় খাঁচাবন্দি হয়েছে। বাধ্য হয়ে জীবনের প্রয়োজনে হয়তো বা অন্য পায়রার বাহুবন্ধনে ধরা দেবে? জীবন যেমন হয়!!

প্রেম-বিচ্ছেদ,মিলন-বিরহ এই নিয়েই জীবনের আবহ!

পিয়ারা বেগম
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments