সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভাইয়ার একটা মেসেজ পেলাম, পঞ্চাশোর্ধ এক করোনা রোগী মুগদা হাসপাতাল থেকেলাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। লাফ দেবার আগে লিখে গেছেন, উনার একাকীত্বের কথা। ভদ্রলোকের টাকাপয়সার অভাব ছিল না কিন্তু আত্মীয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব বলতে কেউ ছিল না। পরিবারের সবাই ছিল যুক্তরাষ্ট্র সহঅন্যান্য উন্নত দেশে। উনি হয়তো করোনাতে এই একাকীত্ব আরও প্রকট ভাবে অনুভব করেছিলেন, তাইহাসপাতালে যেয়েও চিকিৎসা গ্রহনের বদলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।
করোনা তো আসলেই মানুষকে একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়।“ ডিস্টেন্স মেনে চলতে হবে” কথাটাতেও যেন অনেকবেদনা লুকোনো আছে। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষই এটা মেনে নিতে রাজি না। শুধুমাত্র মহামারী বলেই মেনেনেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে যে আইসোলেশনে যেতে বাধ্য হচ্ছে এটাইমর্মবিদারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারন অসুস্থ হলে মানুষ একটু আদর চায়, কেউ মাথায় হাত রাখুক, পাশে বসে দুটাকথা বলুক , এই মহামারী এমনই সংক্রামক ব্যাধি যে এর কিছুই আইসোলেশনে থেকে সম্ভব হয় না। আজকাল তো১৪ দিনেও হচ্ছে না, ২১ দিন লেগে যাচ্ছে। শারিরিক অসুস্থতার সাথে সাথে একাকীত্বও মন ভেঙে দিচ্ছে মানুষের।প্রিয়জন থেকে দুরে থাকা কোন সহজ কাজ নয়।
দুদিন আগে আমাদের সবার প্রিয় নায়িকা করবী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে খুব অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সবাইকেকাঁদিয়ে না ফেয়ার দেশে চলে গেলেন । এরপর ভাইরাল হয়ে গেলো উনার একটি ইন্টারভিউয়ের কিছু কথা, “জীবনে ভালো একজন বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না, সন্তানেরা যে যার মতো বড় হয়েছে, কারোসাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলবো এমন কাউকে পেলাম না।“ উনার মতো এতো বিখ্যাতএকজন মানুষের এই একাকীত্বের কথা আমাদের সবাইকে খুব অবাক করে দিয়েছে। উনার একজন সত্যিকারের বন্ধুছিল না ভাবতেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠেছে বেদনা। এতো জনপ্রিয়, হাসিখুশি, সফলতার সর্বোচ্চ শিখরেথেকেও একজন মানুষ একা হতে পারে ভাবতেও অবাক লাগে ! আমি ভাবি, উনি কি কখনো কাউন্সেলিং এগিয়েছিলেন?
আমি একবার একজন বিখ্যাত মানুষের কাউন্সেলিং করেছিলাম, সেই মানুষটাও আমাকে এমনই একটা কথাবলেছিল, একজন ভালো বন্ধু বা সঙ্গী মিলছিলো না তার। বিখ্যাত মানুষদের কাছে শত শত মানুষ আসে তাদেরফ্যান হিসেবে । তাদের অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা বা মিষ্টি কণ্ঠের গান কিংবা অন্য কোন দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েতাদের কাছে ভিড় করে। তাঁদের একটু সান্নিধ্য পাবার জন্য আকুল হয়। কিন্তু সত্যিকারের বন্ধু – যেখানে কোন গুনবা দক্ষতার বালাই থাকবে না , যা খুশী বলা যাবে, পড়া যাবে, খাওয়া যাবে, একদম যেমন খুশী তেমন করা যায়এমন বন্ধু পাওয়া দুরুহ। দক্ষতা নয় , শুধু মানুষটাকে জেনে এবং চিনে সম্পুর্ন নির্ভেজাল ভালোবাসায় মোড়ানোএকটা বন্ধুত্ব হবে , এটা বিখ্যাত মানুষদের বেলায় খুবই বিরল । তাই বাইরে থেকে ওঁদের আমরা যেমন দেখি , ভেতরে হয়তো এমন করেই অনেক মানুষ একাকিত্বে ভুগছেন।
হলিউডের বিখাত নায়ক রবিন উইলিয়ামসের আত্মহত্যা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। যে মানুষটা তারঅসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সবাইকে হাসিয়েছেন, সেই মানুষটা হঠাৎ করে একাকীত্বের কথা বলে গেলেন ।উনি বলেছিলেন “ আমি ভেবেছিলাম জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা হবে, শেষ সময়ে এসে একা হয়ে যাওয়া , কিন্তু তা নয়। সবচেয়ে খারাপ হলো, সেইসব মানুষদের সাথে থাকা যারা তোমার সাথে থেকেও তোমাকেএকাকীত্বের অনুভূতি দেয় “ । কি গভীর দুঃখ লুকোনো কয়েকটা কথা ! সবার মাঝে থেকেও উনি কতো একাছিলেন। পুরো পৃথিবী সেদিন চমকে গিয়েছিলো উনার আত্মহত্যার কথা শুনে।
বর্ষীয়ানদের মধ্যে এই একাকীত্বের পরিমাণ অনেক বেশী। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়েজীবন বিস্তার করলে উনারা একা হয়ে যান সেটা তো আছেই আবার পুরো পরিবারের মাঝখানে থেকেও উনারাএকাকীত্বে ভুগতে পারেন। ৬০ এর উর্ধে যেতে শুরু করলেই জীবনের পরিবর্তন মেনে নিয়ে একটু একটু করে একাহতে থাকেন মানুষ। এই পর্যায়ে এসে পরিবর্তিত জীবনযাত্রা মেনে নেওয়া খুবই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে উনাদের পক্ষে, সেটা একা হোক কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে থেকে হোক। পরিবর্তন সবার জন্য সহজ নয়, তাইতাঁদের কথা একটু ভাবতে হবে, সময় দিতে হবে। জেনে রাখা ভালো, একাকিত্ব মানে চুপ করে এক কোনায় বসেথাকা নয়, সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে একাকিত্ব থাকতে পারে, সারাক্ষন চেচামেচি কিংবা খিটখিটেস্বভাবের হলেও সে একা হতে পারে।
সোশ্যাল ওয়ার্কার বা স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে উনাদের একটা লিস্ট করা যেতে পারে, এবং প্রতি সপ্তাহে উনাদের জন্যবিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় একটি সমাবেশের আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন কার্যকলাপ থাকবে, যেমনকথা বলা, বই পড়া, ছবি আঁকা, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য কিছু । শুধু হাঁটতে যাবার জন্যেও একটা দল থাকতেপারে। এই বয়সে মানুষ ছোট বাচ্চাদের সাথেও খুব সুন্দর সময় কাঁটাতে ভালোবাসে, তাই কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিংবা কোন স্বেচ্ছাসেবকের দল উনাদের জন্য সপ্তাহে একদিন এটাও আয়োজন করতে পারে। কোন স্কুল থেকেএকদল ৪/৫ বছরের বাচ্চারা উনাদের সঙ্গে এক ঘণ্টা সময় কাটালে দু ‘পক্ষের জন্যই অনেক উপকার হবে। ছোটশিশুরাও কিছু শিখবে, বর্ষীয়ানরাও খুব সুন্দর একটা সময় কাটাতে পারবে। সবশেষে বলবো প্রয়োজন বুঝেকাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা একা কিংবা দলীয়ভাবে হতে পারে। এই যে এতোসব আয়োজনের কথাবললাম, এসব করেও একাকীত্ব না ঘুচতে পারে, ডিপ্রেশন বা উৎকন্ঠায় ভুগতে পারে, সেক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অনিবার্য।
শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।