একাত্তরের ২৬ মার্চ ও আজ । রণেশ মৈত্র

  
    
এটা তো স্বাভাবিকই যে একাত্তরের ২৬ মার্চ আর ৫১ বছর পরের ২০২২ এর ২৬ মার্চ এক রকম হবে না। আসলে তো দেশটাই বদলে গেছে। একাত্তরে আমরা ছিলাম পাকিস্তানী-আর এখন আমরা বাংলাদেশী। তখন আমরা ছিলাম পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে ( যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তদর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ব পাকিস্তান) একটি প্রদেশের বাসিন্দা এবং আধা ঔপনিবেশিক ধরণের শাসনাধীনে। আর আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের জাতীয় পতাকা, জাতীয়সঙ্গীত ও ভাষা আলাদা। আমাদের কোন প্রদেশ নেই-তার প্রয়োজনও নেই। আমরা ইউনিটারী পদ্ধতি একটি একক রাষ্ট্র।
২৬ মার্চ একাত্তরে আমরা সমগ্র বাঙালি জাতি হয়ে পড়েছিলাম পাকিস্তানের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের অধীন-আজ বহু কিছু দুর্বলতা সত্বেও তেমন বর্বর নির্যাতন নেই। সেদিন বাঙালি সন্তানদের স্থান সামরিক বাহিনীতে হতো না-হতো না প্রশাসনেও। মুলত: পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী ও প্রশাসকেরাই দেশটা শাসন করতো-বাঙালিদের ভাগ্যে আর বাঙালিদের ভাগ্যে জুটতো কেরানী গিরি অথবা বড়জোর পিওন গিরি। বাঙালির জীবন ছিল বেকারীত্বে পূর্ণ-দারিদ্র্যের কষাঘাতে র্দীণ-বিদীর্ণ।
সেদিনকার ২৬ মার্চ ছিলো লড়াই এর নতুন পর্য্যায়ে ভয়াবহ পর্য্যায়ে পৌঁছানোর দিন আজ লাশ দেখার দিন-দিবারাত্র কারফিউ এর দিন। পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার শংকাপূর্ণ দিন। সেদিনটি ছিল প্রত্যাঘাত হানার এবং তার প্রস্তুতি গ্রহণের দিন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর হিংশ্রতাপূর্ণ গণহত্যার পরবর্তী বীভৎস একটি দিন। একই সাথে নতুন প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত হওয়ার দিন।
সেই প্রেরণা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের  জীবন, যৌবন, ঘর-সংসার, ভবিষ্যতের স্বপ্ন এক কথায়, সব কিছু বাজি রেখে। বস্তুত এ লড়াই ছিল বাঙালির অস্তিত্বের লড়াই বাঙালির বাঁচার লড়াই।
আমরা জানিই না কবে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ জন্মগ্রহগণ করেছিলেন, তেমনি করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের সরকারী ইতিহাসে তাঁদের কোন স্থান নেই-সরকারিভাবে তাঁদের জন্মদিন পালনের ন্যূনতম আয়োজনও কোনদিন হতে দেখা যায় না। তেমনি ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ক্ষেত্রেও।
তবে কি বলা যাবে এই নেতাদেরকে এবং তাঁদের সাথে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ, কমরেড মনি সিংহ, মনোরাঞ্জন ধর প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয় সম্ভব হয়েছিল?
এবারের ২৬ মার্চের এসে আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি কেমন ছিল? কিভাবে নয়টি মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ চালানো সম্ভব হয়েছিল-মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা কারা করেছিলেন-কারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের মিত্র ছিলেন এবং কারাই বা জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করেছিল।
জানবার শেষ নেই। আরও যা যা জানবার এবং জানাবার প্রয়োজনীয়তা অসীম তার তালিকাও ক্ষুদ্র নয়। কারণ একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশাল ব্যাপার। সেখানে বহু লোকের সম্পৃক্তি, বহু আত্মদান, বহু জনের কারাবাস ও নানাবিধ নির্য্যাতন এবং সীমাহীন অত্যাচার সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে এবং তারও আগে ২৩টি বছর ধরে সহ্য করতে হয়েছে। এর পেছনে লক্ষ্য শুধুমাত্র এটা ছিল না যে একটি মানচিত্র আঁকা হবে, যার একটি নতুন পতাকা ও নতুন জাতীয় সঙ্গীত হবে। বরং তা ছিলো পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যানের জন্য, তার আদর্শ ও নীতি গুলিকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করার জন্য। এই লক্ষ্য ছিল বলেই আমরা দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদেরকে, শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদেরকে, শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পীদেরকে, শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীদেরকে, দেশ প্রেমিক সরকারি কর্মকর্তাদেরকে, শিক্ষক- শিক্ষিকাদেরকে, সাংবাদিকদেরকে, শ্রমিক নেতাদেরকে সমবেতভাবে তাঁদের সকলকে জীবন বাজি রেখে নানাভাবে নিজ নিজ যোগ্যতার সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে সমবেতভাবে বা সমচিতভাবে অংশ নিলেন। তাঁরা তাঁদের শিল্পকর্ম দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরগুলিতে গিয়ে অবস্থধানরত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন-সমগ্র ভারতব্যাপী তাঁরা সভা-সমিতি মিছিল সমাবেশ করে কি উদ্দেশ্যে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছেন-তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন-সকলের সক্রিয় সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করেছেন।
এই দিনে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে তেমনই অসীম শ্রদ্ধা জানাব বাংলাদেশের প্রথম ও সফল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ.এইচ কামরুজ্জামান এবং জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মনি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ এবং হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ও তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদানকে।
এঁদেরকেও ব্যক্তিপূজার মত স্তাবকতার ভাষা স্মরণ করা নয়। এঁদের আজীবন লালিত আদর্শ যেমন অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিসারী এবং সোনার বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যেই তো বাহাত্তরের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে ধর্মাশ্রয়ী সকল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন বাহাত্তরের এই সংবিধান তাই রক্তের অক্ষরে লেখা।
কিন্তু ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যালীলা ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুইজন সামরিক শাসক অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ততোধিক অবৈধ পদ্ধতিতে পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর দ্বারা বাংলাদেশের গতিমুখ পাকিস্তানের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই দুই সামরিক কর্মকর্তার একজন সংবিধানের শুরুতে “বিসমিল্লাহ” লিখলেন, জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রীয় দলকে বৈধতা দিলেন। অপর সামরিক শাসক “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হইবে ইসলাম”, এমন বিভেদাত্মক ও চরম বৈষম্যমূলক সংশোধনী অনুমোদন করে মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধুর সংবিধানগুলি (সঙ্গে অর্পিত সম্পত্তি আইন) আজও দিব্যি বহাল আছে। নতুন করে আর এক ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক, উগ্র জঙ্গীবাদী দল হেফাজতে ইসলামকে সকল অপকর্ম সত্বেও সরকারি সখ্যতা অর্জন করেছে। তাদের অঙ্গুলি হেলনকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
তাই এবারের ২৬ মার্চ সরকারি-বেসরকারি উভয় অঙ্গনেই বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবীকরণ এবং সকল জাতীয় নেতৃত্বকে সসম্মানে শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁদের সকলের ভাস্কর্য ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র নির্মাণের প্রত্যয় গ্রহণ করা হোক।
রণেশ মৈত্র
সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ। 
সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত। 
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments