
নানা ঘটনা চারপাশে। ব্যক্তি, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক। মানুষ হিসেবে এসব ঘটনার টানাপোড়েন আমাকেও টানে, ভাবায়। এই যে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগে শুদ্ধি অভিযান চলছে, সেখানে আচ্ছন্ন সবাই। দলের ভেতর বাইরে, নানা আলোচনা, হিসাবনিকাশ। মানুষের মনে নানা ফন্দিফিকির। কত কথা মনে। কত গল্প। কতটুকু তার সত্যি, কতটুকু স্বপ্ন, কে জানে! তবুও মানুষ ভাবে। ভাবতে হয়। দিনশেষে রাতে যখন বিছানায় ঠেকে পিঠ, স্বজনের হাত ঠেকে হাতে, স্বপ্নগুলো পাখি হয়ে উড়ে যায় ঘুমে। ঘুমপাখি, পাখিঘুম, এ-ই তো জীবন, মানুষের জীবন।
ক্যাসিনো ধরা পড়েছে। অগে থেকেই ছিল, ধরা পড়লো এই প্রথম। সরাসরি যারা জড়িত তারা যেমন তটস্থ, তেমনি সুবিধাভোগিরাও। বেশ জেকে বসেছিল মনে হলো। নানাজনের নাম আসছে। নানা ঘটনা বেরিয়ে আসছে। ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী, দুর্দান্ত দাপুটে।
খুব খারাপ লাগছে এসব দেখে। ঘর-সংসার, ব্যক্তি, পরিজন, ইত্যকার খরচাপাতি, কত বেগ পেতে হয় আমাদের। লেখাপড়া করেছি। দায়িত্বশীল নাগরিক। সৎ সুন্দর শোভন জীবন যাপনের জন্য কত কষ্ট করতে হয়। কত ছোট ছোট ইচ্ছা স্বপ্ন অধরা। কত প্রিয়জনের কত সামান্য আব্দার পূরণ করতে পারি না। একটা ভালো স্যান্ডেল, ভালো শার্ট কেনার জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। একটা ভালো সিনেমা দেখবো বলে, একটা দুপুর বা রাত সবাইকে নিয়ে একবেলা খাবো বলে, আমাদের অপেক্ষা করতে হয় একটা উৎসবের, আয়োজনের।
আমরা পারি না। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানো, ভালো পরিবেশে রাখতে, আমাদের ঘাম ছোটে। সারাজীবন কাজ করি, কষ্ট করি, আমাদের নিজস্ব বাড়ি হয় না। ভাড়া বাড়িতে, মাসের পর মাস কোনমতে মাথা গুজে আমাদের দিন কেটে যায়। একটা ভালো গান পদ্য বাঁধবো বলে, কত রাত বিনিদ্রি কাটে আমাদের। খোলা মাঠে, মঞ্চে, আমরা চাইলেই গাইতে পারি না নুসরাতের গান।
এদেশে রাজনীতি মুখ্য। বলা চলে রাজনৈতিক রাষ্ট্র। আমরা এখন ‘রাজনৈতিক মানুষ’ ‘রাজনীতিক’ ‘রাজনৈতিক নাগরিক’। রাজনীতির বাইরে আমাদের কিছু নেই। চায়ের স্টল, সেলুন, মুদির দোকান, সবখানে রাজনীতি। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, কেন্দ্রিয়, যে কোন শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, এমনকি সমর্থক দেখেলেও আমরা দাঁড়াই; আলোচনা বন্ধ করি; ভয়ে থাকি, ভয় পাই।
আমরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি। ক্ষমতার রাজনীতি। সব দলের নেতার লক্ষ্য ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। জোট রাজনীতি করি। জনপ্রতিনিধি নেতা নির্বাচনে ক্ষমতা দেখি, প্রভাব দেখি। কড়িগুণে মাপি পেশিশক্তি, দখল, অর্থবিত্ত। এসবই তো এখন ক্ষমতার সিঁড়ি। ক্ষমতায় আরোহনের মুল নিয়ামক।
এই যে ক্যাসিনো, মদ জুয়া, টেন্ডার, সবই রাজনৈতিক। মুল লক্ষ্য অর্থ উৎপাদন। ক্ষমতার বিকিকিনি। মূল প্রশ্রয় ক্ষমতার রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। রাজনীতির শক্ত আবরণে অস্পষ্ট বৈধ-অবৈধের ভেদবিচার। অর্থ আসছে। অর্থ যাচ্ছে। ছোট বড় নেতা, কর্মী, সমর্থক, সুবিধাভোগি বাড়ছে। ঢাকা পড়ছে অপরাধবোধ, বিচারশালিশ। এতদিন, এতবছর, এমন প্রকাশ্যে, এমন অবৈধ কাজ, সম্ভব হয়েছে কেবল রাজনীতির কারণেই। রাজনীতির গন্ধ শক্তি ছিল বলেই নিশ্চুপ ছিলাম আমরা, প্রশাসন। রাজনীতির হাত ধরেই পালাবদল কর্তৃত্বের।
যখন যারা ক্ষমতায় গেছেন, কপাল ফিরেছে তাদের। অর্থ জুটেছে। শক্ত হয়েছে ক্ষমতা। পরাক্রমশালী হয়েছেন। শক্ত আবরণ তৈরি হয়েছে। তোয়াক্কা করেননি কোনকিছুর- না নেতা, না কর্মী। ভোটার তো কোন দূর ছাই। দেখা হয় মাত্র একবার, ভোটে!
আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এসব ব্যক্তি মহল চক্র রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় প্রশ্রয় না পেলে, ক্ষমতার রাজনীতির শক্তি এদের পক্ষে না থাকলে, এমন অন্যায় অবৈধ উপার্জন, কর্ম, কখনোই করার সাহস পেতেন না; করতেন না। সমাজের নানাক্ষেত্রে এদের সুবিধাভোগী। নানা কর্মকারণে এদের সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষমতার অপরাপর গোষ্ঠীর। এদের বৃত্ত শক্ত।
মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের এই দেশে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে এমন বিভাজন, আমাদের ভালো লাগে না। একটা দেশ। কত ব্যবধান মানুষে মানুষে। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি- সবখানে, যোজন যোজন ব্যবধান। যে মানুষ কষ্ট করে, সৎ শোভন সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখে ও করে, একটা চাকুরি কিছু অর্থের জন্য জুতোর তলি ক্ষয়ে যায়, সে দেশে আরেক শ্রেণির পাহাড়সম অর্থ, আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এসবই ক্ষমতার রাজনীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা।
অবৈধ জুয়া, ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি। নানাতক অপরাধ কর্ম। বছরের পর বছর ধরে চলছে। লোকচক্ষুর আড়ালে। সামনে পেছনে ক্ষমতার রাজনীতি বা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী মানুষ। ভীষন প্রভাবশালী। সবই অর্বেধভাবে উপার্জিত- দলের তহবিলে যে অনুদান, ভোটের খরচাপাতি, তা-ও; সমুদয় অর্থ, ক্ষমতা, সুখ- সবই। এমনকি সন্তানের মুখে যে খাবার তুলে দেন, মৃত্যু শরনাপন্ন মা বাবা স্বজনের জন্য যে ওষুধপত্তর, তাও সেই অবৈধ টাকায়। অসৎ পথে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থেই তাদের চাকচিক্য বাড়ে; সম্মান বাড়ে না। যেদিন খুলে যায় সব, হাতকড়া পড়ানো ছবি ভেসে ওঠে চারপাশে, তখন কোথায় যায় এসব আভিজাত্য, সম্মান প্রতিপত্তি!
আমার মা বলতেন, বাবা, সোনা পড়ে থাকলেও হাত দিয়ে ধরবি না। কারো কোনো জিনিস অনুমতি ছাড়া নিবি না। আমরা নিইনি। ধরিনি। আমরা মানে শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কষ্ট করেছি। এখনও করি। রাষ্ট্র মানি। সমাজ সভ্যতা জানি। সংস্কৃতি রাজনীতির চর্চা আমাদেরও আছে। আমরা রাজনীতি করি না। রাজনৈতিক আদর্শ মানি, প্রগতি মানি। রাজনৈতিক দলগুলোর যে সুশোভন উচ্চারিত বাণী, তা মেনে মেনেই তো আমরা রুচিশীল নাগরিক হয়ে উঠি।
রাজনীতি এখন এ দেশে মানুষের সবচয়ে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতি। রাস্তায়, অলিগলিতে, মহাসড়কে, অফিসে, মাঠে, সর্বত্র রাজনীতি, নেতাকর্মী। সরকারের যা কিছু কর্ম, সুন্দর, লোভনীয়, সবই ওদের। সুন্দর পোশাক, সুমিষ্ট কন্ঠ, উপাদেয় খাবার- ওদের। ওরাই সবকিছুর নিয়ন্তা। আলো অন্ধকার, ঘুপচি গলি স্বর্গোদ্যান, সব ওদের চাই, সব। কেবল রাজনীতির কারণেই মানুষে মানুষে ব্যবধানের শক্ত রেখা এখানে। দল ও আনুগত্যের বাইরে অন্যসবই মিথ্যা ভুল অমার্জনীয়।
আমরা একটা সমতার রাষ্ট্র চাই। অন্তত পাশের বাড়ির মানুষটির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাই ওর ভেতরের গল্প, সুখ কিংবা মনোতাপ। সোনাঝরা শান্ত সৌম্যময় একটা সময় আমাদের ভীষন দরকার। আমরা নষ্ট হতে হতে, নর্দমায় ডুবতে ডুবতে, পচা দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছি। আমাদের চোখে লোভ। মনোবাসনা কুৎসিত। ঘর সংসার, মাঠে, সন্তান স্বজনকে আমরা নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলি। ঠকাই। চারপাশে যা কিছু, সব একা একান্ত করে চাই। মানুষকে ঠকিয়ে, রাজনীতির ক্ষমতা দেখিয়ে, আমরা তলিয়ে যাচ্ছি অতলে, অসুন্দরে। একা নই, একদিন আমরা সর্বত্র সবাই মিলে ডুববো।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার।
প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
ঢাকা, বাংলাদেশ।