
সায়রা বেগমের যখন বয়েস ১৪+, তখনই হঠাৎ করে তার বাবা প্রায় ৩০ বছরের এক বিপত্নীক যার প্রায় সায়রার কাছকাছি বয়সের দুজন ছেলে-মেয়ে আছে, এমন একজন ভদ্রলোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বাভাবিক ভাবেই সায়রার সংসার আর দশটা মেয়ের মত হয়নি।
একসময় সায়রা মা হয়, নিজের অনেক অনেক না-পাওয়াকে চাপা দিয়ে নিজের ‘মা’ পরিচয়ের মহিমা তুলে ধরার তাগিদই জীবন আর বেঁচে থাকার অন্য এক নাম হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে। একটা সময় সায়রা অনেকটা বাধ্য হয় দু সন্তান নিয়ে ভিন্ন ঠিকানা খুঁজে নিতে চেষ্টা করে ছোট এক শহরে।
সায়রা ও তার জীবনকে ঘিরে পরিবার ও সমাজ নানান ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে এই সিদ্ধান্তে। সায়রা ছোট একটা চাকরী এবং দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সব কষ্টে দিন যাপন করেও বাচ্চাদের ঠিক সময় খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ভালো স্কুলে পড়ান। ছেলেমেয়েকে দিনের পর দিন মাছ মাংস দুধ ডিম বা পুষ্টিকর খাবার বা সুন্দর দামী জামা কাপড় দিতে পারেননা প্রায়শই। তারপরও সেই সময় গুলোতেও বাচ্চারা যেন সেটা বুঝতে না পারে, তারজন্যে এমনভাবে রান্না করেন যেন বাচ্চারা সেটা বুঝতে না পারে। ওরা খেতে বসে শুধু সবজি দিয়ে রান্না কোন সাধারণ তরকারিতে মাছ খুঁজে খুঁজেই খাওয়া শেষ করে ফেলে।
এই সব সংগ্রামের সাথী হয়ে কেউই থাকেনা বা সায়রা নিজেও চায়না তার আত্মসম্মানকে বিকিয়ে যে কারো সাহায্য নিতে। দুই একজন মানুষ এগিয়ে আসে, হয়ত কিছু স্বার্থ নিয়েই, কিন্তু সায়রার বয়স কম হওয়াতে, পাড়ার লোকজন সায়রার ধারে কাছে কোন পুরুষ মানুষের আওয়াজ পেলে ধরেই নেন এই লোকের সাথে সায়রার অনৈতিক (!) ভাব ভালোবাসা না হয়ে যায়ই না!
দিনশেষে সায়রার অনেক বেশি ক্লান্ত লাগে, একা লাগে, কাউকে বলতে ইচ্ছে করে, এই পথ চলা বড় কষ্টের!

নীলুফার বানু এইচ এস সি পড়ার সময়ই তার কঠিন প্রেমে পড়ে যায় খালাতো ভাই, নিলুফার দেখতে সুন্দর, প্রেমিকটিও তাই। দুজনের চোখেই সেই বয়েসের তুমুল উচ্ছ্বাস, উদাত্ত প্রেমে ভেসে যাওয়ার আহ্বান। ছেলেটি স্বপ্ন দেখায় তারাও গড়বে আরেক তাজমহল। নীলুফার বানুর মা-ভাই-বোন বিষয়টা টের পেয়ে অনেক বোঝায় কেন এই সম্পর্ক ওর জন্যে ভালো হবেনা। কিন্তু বানুর চোখের ঘোর কাটেনা, প্রেমিক সেটি কিছুতেই কাটতে দেয়না। পালিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলে একদিন।
হঠাৎই মুখোমুখী বাস্তবতার, বানু তার সব ভালোবাসা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায় ‘সংসারটা’ করার। এরমাঝেই সে এক কন্যার মা এবং স্বামীর অন্যদিকে মনোনিবেশ। কোথায় যেন হারিয়ে যায় সেই প্রথম ঘোর। শুরু হয় সব হারানো বানুর সংগ্রাম, নিজের মা বাবা তো আগেই ফেলে দিয়েছে বিয়ের মত একটা সিদ্ধান্ত একা নেয়াতে। তারপর এই হেরে যাওয়া বানু কিছুতেই তার পরিবারের মানুষদের দেখাতে চায়না, কিছুতেই না। শুধু বি কম ডিগ্রী নিয়ে যে চাকরী বানু ঢাকা শহরে পায় সেটা দিয়ে মেয়েসহ টিকে থাকা অনেক বেশী কষ্টের। মেয়ের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেয়ার সেই সংগ্রামে বানু কাকে পাশে ডাকবে, কোথাও ভালো একটা কাজের আশায় ছুটে গেলে কাজ পাওয়ার আগেই তার দিকে তীর বিদ্ধ হয়ে আসে অন্য রকম চোখ, ছুঁয়ে দিতে চায় কালো হাত।
বানুকে এই সব কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকাটা শিখে নিতে হয় শুধু মাত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। দিনশেষে বানুর অনেক বেশি ক্লান্ত লাগে, একা লাগে, কাউকে বলতে ইচ্ছে করে, এই পথ চলা বড় কষ্টের!!
একা মাকে অনুভব করার চোখের অভাব আমাদের খুব বেশী, বাংলাদেশ কিংবা পরবাসে, আমাদের মানসিকতায়। তাঁকে ঘিরে নুন্যতম সহমর্মিতা শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা না থাকুক কিন্তু তাকে নিয়ে ‘প্রশ্ন’ তোলার লোকের কোন অভাব নেই এই সমাজে।
দুই এক বছর আগে মিডিয়াতে জেনেছিলাম, ঢাকায় থাকা একজন এইরকম একা মায়ের বাচ্চা দুটো আত্মহত্যা করেছে, এই রকম একটি কষ্টের খবর জেনে যখন আমার চেনা জানা জগতের ‘একা সব মায়েদের’ সংগ্রামগুলো নিয়ে ভাবছিলাম তারমাঝেই দেখলাম কেউ কেউ বাচ্চা গুলো মরে যাওয়ার আগে তাদেরকে মা কিভাবে দামী বার্গার খেতে দিয়েছিল সেটা নিয়েই অনেক বেশি চিন্তিত!! বছরের ৩৬৪ দিন, এই রকম একজন মা তার বাচ্চাদের কি খেতে দিত, কিভাবে দিত সেটা নিয়ে কথা বলার সময় আমাদের নেই, আছে মায়ের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার।
আমি আসলে এই লেখা দিয়ে কিছুই বলতে চাইছিনা, শুধু জানাতে চাই আমার মনের আকুতি, ‘মা’ তোমার সন্তান যেন তোমাকে অন্তত শ্রদ্ধা করতে শেখে, ভালোবেসে পাশে থাকে আমৃত্যু সেই শুভকামনা কোন না কোন কারণে ‘একা হয়ে যাওয়া সকল মাকে!!
মা দিবসের জন্যে নয় এ লেখা, অনেক আগেই এমন কিছু লিখেছিলাম আসলে। আজ নূতন করে আরো একবার নিয়ে এলাম আরো দুই একটা কথা আমার পাঠকদের সাথে শেয়ার করবো বলে…
আমি মনে করি আমাদের সবার কাছে সবার মা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আহ্লাদের, আব্দারের জায়গা, ভালোবাসার তো বটেই। সেই জন্যেই মা মানেই নির্ভরতা এবং সবচেয়ে বড় আবেগের নাম আমাদের সবার জীবনে।
তবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই পৃথিবীর সব মা – ই মানুষ হিসেবে সবচেয়ে পরিপূর্ন বা সম্মানের। আমাদের মা দিনশেষে একজন সাধারণ মানুষই, সেই মানুষ হিসেবে তাঁর অন্য অনেক ভুমিকায় তাঁকে একেবারেই ভিন্ন রূপে দেখা যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।
তারপরও বলি, জগতের ‘’মাতৃস্নেহ’’ বলে যে বিষয়টা আছে সেটি সকলকে ঘিরে থাকুক, সে নিজের জন্মদাত্রীই হোক বা অন্য কোন মায়ের মধ্য দিয়ে হলেও।
হ্যাপি মাদার্স ডে।
নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।