একের মধ্যে আট : অর্কের ছবি । জন মার্টিন

  
    

আমার দিদিমা কাঁথা সেলাই করতো। সুতোর একটি ঝুড়ি ছিল। আর ঝুড়ি ভরা ছিল নানা রঙের সুতোর রীল। দিদিমা চেষ্টা করতো – সুতোগুলো আলাদা করে রাখতে। কিন্তু সুতো কি আর দিদিমার কথা শুনে? নানা রঙের সুতোগুলো লেপটে গিয়ে জট বানিয়ে ফেলত। কিন্তু দিদিমা তো হাল ছাড়ার মানুষ না। একটা একটা করে রঙিন সুতোগুলোর মাথা বের করে সুঁই-এর ছোট্ট ছিদ্রতে ঢুকাতো। তারপর সেই সুঁই দিয়ে কাঁথায় গল্প লিখত। কখনো লাল সুতোর মাথা ছিঁড়ে সবুজ সুতোর জট খুলত। আবার হলুদ সুতোর মাথা ধরে আস্তে আস্তে কালো সুতোর ভিতর থেকে বের করতো। দিদিমার হাতে সেই সুতাগুলো যেন রঙের ব্রাশ। আর সেই ব্রাশ দিয়ে কাঁথার ক্যানভাসে ছবি আঁকা হতো।

Here out west সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি- সংগ্রহ

ছোটবেলার সেই গল্পগুলো সেদিন অর্ক মনে করিয়ে দিল। অর্ককে চিনলেন না? আমাদের বাঙালী ছেলে। ওদের একটি দল আটটি ছোট ছোট গল্প জোড়া দিয়ে একটি সম্পূর্ণ সিনেমা বানিয়েছে এবং সেই সিনেমা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সিনেমা হলে চলছে। ছবির নাম Here Out West. ভাবছেন আটটি ছোট গল্প দেখবেন? আরে না। অর্কদের মুনশিয়ানা তো সেখানেই। মোট গল্প আটটি। লিখেছে আটজন। অনেকগুলো চরিত্র । কিন্তু সিনেমা হয়েছে একটি। ওই যে আমার দিদিমা যে ভাবে নানা রঙের সুতোর জট ছাড়িয়ে সুঁই দিয়ে কাঁথায় ছবি আঁকত, ঠিক তেমনি অর্করা গল্পের সুতোগুলো চমৎকার ভাবে একটু একটু করে বেড় করে ফিল্মের ফ্রেমে সাজিয়েছে। আর তৈরি করেছে একটি সম্পূর্ণ গল্প। সিনেমা হলে বসে আপনি আটটি নয় – একটি গল্প দেখবেন। আর চরিত্রগুলো একজন আরেকজনের সাথে কি চমৎকার ভাবে লেপটে গিয়েছে। কোথাও ধাক্কা লাগবে না, কোথাও হোঁচট খাবেন না। একটি গল্পের রেশ ধরে যখন আপনার মন এগুচ্ছে – ঠিক তাঁর মাঝখানে অন্য একটি নতুন গল্পের চরিত্র আপনাকে একটু ডানে, একটু বামে নিয়ে যাবে। একসময় আপনি হয়ত অধৈর্য হয়ে  ভাববেন, ‘আহা সেই প্রথম গল্পের ওই মানুষটি কই? আর ওই বাচ্চাটির কি হোল?’  ঠিক তখনই প্রথম গল্পের সেই সুতো টুপ করে দ্বিতীয় গল্পের সাথে মিশে যাবে। আপনি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবেন। তারপর গল্প এগিয়ে যাবে। কখন যে দেড় ঘণ্টা পাড় হবে – আপনি টের পাবেন না। গল্প বলার এই ধারাটি নতুন নয়। অনেক ছবিতে দেখেছি। কিন্তু অর্কদের এই মুনশিয়ানা আমার খুব ভাল লেগেছে।

খেয়াল করবেন যে আমি বার বার বলছি যে এটা অর্কদের দল। আসলে ছবি বানানোর এই দলে আমি অর্ক ছাড়া আর কাউকে চিনি না। তাই পুরো দলটিকেই বলছি অর্কদের দল। কিন্তু এই দল ওর একার নয়। আটজন তরুণ লেখক মিলে এই ছবিটির গল্প লিখেছে। প্রত্যেকে জড়ো করেছে ওদের নিজেদের গল্প আর সৃজনশীলতা। যোগ দিয়েছে অভিজ্ঞ নির্দেশকের দল। ব্যাস … ব্যাটে বলে লাগলে যা হয় এই সিনেমায় ঠিক তাই হয়েছে।
গল্পগুলো কত লম্বা? উহু…। আটটি গল্প ষোল লাইনে লিখে দেয়া যাবে। কিন্তু কি চমৎকার ভাবে গল্পের চরিত্রগুলো একটু একটু করে স্ক্রিনে ঢুকে আমাদের গল্পের সরু অলিগলিতে নিয়ে গিয়েছে। সিডনির দেয়ালে ঢাকার মত ‘চিকা’ মারা হয়। এখানে ওটাকে বলে গ্রাফিটি। এই ছবির পুরোটাই শুটিং হয়েছে সিডনির ওয়েস্ট-এ। এখানে অনেক দেয়ালে অমন গ্রাফিটি আছে। সিডনির এই অংশের কথা শুনে অনেকেই হয়ত নাক সিটকায় । কারণ এখানে অধিকাংশ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিবাসন নিয়ে থিতু হয়েছে। তাহলে এই ওয়েস্ট এর গল্প তো আমাদের গল্প দিয়ে ভরা থাকবে। অর্কদের সিনেমায় ঠিক তাই হয়েছে। ওখানে অভিবাসীদের গল্প বলেছে একদল তরুণ। এক গল্পের ভিতর যখন অন্য গল্প ঢুকে যায় তখন ওই গ্রাফিটির মত গল্পের নামটি হালকা করে ভেসে আসে। ভীষণ নান্দনিক ছিল।
বড় পর্দায় যখন দেখি যুদ্ধ এড়িয়ে এক ছেলে কি ভাবে কাজিনকে কোলে করে পালিয়ে এসেছে, কিংবা হাসপাতালের ছোট্ট একটি রুমে সুযোগ পেলেই কয়েকজন নার্স নিজেদের ভাষায় কথা বলায় মেতে উঠে, অথবা মিউজিক এর স্কুল না বানিয়ে দাতে দাঁত চেপে দালান বানানোর মিস্ত্রীর কাজে যেতে হয়- তখন কেন জানি আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। কোন গল্প, কোন দেশের সেটা আর আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা কেবল দেখি শেকড় ছেড়ে আসা কতগুলো মানুষের হৃদয়ের আকুতি।

আর ওই যে বুড়ো মানুষটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলল, ‘আমি আমার দেশের বাড়িতে গিয়ে মরতে চাই’। বুকের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। এই এত বছর এমন সুন্দর দেশে থেকেও সেই বুড়ো হাসপাতালে জীবনের শেষ মুহূর্তে আকুতি জানাল। আর ওই যে ভিনদেশী এক মেয়ে ভাঙ্গা বাংলায় গাইল, ‘তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ’। রবি ঠাকুরের ‘রাজা’ নাটকে নাচের দল উৎসবের আমেজে এই গানটি গেয়ে নেচেছিল। গান শুরুর আগে ঠাকুরদার সংলাপটি ছিল, ‘তোমাদের দেখলেই পা দুটো ছটফট করে। একবার নাচিয়ে দিয়ে যাও’।

Here out west সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার, পরিচালক। মাঝে অর্ক। ছবি- সংগ্রহ

অর্কের গল্পে মৃত্যুর দুয়ারে দাড়িয়ে এক বৃদ্ধের প্রাণ যখন দেশে ফেরার জন্য ছটফট করছিল – তখন এমন আনন্দের গান দিয়ে কি শেষ বিদায় দেয়া যায়? হ্যাঁ যায়। লেখনী আর নির্দেশনা যখন পাকা কারো হাতে পড়ে তখন সাধারন দৃশ্য অসাধারণ হয়ে উঠে। আমাদের মন ভিজে, কারো কারো চোখ ভিজে উঠে। আর সব গল্প ছাপিয়ে এই গল্পটি বাঙালী অভিবাসীদের বুকে বসে থাকে। আমি ছবিতে কেবল অভিনেতা অর্ককে দেখি না। আমি দেখি ওর বেড়ে উঠা। অর্ক সিডনি’র কোন বাংলা স্কুলে গিয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু ওর বাবা-মা আদর দিয়ে বাংলা নামের যে বীজটি ওর মনে গেঁথে দিয়েছিল – সেটা এখন বড় গাছ হয়ে উঠছে। বেশ টের পেলাম। মায়ের সাথে অর্ক যেমন বাংলায় কথা বলেছে – অন্য চরিত্রগুলো ওদের মায়ের সাথে ওদের ভাষায় কথা বলেছে। আমি ধারনা করি আমরা বাংলা শুনে যেমন আপ্লুত হয়েছি – অন্যেরাও ওদের ভাষা শুনে আপ্লুত হবে।
সিডনি’র ওয়েস্ট মানে সাদামাটা কতগুলো শহর নয়। এখানে জড়ো হয়েছে নানা ভাষার, নানা রঙের মানুষ। আর গল্পগুলো তাই এমন রঙিন। সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি এবং ছবি দেখতে গিয়ে কোথাও ধাক্কা খাইনি। আর প্রত্যেকে চমৎকার অভিনয় করেছেন। আমার তো মনে হয় এই ছবিতে কেউ অভিনয় করেননি। নিজেদের গল্প নিজেদের মত করে বলেছেন।

তরুণ এই দলে যারা আছেন তাঁরা হলেন Arka Das, Vonne Patiag, , Dee Dogan, Bina Bhattacharya, Matias Bolla, Nisrine Amine, Claire Cao and Tien Tran
আমি এর মধ্যেই ঢোল ভাড়া করে জানান দিয়েছি যে ছবিটি সবার দেখা দরকার। সিডনি’র বিভিন্ন হলে এখনও চলছে।

ছবিঃ Here Out West
আমার রেটিং: ৮/১০
পুনশ্চ: দশে আট কেন দিয়েছি – সেটা বলেছি। আর দুই কেন কম দিয়েছি? আপনি ছবি দেখার পড় সেটা বলব। এখন ছবিটি দেখুন।

জন মার্টিন
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments