
একজন মেয়ে, যার বেড়ে উঠার প্রায় পুরোটাই দেশের বাইরে,ভিন্ন এক পরিবেশে। পড়াশোনা ভিন্ন ভাষায়। খুব অল্প সময়ের জন্য দেশে পড়াশোনা করলেও, উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আবার প্রবাস জীবনে ফিরে যান। এরপর ১৮ বছরের প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে পাকাপোক্ত হতে চলে আসেন। আমি বলছি এমনি একজন নারীর কথা, একজন মায়ের কথা, একজন শিক্ষকের কথা এবং সর্বপরি একজন গবেষকের কথা। তিনি ড. ইয়াসমিন হক। যিনি নিজ গুণে গুণান্বিতা একজন নারী। স্বনামেই যিনি ধন্য। তবুও আমাদের অধিকাংশের কাছে তিনি শুধুই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সহধর্মিণী।
বাবার কর্মস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পড়াশুনা করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে করে দেশপ্রেম অথবা বাংলা ভাষার প্রতি টান কিংবা মমতার কোনো কমতি ছিল না এতটুকুও। কারণ তাঁর পারিবারিক শিক্ষা তাঁকে শিখিয়েছিল, কোথায় তাঁর শিকড়। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২-১৯৭৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পড়াশোনার সেই সময়টাতেই ড. জাফর ইকবালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
এরপর ১৯৭৬ সালে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, সিয়াটল থেকে পদার্থবিজ্ঞানেই পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে ড.জাফর ইকবালকে বিয়ে করেন। অতঃপর দুই সন্তানের জননী। দীর্ঘ ৮ বছর সন্তানদেরকে পুরোপুরি মাতৃস্নেহ দেয়ার জন্য ক্যারিয়ার থেকে দূরে থাকেন। উনার ভাষায়- ‘I had highly unpaid job for eight years only for my kids.’ যা নিয়ে তাঁর মধ্যে কোন দ্বিধা বা অনুসূচনা নেই। কারণ, তিনি নিজেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। এটাই ছিল সেই সময়ে তাঁর কাছে জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

এরপর ১৮ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ১৯৯৪ সালে ড. জাফর ইকবালের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে দেশে চলে আসেন। দেশে এসে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর শুরু হয় তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। শিক্ষকতা করতে গিয়ে বহু চড়াই উৎড়াই পার হতে হয়েছে এই দম্পতিকে । আঘাত এসেছে বার বার । কিন্তু অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে দু’জনে তা মোকাবেলা করেছেন। জীবনের এক পর্যায়ে নিরাপত্তার খাতিরে, তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিজেদের কাছ থেকে দূরে রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। যে মা তার সন্তানদের জন্য নিজের ক্যরিয়ার বিসর্জন দিয়েছিলেন, তাঁর জন্য সন্তানদের দূরে রাখা কতখানি কষ্টসাধ্য কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছয়-ছয়টি বছর সন্তানদেরকে ঢাকা রেখে তারা সিলেটে জীবনযাপন করেছেন।

ড. ইয়াসমিন হকের ভূমিকা শুধু শিক্ষকতায় থেমে থাকেনি। তিনি জাহানারা ইমাম ছাত্রী হলের প্রভোস্ট হিসেবেও অনেকদিন দায়িত্ব পালন করেন। যে কারণে তিনি ছাত্রীদের অনেক বেশী কাছের মানুষ ছিলেন। পড়ানোর পাশাপাশি ছাত্রীদের মনন-মানসিকতা বিকাশেও কাজ করেছেন। জীবনের কোনো অবস্থায়ই একজন মেয়ে যেন পিছিয়ে না পড়ে, নিজ পরিচয়ে যেন একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, সে ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। বিদেশে পড়তে যাবার ব্যাপারে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি এ ব্যাপারে কারো বাসা থেকে বাঁধা এলে, নিজে তাদের অভিভাবকদেরকে বুঝিয়েছেন, যেন মেয়েকে বিদেশ পড়তে যেতে বাঁধা না দেয়া হয়। এছাড়াও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় ড. ইয়াসমিন হকের অবদান অসামান্য।
ড. ইয়াসমিন হকের আরো একটি পরিচয়, উনি একজন গবেষক। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক দল গবেষকের উদ্ভাবিত ক্যান্সার শনাক্তের পদ্ধতি নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সেই গবেষক দলের প্রধান ছিলেন ড. ইয়াসমিন হক। এটা স্বল্প সময় ও খরচে করা সম্ভব হবে। ১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া দীর্ঘ ২২ বছরের সাধনার ফল এই উদ্ভাবন। এ খবর আশা জাগিয়েছে দেশবাসীর মনে। সেই সঙ্গে উজ্জ্বল হয়েছে দেশের ভাবমূর্তিও। এই উদ্ভাবনের জন্য অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে, চিরদিন।
যত সহজে এই এক জীবনের গল্পটি বলে ফেলা হলো, সেই জীবনের পথচলাটা কি এতই সহজ ছিল? না, তা ছিল না। কিন্তু তিনি পাড়ি দিয়েছেন-দুর্গম, মরু কান্তার দুস্তর পারাবার। একজন স্ত্রী, একজন মা, একজন শিক্ষক, একজন গবেষক এবং একজন আবিষ্কারক, যেদিকেই তাকাই না কেন, কেবলই তাঁর সফলতার সোনালী আবীরে উদ্ভাসিত হয়ে যায় আকাশ। এমন একজন মানুষের জীবন ও দর্শন যে কোন মেয়ের জন্যই হতে পারে অনুসরণীয়।

[…] হকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইয়াসমিন হক বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও […]