তোমাকে আমরা মনে রাখবো নোটন। মনে রাখতে হবে। একটা মফস্বল শহরে তোমার মতো উজ্জ্বল, এমন তেজোদীপ্ত মানুষের বড্ড অভাব। তোমার শূণ্যস্থান পূরণ হবে না। হয় না। তোমার মতো নোটনেরা বহুবছর পর, কখনোবা একজীবনে একবারই আসে।
তুমি আমাদের সহযোদ্ধা, বন্ধু, স্বজন। সংসার পরিজন ছেড়ে, চেনা চারপাশের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে, পথে নামার প্রথম সাহস ছিলে তোমরা। সেই তোমরার মধ্যে তুমি ছিলে অগ্রগণ্য।
মনে আছে, সংগঠনের রুম ছিল না। আমরা রিহার্সেল দিতাম এখানে-সেখানে, এর ওর বারান্দায়-ঘরে, গ্যারেজে-মাঠে। তোমাদের বাসা থেকে ছাড়তে চাইতো না। তোমরা লুকিয়ে লুকিয়ে, বুদ্ধি করে, মিথ্যে বলে- ঠিকই আসতে। মুখ ভার। চোখে মুখে কষ্ট। সব বুঝতাম। তোমরাও বুঝতে। কাজ শেষে যখন ফিরতে, তখন হাসতে। প্রতিদিন, প্রত্যেকটা বেলায়, আমাদের বিদায় নিতে খারাপ লাগতো। কষ্ট লাগতো। এভাবেই দিন দিন আমরা যুথবদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। এভাবেই আমরা পাঁজরে পাঁজর রেখে রচনা করেছি ভালবাসা। প্রগতির চাকা এভাবেই একদিন আলোকিত করে তুললো আমাদের। আমরা ব্যক্তি থেকে সামস্টিক হলাম। এক নোটন ছড়িয়ে পড়লো হাজার নোটনে। আমাদের মুখে চোখে উচ্চারিত হলো সমুদ্রের কল কল ধ্বনি। সেই যুদ্ধে, সত্যি করে বলছি নোটন, তুমি ছিলে দৃঢ় এক মানুষ। তোমার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
আমাদের সময়গুলো ভালো যাচ্ছে না। সংসারে সুখ নেই। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত। অভাব অনটন। মানষিক দৈণ্যতা ভীষন পীড়া দেয় আমাদের। আগের মতো আর শক্ত হতে পারি না। সামান্য আঘাতেই বুকটা ভেঙ্গে আসে কান্নায়। রাতে যখন বিছানায় যাই, বিষন্ন দুপুর বা বিকেলে, বানের মতো হু হু করে ভেসে আসে বেদনা। আমরা কাঁদি। নিরবে নিভৃতে রচনা করি আপন যাতনা। কে দেখে, কে নেয় কার খোঁজ। মানুষকে ভালবাসবো বলে সেই যে বেরিয়েছিলাম পথে, সেই মানুষই এখন পিঠটান দিয়ে পেছন ফিরে চলে যায় আপন গন্তব্যে।
আমাদের সংগঠনের একটা রেওয়াজ ছিল। আমরা অহঙ্কার ভুলেছিলাম। এক মেঝেতে এক পরিবারের সমান মুখ নিয়েই বসতাম মহড়ায়। তোমরা অলঙ্কার পড়তে না। না দামি পোষাক, সাজসজ্জা। রাস্তায় কখনো কারো সঙ্গে দেখা হলে চারপাশ ভুলে আমরা চিৎকার জুড়তাম স্বজন দেখার আনন্দে। ব্যক্তিগত কষ্টগুলো আমরা সমান ভাগ করে নিতাম। চোখের দিকে তাকিয়ে নির্দিধায় বলে দিতে পারতাম গল্পের রঙ।
তুমি টিপ পড়তে। ছোট টিপ। তোমার বর্ণ ছিল কালো। চোখ কালো। কালো কাজল দিতে চোখে। রঙ নিয়ে মন খারাপ করতে মাঝে মধ্যে। আমরা হাসতাম। তোমার ওই রঙ ভীষন প্রিয় ছিল আমাদের। কালো চোখ নিয়ে যখন তাকাতে, মুক্তোর মতো সাদা দাঁতে হাসতে, ব্যপ্ত সংকট কেটে যেত আমাদের। আমরা সাহসী হতাম। শক্ত হতো বন্ধন। বুনোযুদ্ধ পণে আমরা ফের নামতাম পথে। তুমি জানতে না, ওই কালো টিপ, কালো রঙে, তোমাকে কী অপূর্ব সুন্দর লাগতো। তোমার অমন রূপ রঙ হাসি আমাদের সমস্ত বেদনা ভুলিয়ে দিতো।
তোমাকে কখনো রাগতে দেখিনি। রাগতে না। শব্দ করে কথা বলোনি কখনো। এমনকি একেবারে অপছন্দের যে মানুষ, তাকেও মিষ্টি করেই জানাতে তোমার পছন্দ-অপছন্দ। ছোট ছোট মিষ্টি ওসব কথা, শব্দ, বাক্য- ভালবাসার দরজা খুলে দিত। আমরা ডুব দিতাম। তুমি ছিলে আমাদের ভালবাসার এক হাঁটু জল।
তুমি গল্প বলতে না, বুনতে। আমরা তোমার সুষমায় শক্তি পেতাম। নতুন পরিকল্পনার সাহস হতো আমাদের। বকা তো দূরে থাক, একটু রেগে কথা বললেই চকচক করে উঠতো তোমার কালো চোখ। চোখ নামিয়ে নিতাম আমরা। ছলছল জল আমাদের মন খারাপ করে দিত। এই যেমন এখন, তোমাকে হারিয়ে ভীষন মন খারাপ আমাদের নোটন, ভীষন।
একবারই কাঁদতে দেখেছিলাম, মাত্র একবার। একান্তই গোপন, ব্যক্তি ছিল সে কান্না। চোখ ধরে রাখতে পারিনি। তোমার জল ছুঁয়েছিল আমাকেও। মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে আমিও কেঁদেছিলাম হু হু করে। আমরা তো এক সংসারের এক উঠোনের ভাগিদার মানুষ নোটন। এই যে এখন আমরা কাঁদছি, বলো, তোমার মতো এত মুগ্ধ ভালবাসা নিয়ে কে মোছোবে এই চোখ, জল! তোমার জন্য বুকের ভেতর ওঠা ঝড় কে থামাবে আমাদের নোটন! আমাদের মলিন মুখ কে ধোয়াবে তোমার পবিত্র জোস্নাজলে!
তোমার আপদমস্তক মুখস্থ আমার, আমাদের; আদ্যোপান্ত চেনা। কথা কম বলতে বলে ভয়টা বেশি ছিল। আমি বুঝতাম। যতদিন আমরা কাজ করেছি, তোমার গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়তে দেইনি কোনদিন। দৃষ্টির সংসারে তুমি ছিলে আমাদের লক্ষীমন্ত বোন। আগলে রাখতাম আদরে, ভালবাসায়।
দুপুরে যখন সাথী ফোন করে জানালো, নোটন নেই। মেয়েটা কাঁদছিল। আমি কাঁদিনি। রিকসা চলছে। রাস্তায় হইহুল্লোর হর্ন ভীড় বাড়ছে। আমি ভুলে যেতে চাইলাম সব। কায়মনে চাইলাম, শব্দে শব্দে বাতাসে শোকে দীর্ন শব্দগুলো ভেসে যাক অজান্তে। এ বুকচেড়া খবর আমাদের না, কারো না। আমরা তো আমাদের কালো মেয়েকে বুকের ভেতর রেখেছি পরম যত্নে। এ খবরে আমার কাজ নেই। এক জ্যামে হঠাৎ থামলো রিকসা। আমি দূরে তাকাই। কিছুই দেখি না। চোখ ভরা জলে তখন কেবলই তুমি। এমন তাড়া নিয়ে, এমন সাতসকালে, এভাবে কাঁদিয়ে কেউ যায়, নাকি যেতে আছে, বোন!
অনেক যন্ত্রনা ছিল তোমার। অনেক কষ্ট। সংসারের যাপিত জীবনে খুব এলোমেলো ছিল সব। তুমি বলতে না। আমরা বুঝতাম। তুমি তবুও হাসতে। আগের মতোই মিষ্টি করে হাসতে। কষ্টগুলো বুকের ভেতর চাপা দিয়ে এমন মুখর হাসি, তোমার মতো আর কে হাসতে পারে, বলো। এই যে তুমি চলে গেলে, হঠাৎ পাড়ি দিলে শূণ্যে আমাদের সবাইকে রেখে, এখন সেই হাসি, জোস্নামুখ, আমাদের বুকের ভেতর কেবলই বেদনার ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। আমাদের সজল চোখ তোমাকে আঁকছে নোটন। তুমি যে আমাদের বুকের ভেতর একঘর সুখবসন্ত।
অনেকদিন ধরেই সংগঠনে তেমন কোন কাজ হয় না। নিয়ম করে ফোন দিতে পারি না। খোঁজ নিতে পারি না। তবুও একটা টান অনুভব করি। রাত-বিরাতে, কোন এক বিকেল বা দুপুরে, তোমরা আসো মনে, থাকো। সেই সুখসামন্তির সংসারে তুমিই প্রথম ভাঙন ধরালে নোটন। তুমিই প্রথম বেদনার রেখাপাত আঁকলে আমাদের নির্ভার চোখেমুখে। তোমার শিশুর মতো মুখ, হাসি, উজ্জল চোখের দ্যুতি- আমরা মনে রাখবো, বহুদিন মনে রাখবো। তুমি আমাদের শিখিয়ে গেলে, কিভাবে হাসতে হাসতে, সবাইকে কাঁদিয়ে, শৈশবের জলে ভাসা ভেলার মতো চলে যেতে হয় দুরে, বহুদুরে, চির নির্বাসনে!
সুজন মাসুদ বলছিলো, তুমি যখন কফিনে শুয়েছিলে, তোমাকে ঘুমের মতো লাগছিলো। ঘুমুচ্ছিলে। অচেতন পড়েছিল শান্ত নিষ্পাপ তোমার দেহ। কপালে কয়েকটা রেখা। চিন্তা করছিলে বুঝি। মায়ের জন্য? মা-টাও তোমার দশদিন আগে চলে গেল। ছোট মেয়ে দুটো ঘুরছিল। কাঁদছিল। ওদের কথা খুব মনে পড়ছিল নিশ্চয়। কে জানে, এমন আঁকাশ কাপানো ঝড় অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। এক লহমায় এসে সব ভেঙেচুরে নিয়ে গেল। লন্ডভন্ড। বিক্ষুব্ধ এমন কালবেলা, কবে মুছবে, কিভাবে, জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, তোমাকে হারানোর অপার বেদনা বহুদিন বহুবছর বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। যাপিত জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলো তুমি হয়ে ঘুরবে মুখে মুখে, চোখে চোখে, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনায়।
মঞ্চে তোমাকে বেশ উজ্জ্বল দেখাতো। একটা ধরণ ছিল আলাদা। স্লোগান উচ্চশব্দের বাক্যগুলো তুমি বলতে পারতে না। একেবারে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা অনুচ্চারিত অস্পষ্ট বেদনাগুলো তুমি উচ্চারণ করতে সুনিপুনভাবে। তোমার চোখ কথা বলতো। সেই প্রথম আমরা বুঝতাম, মানুষের ভেতরের কষ্টগুলো বলার জন্য আলাদা মানুষ চাই। তুমি আমাদের সেই আলাদা প্রতিভু ছিলে নোটন। তোমার সহজ সরল অভিব্যক্তি বহুদিন বহু পাপ থেকে আমাদের বিরত রেখেছে। আমরা নিজেদের শুধরিয়েছি তোমার মতো হতে। আমরা তো তুমি-ই। তা না হলে কার সাধ্য এমন অবেলায় বলা নে্ই কওয়া নেই হুট করেই যাত্রা করলে নিমিষে নিরুদ্দেশে।
সংগঠনের প্রতি, আবৃত্তি-সংস্কৃতির প্রতি, ঘরে-বাইরে, বহি-অন্তরলোকে- তোমার আজন্ম ঋণ কোনদিন শোধরাতে পারবো না আমরা। এ ঋণ শোধরানোর নয়, যায় না। কিছু কিছু ঋণ, মুখ, ভালবাসা- বুকের ভেতর রাখতে হয় যত্নে, থাকে পরম আদরে, নির্ভরতায়। তুমি আমাদের পরম ভালবাসার সবুজ আশ্রয় নোটন।
তোমাকে অভিবাদন। তুমি আমাদের সত্যিকার নেতা, অবিচল সহযোদ্ধা। বুকের ভেতর কান্না চেপে, দুহাতে আড়াল করে জল, বেদনা, তুমি আমাদের সাথে পথে নেমেছিলে বলেই- আজ আলো দেখি, মানুষ দেখি। আমাদের ছোট সংসারে সবার সঙ্গে মিলে তুমি এনেছিলে পূর্ণতা। তুমি আলোকশিখা।
চোখের জলে আজ তোমাকে আমাদের শেষ প্রণতি জানাই ভাই। আমাদের ক্ষমা করো। তোমার শেষযাত্রায় তোমার পায়ে সপে দিলাম আমাদের অশ্রুঅর্ঘ্য। ভালো থেকো ভাই। তোমাকে আমরা ভীষন ভালবাসি।
(রেশমা সরকার নোটন। সদস্য, দৃষ্টি বগুড়া জেলা শাখা। মৃত্যু: ১৬ নভেম্বর শনিবার ২০১৯, বিকেল ৩টা, বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জন্ম: ঠনঠনিয়া, বগুড়া)
প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী।
ঢাকা। ১৬ নভেম্বর শনিবার ২০১৯।