এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে – অজয় দাশগুপ্ত

  
    
এমন না যে আমি তার লেখা খুব পড়েছি বা তার সম্পর্কে খুব একটা জানতাম। হাওয়ায় কিছু নাম কিছু মুখ আপনাতেই ভেসে আসে। যাদের আসে তারা নিজগুণে খ্যাত। তাদের এমন প্রভাব তারা দেশ কাল সীমানা পেরিয়ে দেশে দেশে হানা দেয়। সাদাত হোসাইন তেমনি এক তরুণ লেখক। প্রশান্তিকার দুই সহোদের প্রিয় ভাজন আতিকুর রহমান শুভ আর আরিফুর রহমান কবে থেকেই বলছিলেন তারা এই লেখককে নিয়ে নান্দনিক একটা কিছু করবেন। তাদের উৎসাহ আর বিশ্বাসই বলে দিচ্ছিল তারা নিশ্চিত কি হবে আর তারা কি করবে তা তারা জানে। পরে যখন মুক্তমঞ্চের আল নোমান শামীম যুক্ত হলো বুঝে নিলাম বড় কিছু হতে চলেছে।
সিডনিতে লেখকদের নিয়ে অনুষ্ঠান নতুন কিছু না। এর আগে স্বনামধন্য কিংবদন্তী তূল্য লেখকরাও ঘুরে গেছেন । সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের সভাটি ছিলো জনাকীর্ণ। জনপ্রিয় এই লেখকের অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ হয়েছিল । সমস্যা একটাই ওপার বাংলার আয়োজকেরা তাদের অনুষ্ঠান সাজান পাড়ার ক্লাবের মত। এরপর এই এরপর ওই ব্যাস শেষ। মাঝে অবশ্য প্রশ্নোত্তর পর্ব বলেও একটা ব্যাপার রাখেন যা না হলে দর্শক কমার সম্ভাবনা থাকে বলেই করা। এরপর সমরেশ মজুমদারের অনুষ্ঠানে গিয়ে মর্মাহত হয়েছিলাম দর্শকের স্বল্পতায়। তবে আমার মন ভরিয়ে দিয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
এদিকে আমাদের দেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক নামে পরিচিত আনিসুল হকের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি নিজে মার্জনা চেয়েছিলাম লেখকের কাছে। গোটা পনের লোকের মাঝখানে তাঁকে দেখে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, বিশ্বাস করেন আপনার জনপ্রিয়তা অনেক বেশী। এই সমাগমের জন্য আপনি থোড়াই দায়ী। কবি নির্মলেন্দু গুণের অনুষ্ঠানেও আশাপ্রদ সমাগম বা মানসম্মত তেমন কিছু দেখিনি। অথচ সাদাত হোসাইনের মত সদ্য জনপ্রিয় লেখকের সভায় জনসমাগম আর পুরো আয়োজনটাই ছিলো ভিন্ন ধরণের। পাঠক যে তাঁকে কতটা নিয়েছে বা কতটা নেয় তার প্রমাণ মিলেছে তাদের প্রশ্নবানে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই তরুণের গল্প বলার অসীম শক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আমরা যে শহরে থাকি  এখানে দরিদ্রতা উৎকট না। দরিদ্র বাস্তুভিটাহীন মানুষ যারা দোকানের পাশে বা শপিং মলে ষ্টেশনে ঘুমায় তাদের গায়েও থাকে ব্র্যান্ডের শার্ট। তাদের মাথার কাছে থাকে ডিজিটাল ঘড়ি রেডিও। তারা পিজ্জা বার্গার কোক খেয়ে ঘুমায়। এমন শহরে বাংলাদেশের গন্ডগ্রামের নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের করুণ জীবনকাহিনী বলে চোখে জল আনা সহজ ব্যাপার না। কিন্তু সাদাত পেরেছেন। তার গল্প বলার ভেতর যে সত্য আর রসিকতা তা আমরা দেখেছি বড় বড় লেখকদের বেলায়। বিশেষত নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা ও রসিকতা করতে পারা মানুষরাই মূলত রসিক। এদের বেদনাও হয়ে ওঠে আনন্দের কাব্য। নিজের নাম ছাপার হরফে দেখার আকুলতায় সাদাত যা করেছিলো তার তূলনা মেলা ভার। খেয়া ঘাটের মাঝি হতে চাওয়া লেখকের চলচ্চিত্র নির্মানের কাহিনীও অসাধারণ।
 এখন সময় তার সামনে যাবার। জনপ্রিয়তার দুটি দিক থাকে। একদিকে তা মানুষকে আরো বড় কিছুর দিকে ধাবিত করে অন্যদিকে তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতেও দ্বিধা করেনা। সে সন্ধ্যার আয়োজনে কোন এক অজ্ঞাত কারণে  আয়োজকরা আমাকেও কিছু বলতে দিয়েছিলেন। আমি খুব ভালো বলতে পারিনা তাও আবার এমন গুণী মানুষদের ভীড়ে। আমার পাশেই বসে ছিলেন নাট্যকার জন মার্টিন, আবৃত্তিশিল্পী শীর্ষেন্দু নন্দী, সিডনি বইমেলার পুরোধা নেহাল বারী।  আমার বলার ভাষা কেড়ে নেয়ার জন্য এরাই যথেষ্ট। আমি শুধু সে ক্লাসিক গল্পটি মনে করিয়ে দিয়েছি। যেখানে টলস্তয় বলেছিলেন কবিতা হলো নদীর এধার থেকে দেখা আবছা কোন গ্রাম। আর ছোটগল্প নদী পেরিয়ে গ্রামটির কাছে দাঁড়ানো। উপন্যাস গ্রামটি ঘুরে ঘুরে দেখে তাদের জীবন নিয়ে লেখা। সাদাত হোসাইন লেখেন ঢাউস সব উপন্যাস। তাকেতো একথা মনে রাখতেই হবে।
আমাদের দেশে গদ্য পদ্য কোন শিল্পেই মৌলিক লেখক বা কবি বড় হয়ে উঠছেনা আজকাল। সাদাত হোসাইন তার মেধা ও যোগ্যতায় সে জায়গায় আশার আলো ফেলছেন। এবং তা বেশ প্রখর। আশা করতেই পারি বিনয় ও অভিজ্ঞতার সাথে পাঠ মিলে তাকে পৌঁছৈ দেবে আরো বড় কোন উচ্চতায়। যে কারণে গর্ব করে বলবো, জানো এই লেখক একসময় সিডনি এসে চলে যাবার দিন আমাকে ফোন দিয়েছিলেন।
সাদাত হোসাইনকে নিয়ে প্রশান্তিকার আয়োজনে রাজিতের সরোদ বাদন যে আবহ তৈরী করেছিল সে আবহ নিয়েই ঘরে ফিরেছি আমরা। মাঝখানে দু একটা অনিয়ম অতিকথন বাঙালির স্বভাবজাত সমস্যা। ওগুলো ভুলে যেতে পারলে আয়োজনটি যথার্থ বৈকি। গল্পের এক ভালো যাদুকর সাদাত এসে চলে গেলে মনে হতে থাকে, সত্যি কি এসেছিল এমন কেউ ?
অজয় দাশগুপ্ত
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক 
সিডনি,অস্ট্রেলিয়া।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments