এ আঁধার কাটবে -প্রতীক ইজাজ

  
    

এ এক ভিন্ন উৎসব। এ এক ভিন্ন বৈশাখ। বাংলা নতুন বছরে এ এক নির্মোহ পদার্পন আমাদের। এ বৈশাখে আমাদের কোনো আয়োজন নেই, রঙ নেই, আলোর ছটা নেই। আমরা স্তম্ভিত, মুঢ়। আমাদের চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। করোনার এই মহাদুযোগর মহামারীর কালে, এ আমাদের এক বর্ণ-শব্দহীন পদযাত্রা।
আমরা কোনো কিছু মনে করতে চাই না। স্মরণযোগ্য মুখর স্মৃতিগুলো দোলাতে চাই না চোখের সামনে। মুখস্থ গান, কবিতা, প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা স্তুতিবাক্য, আমরা ভুলে যেতে চাই। এবার এমন করেই অনুচ্চারিত থাক আমাদের মধুর উচ্চারণগুলো। যা কিছু উৎসবে আনন্দের সবই তোলা থাক অনাগত নতুন সুন্দর আগামী দিনগুলোর জন্য। আমরা কল্যানের পূজারি।
এই উৎসবে আমাদের শুধুই মঙ্গল প্রার্থনা। দেশে, বিশ্বজুড়ে, যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে, স্বজনহারা হচ্ছে যে পরিবার, যে শিশু কাঁদছে, এই প্রার্থনা তাদেরই জন্য। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে যারা লড়ছে মানুষকে বাঁচাতে, নিজে বাঁচতে, রাতভর বিনিদ্র রাত জেগে, চোখের নিচে কালি নিয়ে, যে মানুষগুলো তাকিয়ে আছে এক নতুন ভোরের আশায়, এই প্রার্থনা সেসব মানুষের জন্য। এই প্রার্থনা শক্তি ও সাহসের। এই প্রার্থনা করোনাকালকে জয় করে নতুন করে বেঁচে ওঠার সাহসী স্বপ্ন বিভোর মানুষের জন্য।
রঙ খেলার মেলায় এ বৈশাখ শক্তির আঁধার। এই যে থেমে যাওয়া হুল্লোড়, পাতার বাঁশির সুর, জারুলের ফাঁক গলে এক চিলতে মায়া এসে পড়া ভ্রুপল্লবে, এসবই তো প্রাণ উৎসারিত শক্তিময় আনন্দযজ্ঞ। বুকের ভেতর তুলে রাখা শত সহস্র মঙ্গলাচরণ, নতুন পথ দেখাবে আমাদের, সংহতি বাড়াবে। হাতের মুঠোয় হাত, শক্তপেশী, দৃঢ় পায়ের ছাপ, সবই তো অকল্যানকে মুছে ফেলে কল্যানের পথে নতুন করে দাঁড়ানোর শক্তি আমাদের। এসব বাদ্যি, দূর মন্দির থেকে ভেসে আসা শঙ্খধ্বনি, আজানের ডাক, নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ফের এসে দাঁড়াবো আরেক নতুন ভোরে, নতুন বৈশাখে।

না, ছবিটি এ বছরের না। পুরনো কোন বছরের বর্ষবরণের দৃশ্য এটি। একদিন আবার জমবে বটমূলের মঙ্গল শোভাযাত্রা।

প্রাণের ক্ষয় নেই, হার নেই। প্রাণ আনন্দময়। প্রাণ থেকেই উৎসারণ হয় রঙের, আলোর, মিছিলের। সেই প্রাণের দিব্যি নিয়ে বলছি, আমরা হারি না, হারতে নেই। আনন্দ মঙ্গলশোভাযাত্রা, বাঁধভাঙ্গা মানুষের উচ্ছ্বাস, নেচে নেচে গেয়ে গেয়ে মাতাল করে তোলা চারপাশ; এতসব সুকীর্তি বন্দনা আনন্দআবেশ, এসবই তো আমাদের প্রাণমঞ্জুরি। এসবই  স্বপ্নজয়ে যুদ্ধযাত্রায় আগুনের বর্শাফলক। সাধ্যকার আঁধারে অনাচারে অকল্যানে দীর্ঘদিন নিমজ্জিত রাখে আমাদের। আমরা সাহসী মানুষের সংহত দীর্ঘ মিছিল।
চারদিকে মানুষ মরছে। শোক আর কান্নায় ভারী আকাশ। উদ্বেগে উৎকন্ঠায় মানুষের ঘুম নেই, সুখ নেই, আনন্দ নেই। কেউ শব্দ করে কথা বলে না, হাসে না। শিশুগুলো বৃত্ত হয়ে ঘোরে। শরীরের গন্ধ নিতে, ফুলের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়তে চায় কোলে। ওষ্ঠ বাড়িয়ে দেয় একটুকরো সুখচুমুর জন্য। বায়না ধরে। বুদ্ধি ফাঁদে। বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠা কান্না নিয়ে মুখ সরিয়ে নেয় মানুষ। গোপন করে কান্না। ভিজে আসে চোখ।
আমরা এখন ঘরবন্দি। ঘরে ঘরে বাঁধা মানুষ। জানালা খুলি না। আলো দেখি না। কার্ণিশ ঘেষে যে শিরিষ গাছ, জানালার কাচে আছড়ে পড়া সবুজ পাতার শব্দেও ভয় জাগে মনে। এখন কেবলই অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ, মানুষের ফিসফাস শব্দ পাই। কথা পাই না। হাসি পাই না। মধ্যরাতে সাইরেন বাজিয়ে রাস্তায় চলা গাড়ি, আতঙ্ক ছড়ায় বাতাসে। দোকানপাট বন্ধ। সুনসান চারদিক। শবের মত নিশ্চল পড়ে থাকা পথ অনেক দীর্ঘ লাগে, শেষ খুজে পাই না।
আমাদের শরীর বাঁধা ঘরে। স্বজন দূরে দূরে, স্বেচ্ছা নির্বাসনে। আমরা বাঁচতে চাই। অন্যদের বাঁচাতে চাই। সবাই মিলে আধপেট খেয়ে, আমরা আনন্দ নিয়েই বাঁচতে চাই। দুরে দুরে, ঘরে ঘরে, আমরা কাছাকাছি, প্রাণে প্রাণে। সংকটে সম্মিলনে আমরা বেঁচে আছি ভালবাসায়, সংবরণে।
এই বৈশাখ আমাদের কাছে শোক ও শক্তির। আমরা নিশ্চল। সাহসে, সংগ্রামে আমরা যুথবদ্ধ। স্বজন হারিয়ে লালচোখ মানুষের জন্য এই বৈশাখ বেঁচে থাকার নতুন উদ্দীপনা। শোককে শক্তিতে রূপ দিতে এই বৈশাখ অনিন্দ্যশক্তির উৎস। আমরা বাঁচবো নির্মল আনন্দে। আমরা আমাদের স্বজনের হাত ধরে আবার হাঁটবো, নাচবো, গাইবো খোলা সবুজ মাঠে।
নতুন সূয উঠেছে। বাতাস বইছে। প্রাণের গভীর থেকে মানুষ গাইছে অনুচ্চারিত গান। হলুদ সবুজ সাদায় মিশে রঙের ভেলা ভাসছে আকাশে। গভীর আকুতি নিয়ে মানুষ মানুষের জন্য সাজিয়েছে প্রাণের নৈবেদ্য। এমন করে, এত গভীর আকুতি নিয়ে, কে কবে কোথায় কার জন্য সাজিয়েছে এমন মঙ্গলাচরণ!
এ আঁধার কাটবে। মেঘ সরবে। শোক কান্না ভুলে নতুন করে বাঁচবো আমরা। প্রাণময় নির্মল দেশ পৃথিবী হবে আমাদের। বাংলা নতুন বছর ১৪২৭ সন হবে মানুষের জন্য এক আলোময় উজ্বল গল্পের ইতিহাস।

প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
পহেলা বৈশাখ ১৪২৭ সন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments