
২০১০ এর ৩রা জুলাই রাত। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে রওয়ানা হবো সিডনীর উদ্দেশ্যে। বিকাল থেকে বাসায় আত্মীয় স্বজনের ভীড়, অশ্রূভেজা চোখ। সত্যিকারার্থে আমার মনের অবস্থা তখন ত্রিসংকটময়। প্রথমটি কষ্টের, কারণ শুধু দেশ নয়, পুরা মহাদেশ ছেড়ে যাবো একেবারে, দ্বিতীয়টি কিছুটা উত্তেজনার, প্রথমবার যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায় আর তৃতীয়টা গোপন বিষয় এবং সেটা গভীর শঙ্কার – আজ রাতে নক আউট পর্বে জার্মানীর মোকাবেলা করবে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল আউট হবার পরে রাম পঁচানি দিয়েছি সাপোর্টারদের, এখন প্রশ্ন হচ্ছে তুখোড় জার্মান দলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা পারবে তো ? যেভাবে গার্ড দেয় সবাই, মেসি খেলবে ক্যামনে ?এর মধ্যে আবার আর্জেন্টিনার এক জার্সি জোগাড় করেছি। সেইটা পরে দিনে রাতে ফটোসেশন করি। যদি আজকে আর্জেন্টিনা জিতে তো ওটা হ্যান্ড লাগেজে ভরে নেবো। বাল্যবন্ধু শিশির আর রোমেল সিডনীর বাদিন্দা, সমমনা আর্জেন্টাইন ফ্যান। ওদের সাথে বসে ডার্লিং হারবারে বড় পর্দায় দেখবো সেমি ফাইনাল। আন্তঃমহাদেশীয় বিশাল পরিকল্পনা!

সময় গড়ায় খেলা শুরু হয়। ভাবসাব খুব সুবিধার ঠেকছে না।
আর্জেন্টিনা প্রথম গোল খায়, আমি মনকে বুঝাই, ব্যাপার না।
তুখোড়, দুর্ভেদ্য আর ডিসিপ্লিন্ড জার্মানদের বিপরীতে আর্জেন্টাইন শিবিরকে আমার কাছে এলোমেলো লাগে। দ্বিতীয় গোল খাবার পরে আমার আশার দম বন্ধ হতে থাকে। তৃতীয় গোলের মাথায় জার্সিটা ভাঁজ করে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখি, হ্যান্ড লাগেজে করে এটা বয়ে নিয়ে যাবার আর দরকার নেই। মেনে নিতে হলো, আর্জেন্টিনা ইস ফাইটিং ফর এ লস্ট ব্যাটেল।
এয়ারপোর্টে যাবার সময় এগিয়ে আসছে। পরিবার, আত্মীয় স্বজন কাঁদে আমার দুঃখে আর আমি কাঁদি মেসির দুঃখে, কাঁদি ডাগ আউটের বাইরে থেকে ক্রমাগত চিৎকার করে যাওয়া ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার দুঃখে। ম্যারাডোনার জীবদ্দশায় কোচ হিসেবে আর মেসির জীবদ্দশায় খেলোয়াড় হিসেবে একটা ওয়ার্ল্ড কাপ পাওনা। যেই দলের সমর্থকই হোন আপনি, এঁরা যে নিঃসন্দেহে ফুটবল লেজেন্ড, এই ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই।
আমার চারপাশে সবার চোখেই পানি, চোখে পানি আরো কোটি মানুষের, সারা পৃথিবীময়। যাই হোক , কান্না তো কান্নাই, ভাগ্যিস কে কার জন্য কাঁদছে এটা চোখের পানিতে ধরা পড়ে না ! পড়লে আমি বিরাট বেইজ্জতি হতাম। চোখের জলে ভেসে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে নামি। আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইল টা ওয়াই ফাই তে কানেক্ট করে ফেসবুক একাউন্ট একটিভেট করা। ওয়ালে তখন ব্রাজিলের সাপোর্টারদের নির্মম রসিকতা ! যার বিচার স্রষ্টা চার বছর পরে করেছিলেন ! ভাগ্যচক্রে সেই রাতে আমি হাসপাতালে ছিলাম ছেলে হওয়ার কারণে। তাই স্রষ্টার রসিকতায় পার্টিসিপেট করতে পারি নাই ! যাদের মনে নাই, তাদের বলি, ওই যে, ৭ গোল আর কি। যেই সাত গোল দিয়ে জার্মানি নিজেও বেকুব হয়ে গিয়েছিলো!
আর্জেন্টিনার ফ্যান বেইস তৈরীতে যেই জাদুকরের ভূমিকা অসামান্য, সেই মানুষটিই মাদকের সাথে জড়িয়ে গেলেন, কলঙ্কের কালিতে ডুবে গেলেন, ভেসে গেলেন খড়কুটোর মত! জীবন দুভাবে পার করা যায়। যাপন আর উদযাপন। যাপিত জীবনে স্বেচ্ছাচারিতার অবকাশ আছে। আর জীবনকে উদযাপন করতে চাইলে নিয়মতান্ত্রিকতার কোনো বিকল্প নেই, শরীর ও মনের যত্নের ত্রুটি রাখা যাবেনা একদমই।
আপনি যত বড় ক্ষমতাধরই হন না ক্যানো, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ যদি না থাকে, জীবন আপনাকে ক্ষমা করবে না। মাত্র ৬০ বছর বয়সে এই জাদুকরের অকাল প্রয়ান হয়তো এটাই আবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের। ওপারে ভালো থাকুন ম্যারাডোনা। আমার জার্সিটা আজো আছে, আর মনের ভেতরে থাকবেন আপনিও।
নভেম্বর ২০২০।
ফারিনা মাহমুদ
প্রদায়ক সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন।