তিব্বতের ধর্মীয় গুরু ছিলেন দালাইলামা। একবার আমেরিকার এক রেস্টুরেন্টের পরিচারিকা বিনয়ের সাথে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, জীবনের উদ্দেশ্য কী? দালাইলামা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, – ‘জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সুখী হওয়া। কিন্তু কঠিন প্রশ্ন হচ্ছে, কী আপনাকে সুখী করবে? টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ? ঐশ্বর্য-প্রাচুর্য না-কী মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা না কী মানুষের সেবা করা। এই উত্তরটুকু আপনাকে নিজেই খুঁজে নিতে হবে।”
আসলে, জন্মগতভাবেই আমরা অভাববোধ সম্পন্ন প্রাণী। তাই-তো শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই কান্না বা চিৎকারের মাধ্যমে তার অভাববোধের কথা জানায়। শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়। তাতে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা। এর প্রভাবে মানুষের চাওয়ায়ও এসেছে পরিবর্তন। চাহিদার কোন একটা দিক পরিবর্তন হলে পরক্ষণেই অন্য চাহিদার সৃষ্টি হয়। মূলত চাওয়ার ব্যাপারে বাইরের চাকচিক্য দেখে আমরা স্থির থাকতে পারি না। আসলে খেয়ালীপনাকে আমরা চাওয়া মনে করি।
সঙ্গত কারণেই আমরা সুখের উৎস হিসেবে বস্তুগত প্রাপ্তিকেই সুখ মনে করছি। তার ওপরে চলছে ভোগবাদের যুগ। আর কে কাকে আটকাবে? সময়ের দাবির অজুহাত তুলে আমরা নিত্যনতুন ভোগ্যপণ্যে আকৃষ্ট হচ্ছি। এতে আমাদের অনেকের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ভোগের মানসিকতা। ফলে দেদারছে কেনাকাটা করছি হরদম। যা একসময় আসক্তিতে রূপ নেয়। তখনি আসক্তি পূরণে বৈধ কিংবা অবৈধ পন্থায় আয় রোজগারে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এমন কী আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয়ও রাখি না। কারণ, সমাজে এখন স্ট্যাটাস মূল্যায়ন হয় পণ্যের নিরিখে। তাই তো নিজেদের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকি না আমরা। সন্তুানদেরকেও আমরা সেভাবেই তৈরি করছি। অন্যের সাথে ক্রমাগত তুলনা করছি। আর তাদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ছি। এমন কী চমকপ্রদ, লোভনীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে দ্রুত তা সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠছি। তখন স্বামী বা পিতার সংগতিও ধর্তব্যে আনছি না। সন্তানরাও তেমনি। এটা চাই, ওটা চাই। এমনটি চাই, তেমনটি চাই। এমন অসংখ্য বায়না তাদের। কেননা আসক্তি মূলত সংক্রামক ব্যধির মতোই। আসলে বস্তু হলো এমন কিছু যা পাওয়ার জন্য যেমন অস্থিরতা তেমনি পেলেও শুরু হয় আরো পাওয়ার অস্থিরতা। সত্যিটা এই যে, আসক্তি সৃষ্টি হলে কোন কিছুতেই একজন মানুষ তৃপ্ত হতে পারে না। তাই-তো আমরা সন্তানদের অযৌক্তিক চাওয়াটাকেও স্ট্যাটাসের নিরিখেই দেখি। ফলে ওদের আবদার পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অবাক করার বিষয়, অজপাড়াগাঁয়েও এমন কোন পরিবার নেই যে, পণ্যের পসারের অভাব আছে। মূলত নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত প্রত্যেকের ঘরেই পণ্যের প্রদর্শনী করতে সবাই উদগ্রীব। অথচ আফসোসের বিষয়, একটি বুকসেলফে সুন্দর করে বই সাজানো রয়েছে এমন পরিবার কদাচিৎ পাওয়া যায়।
কক্ষে সন্তানদের পড়ার টেবিলটির সংকুলান না হলে সমস্যা নেই। কিন্তু পণ্য প্রদর্শনের শোকেসের যথাযথ স্থানটি চাই-ই চাই। বলতে দ্বিধা নেই, উচ্চবিত্ত প্রায় পরিবারে ড্রয়িং রুমের ঝাড় বাতিটার দাম প্রায় ৩ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সঙ্গত কারণেই এহেন ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে অনেক অভিভাবকেরা বস্তুগত চাহিদা মেটানোর প্রতিই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। তাদের ধারনা, বস্তুগত চাহিদা পূরণ করাই মূলত সংসারের সুখ, শান্তি-সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। তাই সেই লক্ষ্যে অর্থ, বিত্ত গড়ার দুর্নিবার বাসনায় প্রলুব্ধ হচ্ছে মানুষ। ফলে নিজের বিবেক, নৈতিকতাবোধ বিবর্জিত পথে অর্থ উপার্জন করাটাকেই শ্রেয় বলে মনে করছে তারা। আর করবে না-ই-বা কেন? বর্তমান যুগে ড্রয়িং রুমটা হচ্ছে আধুনিক জীবন যাত্রার এবং স্ট্যাটাস নিরূপনের মাপকাঠি। এই ড্রয়িংরুমটা দেখেই বিচার করবে আমাদের আভিজাত্য, রুচিবোধ, সৌন্দর্য-জ্ঞান, বিত্ত-বৈভব, ঐশ্বর্য-প্রাচুর্য। প্রাচুর্য অর্থ হচ্ছে অভাবমুক্তির অনুভূতি। অর্থাৎ ‘আমার কোন অভাব নেই’ – এই অনুভূতি। মূলত অভাব না থাকাই হচ্ছে প্রাচুর্য। আসলে, এটার অর্থও আমরা অনুধাবনে ব্যর্থ। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা আত্মার অভাব মুক্তিকে না বুঝে পণ্যের অভাব মুক্তিটাকেই প্রাচুর্য মনে করছি। আর বস্তুগত প্রাপ্তির পেছনে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলছি প্রতিনিয়ত। এতে আসলে আমরা নিজের আত্মিকতাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছি। হায়রে দুনিয়া! তাই-তো আমরা ড্রয়িং রুমটাকে প্রতিষ্ঠিত জীবনের তথা স্ট্যাটাস নিরূপনের সাইনবোর্ড ভাবি। আর কতটা সুন্দরভাবে এটাকে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করা করা যায় তার নেশায় বিভোর থাকি। কারণ, এই সাইনবোর্ডই আমাদেরকে সমাজের কাছে পরিচিতি এনে দেয়। আর সমাজও আমাদের মূল্যায়ন করে অর্থবিত্ত আর পণ্যের নিরিখেই। আমরা ভুলে যাই, বিত্ত-বৈভব আর ভোগ-বিলাসের সাইনবোর্ডের চেয়ে জীবন ধারণ পদ্ধতির গুরুত্ব অনেক বেশি। সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে প্রশান্তি ও সৌন্দর্যবোধ থাকা দরকার সেটাও আমরা বিবেচনায় আনি না। আমরা বুঝতে চাই না অকৃত্রিম মন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য মনের প্রশান্তি ও সুকোমল অনুভূতির মূল্য অনেক বেশি। আর বুঝি না বলেই অভিভাবক হিসেবে বস্তুগত চাহিদা পূরণ করাকেই পরিবারের দায়িত্ব পালন করা মনে করছি।
সুপ্রিয় পাঠক, আসলে বস্তুগত চাহিদা পূরণ করাই কিন্তু অভিভাবকের দায়িত্ব নয়? কী দুর্ভাগ্য, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন করার মর্মার্থ অনুধাবন করার বোধশক্তিও আমরা হারাতে বসেছি। মানছি, জীবন ধারনের জন্য নিঃসন্দেহে বস্তুর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বস্তুই একজন মানুষের সবকিছু নয়। এক্ষেত্রে হযরত জালাল উদ্দিন রুমীর চমৎকার একটা উপমা উপস্থাপন করছি। তিনি বলেছেন, ‘নৌকা চলার জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয় কিন্তু এই পানি যখন নৌকার ভেতরে প্রবেশ করে তখন নৌকাডুবি ঘটে।’ অর্থাৎ অর্থ-খ্যাতি এবং বস্তুর পেছনে যখন কেউ মোহগ্রস্তের মতো ছুটে তখনি তার আত্মিক মৃত্যু ঘটে।
আসলে, বৈষয়িক সাফল্যে সন্তোষজনক হলেও আত্মিক শূণ্যতা যদি থাকে তাহলে জীবন পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ জীবনের সবগুলো প্রয়োজন সুন্দরভাবে পূরণ করতে পারলেই একজন মানুষ সুখী হতে পারে। সবকিছু মিলিয়েই জীবন। আসুন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকেই পরিমিতি বোধের শিক্ষা দেই। জীবনের ভালো ও সুন্দর জিনিস বাদ দেয়ার নামই পরিমিতি নয়। আসলে পরিমিতি হচ্ছে, জীবনের সব কিছুরই প্রয়োজন আছে কিন্তু নিজের সীমাটা বুঝতে হবে। আসলে পরিমিত মানে হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ। তাই পরিমিতি চর্চায় শিশুদেরকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। আসলে, সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য পরিমিতিবোধ অত্যন্ত জরুরী। মূলত সবকিছুতেই পরিমিতি প্রয়োজন। খাবারে পরিমিতি, কথায় পরিমিতি, আনন্দউল্লাসে পরিমিতি, কেনাকাটায় পরিমতি। মূলত দৈহিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, পারিবারিক সম্প্রতি, আর্থিক প্রাচুর্য এবং আত্মিকমুক্তি সবকিছুর মধ্যে চমৎকার ব্যালেন্সের সমন্বয় করাই পরিমিতিবোধ শিক্ষার মূলকথা।
স্রষ্টা আমাদের কেবল নিজেদের সদাইপাতি করার জন্য পৃথিবীতে পাঠাননি। বরং মেধাকে নিজের এবং অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্যই পাঠিয়েছেন। এই বোধ যত জাগ্রত হবে আমারা তত নিজের চাহিদাকে সংযত করতে পারব। আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর জীবনযাত্রা কখনো তৃপ্তি দিতে পারে না। তাই আসুন, পরিমিতিবোধে নিজে উদ্বুদ্ধ হই এবং সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করি। সবেশেষে সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ‘How many things without I can live’ অর্থাৎ কতকিছু ছাড়াই আমি বেঁচে থাকতে পারি !
পিয়ারা বেগম
কথাসাহিত্যিক, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশ।