সর্বপ্রাণবাদী
চলো শ্মশানে আগুনের কলরবে জেগে উঠি;
এসো কবরের নীরবতায় রূপকথা মেলে ধরি।
তোমাকে দেখেছি সখী-
ফাটা জ্যোৎস্নার অঙ্গীকারের নিচে,
তোমাকে তিলক করেছি –
গায়ত্রী মন্ত্রের সম্মুখবাদী ঢেউ ও সম্মোহনে।
প্রতিপক্ষ শ্বাপদের মুখে শঙ্কায় কেন কাঁপো?
সিন্দুক নাই- হারাবার নাই সোনাদানা
ব্যথার বেতফলে রেখেছি দুই হাত
পরাজয়ে জয়ী হবার এনেছি সংঘাত।
কে ছিল পূর্বপুরুষ- জানি না কে ভবিষ্য জ্ঞাতি
তারই মাঝখানে দাঁড়িয়েছি সোমরসের জ্যোতি!
তোমার অঙ্গে জাইফলের দানা
আমার দেহে ফোটে আদিবাসী চিত্রের হলুদ
নিসর্গ কহি- আমরা দু’জনে প্রকৃতির বুদবুদ!
পাথর ভাঙা
পাথর ভাঙছে অনাহারী
লোকটা পাথর ভাঙছে।
জিভে নুনের স্বাদ- মাথা ঘুরছে
ভারী হাতুড়ি উপরে তুলছে
লোকটা পিটাচ্ছে- পাথর ভাঙছে।
পাথরে লোকটার বউ
বউটা পাথরে ভেসে উঠছে
মুখটা হঠাৎ ফুটে উঠছে,
অনাহারী লোকটা পাথরটি ভাঙছে।
জন ওনাসিস
জন ওনাসিস আমার লাগোয়া প্রতিবেশী- গ্রীসের নামজাদা পরিবারের মানুষ। জে এফ কেনেডির স্ত্রী জেকুলিন কেনেডি ওনাসিস- তাঁর বংশের বঁধু, এর জন্য জনের মধ্যে একটা তোলা কাপড়ের মতো শ্লাঘা ছিল বৈকি! শেষের দিকে জন ওনাসিস অন্ধ হয়ে গিয়েছিল; একজন অন্ধ গ্রীক; আমি বলি: জন, তুমি তো কবি হোমার- আমাদের জমানায় এসে পড়েছো। জন বলতো- হয়তো, আমি হোমার, কিন্তু আমার হয়ে লেখো যে তুমি! আমি বলতাম- তথাস্তু।
জন একাএকা আর বাইরে যেতে পারতো না, তার স্ত্রী বেটি ওনাসিস ড্রাইভ করে নিয়ে যেতো। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে অন্ধ জন মিসেস বেটিকে বলতে থাকে রাস্তার কোন লেইনে তার থাকা নিরাপদ, কতোদূর গিয়ে কোথায় তাকে এক্সিট নিতে হবে। দোকানপাটে বেটিকে সে-ই হাতে বেড় দিয়ে রাখে! এর নাম কী- ভরসা, অধিকার, উদ্বেগ, না জন্মদাগের মতো অমোচনীয় এক লাবণ্য শীলা?
ঘরে ফিরেই আমার সংসার মাঝি নার্গিসকে ডাকে- নুফরি, নুফরি, বারান্দায় আসো গল্প করি, আমি বেটির বানানো বাখলাভা নিয়ে আসি। জন নার্গিস বলতে পারতো না, বলতো- নুফরি। নুফরি না-কী গ্রীসের একটি ফুলের নাম।
বসন্তে আমার ফুল ও পরাগের পোলেনে প্রচণ্ড এলার্জি- অসম্ভব হাঁচি হয়, আর চোখ জ্বালাপোড়া করে। আমি ঘরে জোরে হাঁচি দিলে জন ওনাসিস দেওয়ালের ওপার থেকে চেঁচিয়ে বলে- গড ব্লেস ইউ, গড ব্লেস ইউ। আমরা ঝমঝম করে হাসি, এটা ছিল আমাদের দুই প্রতিবেশী পরিবারের বসন্তকালীন খেলা।
জন চেঁচিয়ে বলতো- নুফরি, ডোন্ট গিভ আলমগীর এনি এলার্জি পিল, আই ডোন্ট সি এনিথিং, বাট আই লাইক দিস সাউন্ড।
এই নিদারুণ নিস্তরঙ্গ বসন্ত পোলেনের কালে আমার প্রতিদিন জন ওনাসিসের কথা মনে পড়ে। ভালো যে, এই অনাত্মীয় বসন্তে জন আর বেঁচে নেই। আমি হাঁচি দিলে জন নিশ্চয়ই বলতো- আমি ভয় পাই, নুফরি, টেইক হিম টু দ্য হসপিটাল! এই দৃশ্যটি কোনভাবেই ভাবতে পারি না।
আমি অকূল হয়ে সম্মিলিত একাকিত্বে জানালার পাশে বসে থাকি; সমস্ত যোগ্যতা খুইয়ে ফেলার পরেও অন্ধ জন ওনাসিসের ব্যাকুলতায় অবিরাম চেরি ফুলের দিকে নিথর অক্ষম অভিবাদন পৌঁছে দিতে মনের অজান্তেই বলি- ও চেরি ব্লোসোম, ওগো দখিন হাওয়া- আমাকে গ্রহণ করো, ক্ষমা দিয়ে দাও না আমার জীবন ধুয়ে!
ভাইফোঁটা
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- খাঁখাঁ চর, আছে-
কিছু গাছগাছালি আছে ওখানে,
বাদামওয়ালা আছে, রাত হোক দিন হোক
আছে অফুরান ঝিমধরা দুপুর!
একটি কিশোরী মেয়ে- সুফিয়া
উদ্যানে ঘুরেঘুরে বেচে প্লাস্টিকের বোতলে জল।
আরেকটু বড় হবে কবে সুফিয়া- আরেকটু বড়,
হবে ধুতরার ফুল, হবে করবী ফুলের লাল!
আর ক’টা সামান্য দিন-
কড়ি ফুল থেকে ছিঁড়ে এসে ডেউয়া ফল খুলে
ছিটকে পড়েছে সোহরাওয়ার্দীর ছায়া ছায়া বালুচরে!
প্লাস্টিকের বোতলে বেচে খাবার জল-
পাঁচ টাকায় বাড়িয়ে দেয় তৃষ্ণার পানি।
সুফিয়ার হাতে প্লাস্টিকের বোতলে জল,
মাটির ঘড়ায় ছলকানো জেব্রা ক্রসিঙ!
তোমার প্লাস্টিকের বোতল বাড়িয়ে দেয়া হাতে
কেমন এক ছাইছাই হাসির রেণু,
পৌষ মাসী বান্নি মেলায় ছিটখই উরহা একমুঠ
অনাহারী ভাঙা পাড় বোন-
দুপুরে, ঝিম দুপুরে বেচে নিদানের ভাইফোঁটা, নুন!

রক্তকরবী
যূথিকা হতে চেয়েছিল মানুষ ও বনের চিত্রাহরিণ,
মোফাক্কর প্রকল্প করেছিল- তেঁতুলগাছের ভুত হবে,
হাতে রাখতে চেয়েছিল লাল রামদার ভাষাগুণ;
ময়ূর পাখিটি বৃষ্টিতে ভিজে হতে চেয়েছিল রোদ।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভেবেছিল-
আর কতো বনে বনে আনালে বিনালে ঘুরি!
এবার তাহলে বাঙলাদেশের সংবিধানের কেন্দ্রে
ছাউনি বানিয়ে থাকি, গপশপ করি,
এমনই কথা তো পণ ছিল উনিশ শ’ একাত্তরে;
দুনিয়া থমথম, নৈঃশব্দ্যের মৃদঙ্গে কেঁপে ওঠে
প্রচণ্ড ঝড় আসবে বলে- সব ভেঙে মায়া হবে-
কী জগৎ ওঙ্কার তুলবে তীব্র ভূমিকম্পে-
ভাবি, এই বুঝি আমাদের নন্দিনী আসে!
সড়ক ভরে যক্ষপুরীর শিশু শ্রমিকেরা
মাথা নিচু হেঁটে যায়-
হাতে পায়ে পিঠে বই,বই আর জ্ঞানের সিন্দাবাদ,
সামনে পিছনে অধ্যাপক।
ভরা শস্যের মরশুম এলো না-কী,
অন্ধ হাওয়া বাড়ি বাড়ি বিলি করে আগামী বর্ষার ঠুলি
নন্দিনী, নন্দিনী- রঞ্জনের ডাকে তুমি কেমন অবিচল-
হাতে ধরে না ঘোরাও গন্ধমের ফল!
ঘরসংসার
১৪ তলার উপর এপার্টমেন্ট। ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা- কিন্তু কয়েকদিন বাদেই কোত্থেকে জানি ঠিকঠিক ধুলা এসে জমে।
সবজি কোটার দা’য়ে কামারের দোকান থেকে ধার তুলে আনা। সেই দা-য়ে সবজি কাটা হয়নি, বাঁশের কঞ্চিতে কোপ দেয়া তো দূরের কথা, গোস্তমোস্ত ঘরেই আসে না বহুদিন। কিন্তু ধারালো দা আপনাআপনি ভোঁতা হয়ে বসে থাকে!
ডৌলনকশা করে সাজানো ধ্রুপদী শিল্পীদের গানের এলবাম নাই, ভাঙা জালালি কবুতরের উড়ানিয়া আওয়াজই একমাত্র সঙ্গীত; আমাদের সবার পায়ে কোত্থেকে জানি নিত্য বেড় দিয়ে ধরে খোয়াজ খিজিরের শৃঙ্খল, দুনিয়ায় এই প্রথম একটি শৃঙ্খল রোদ্দুর হয়ে ছড়ায়, আর ঝকমক করে গান গেয়ে ওঠে।
এ-ঘরে আতর ছিটানোর চল নেই, বাড়িতে কেউ ডোলচে গাবানা পরে বলে তো জানি না; কোত্থেকে আসবে এলিজাবেথ টেইলরের পারফিউম? তারা নেই, কিন্তু ঠিকঠিক একটা অনায়াস গন্ধ শিশিরের ভুলে ছড়িয়ে থাকে: মন বলে, এ আমাদের পূর্বপুরুষের বংশবৃক্ষের গন্ধ- উত্তরপুরুষের অপেক্ষার কড়ুই গাছ।
জগৎ সৃষ্টির আদি বিবরণ
শুনতাম এই তরুণ যুবা এলাকার নায়ক- কোঁকড়া চুল, সামনের চুল আবার ঢেউখেলানো- কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার জ্ঞানপুরে তার বাড়ি। তাঁর মায়ের নাম আছিয়া খাতুন, সবাই ডাকে সূর্যের মা; তার বোন আম্বিয়া- আম্বিয়া খাতুন। আমি ছোটবেলায় শুনেছি তিনি রাবেয়া বসরী। রাবেয়া বসরী আমাকে সিন্ধুরিয়া গাছের আম খেতে দেয়। ওই আম দুনিয়াতে একবারই জন্মেছিল।
একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হলে কোঁকড়া চুলের যুবক যুদ্ধে যায়- সত্যিসত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করে- ওই যোদ্ধা নয়, যারা ইণ্ডিয়া থেকে- মুক্তিবাহিনী মেরে সাফ করার জন্য লিস্টি নিয়ে এসে এলাকায় হাজির হয়েছিল।
যুদ্ধের একদম শেষে মাঠের লড়াকু মুক্তিসেনা মিজবাহউদ্দিন আহমদ- সহযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ দেয়।
বোয়াল মাছের সাথে, চিতল মাছের সিথানে তার ফোলা মৃতদেহ ভেসে ওঠে। গ্রামের লোকেরা কাঁধে কাঁধে ভাটির গাঙ থেকে মৃতের শব জ্ঞানপুরে নিয়ে আসে।
শহীদ মিজুর মা আছিয়া খাতুন বুকে থাবড় দিয়ে মাটি ছেঁচড়ে বিলাপ করে। মিজুর বোন আম্বিয়া খাতুন তার মা সূর্যের মা-কে বলে: আপনি কান্দেন কেন? আল্লার দরবারে সোজা হইয়া খাড়ান- খোদার ইচ্ছায় সবুর রাখেন, আগুন হইয়া জ্বলেন!
আড়ালে, পিছ দুয়ারে আম্বিয়া নারকেল গাছের পাতা- কেঁপেকেঁপে কাঁদে, সূর্যের মা আগুন হয়ে মেওয়া ফলে জ্বলে, আর মুক্তিবাহিনী মিজু অনড় মাটি- স্থির শুয়ে থাকে!
