আমার কোন গল্প নেই -প্রতীক ইজাজ

  
    

আমার ব্যক্তিগত কোন গল্প নেই। ছাতিম গাছের নিচে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর, এক ঝরা পাতা কানে কানে বললো: ঘুম পেয়েছে, আমরা ঘুমুবো। আমি আলতো করে বাকল ছুঁয়ে দক্ষিণে পথ নিলাম। ছাতিম গাছটি আমার হলো না।

আপন ভেবে একটা গল্প বুনবো ভেবেছিলাম। সব ঠিক ছিল- রঙতুলি, ইজেল, ক্যানভাস। একটা ঘর হবে। ঘরের জানালা দুটো। দক্ষিন দুয়ারি বারান্দা, কাঠের সিড়ি, চন্দনের পাটাতন। দড়ির শিকেয় দুটো কলকাসুন্দরি। একটা ঝুলন্ত মাটির পাতিল। পাখিদের জন্য খড়বিচুলি। এমন ভেবে যেইমাত্তর পা বাড়িয়েছি সামনে, অমনি এক বাজখাই বাতাস এসে উল্টে দিলো চুলের সিঁথি। আমি বললাম: মানে? ও বললো: এই ঘরখানা বিক্রি হয়ে গেছে। তুমি অন্য কোথাও দেখো। আমার গল্পটা আর বোনা হলো না।

একদিন জানালা খুলে আকাশ দেখছিলাম। রাতের আকাশ। মেঘভার জলদ সাদা মেঘের আকাশ। বৃষ্টি হবে। দূর থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আলো জ্বলছে, মিটমিটে আলো, যে আলো স্পষ্ট কিছু না, ছায়া ছায়া, আবছায়া, নিজেকেও অস্পষ্ট কয়েকটা রেখার মতে লাগে। যে লোকটা ঘাড় নিচু করে মধ্যরাতে ঘরে ফিরতো, তার দোকানে সাটার লাগানো। গলির শেষমাথায় একটা জটলার মতো। চোখ বাড়ালাম। হঠাৎ পাশের ব্যালকনিতে ‘খুক’ ‘খুক’ কেশে উঠলো কেউ একজন। মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আড়চেখে তাকালো। ফিসফিস করে বললো: জানালা বন্ধ করো, বৃষ্টি নামবে।

আমি সরে গেলাম। জানালা বন্ধ হলো। ধোয়ায় দমবন্ধ সে রাতের, সেই জল-মেঘের গল্পটাও আমার হলো না। আমার চোখে এখন কেবলই বৃষ্টি, মেঘভেজা বৃষ্টি, মেঘে মেঘে, ভেসে ভেসে, কেবলই দূরে সরে যাওয়া ছায়ার মতো মানুষ, ভেজা মানুষের গল্প।

আমার ব্যক্তিগত কোন গল্প নেই। এই যে আস্ত একটা মানুষ, জন্মাবধি সে-ও বন্ধক দূর কোন অচেনা ঘরে; সেখানে চাষ নেই, ফসল নেই, কেবলই অভুক্ত, কেবলই পোড়খাওয়া কঙ্কালসার ব্যথায় দীর্ণ এক ছেড়া মাস্তুল। তার পালে বসে একের পর এক কেবলই গল্প বুনে যাই, ছেড়াবৃষ্টির গল্প। আর গল্পগুলো ছেড়া পাতা হয়ে ভেসে ভেসে, হেসে হেসে, চলে যায় দূরে, বহুদূরে, লোকালয়ে। কেবল আমারই কিছু হয়; না ঘর, না ঘরের গল্প!

৩ নভেম্বর ২০১৯, ঢাকা।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

 

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments