করোনাকালীন গ্রামীণ জীবন । তুহিন রায়, সারা মনামী হোসেন, কামরুল হাসান

  
    

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’। সত্যিই পৃথিবীতে অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে। কবি জীবনানন্দের কবিতামালার কথাগুলো ইদানিং খুব সত্য মনে হয়। নভেল করোনা বা কোভিড-১৯ বর্তমানে বিশ্বজিড়ে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। শহর থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে গ্রাম- সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে শহর ও মফস্বলের করোনাকালীন জীবন সম্পর্কে লেখালেখি হচ্ছে। গবেষণাও হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে গ্রামের মানুষের চিন্তা-ভাবনা এবং তাদের করোনাকালীন গল্প তেমন শোনা হয় না। গণমাধ্যমে শুধু মফস্বল বা গ্রামের আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষের কষ্টের কথা বলা হচ্ছে। সাহসী ও জনদরদী মানুষের গল্প বলা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি করছে বা ভাবছে তা জানার সুযোগ কম। আমরা অনেকে বলি, গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কারণ এই গ্রামে আছে জীবনের শিকড়।

নদী বিধৌত গ্রাম, প্রতিকী ছবি। ছবি কৃতজ্ঞতা: আমাদের নাটুয়ারপাড়া।

গবেষণার কাজে কিছুদিন আগে খুলনার দাকোপ থানার গ্রামে ঘোরাফেরা করতে হয়েছিল। নির্দিষ্ট দুরুত্ব বজায় রেখে মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগও মেলেছিল। জানা গেল, অধিকাংশ মানুষ এখনও করোনা সংক্রমণ নিয়ে সচেতন নন। শিক্ষিত মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সনাতন মন্ডল (সব কল্পতি নাম) বলছিলেন বিশাল একটা পুকুর আছে তার। সেখানে আশপাশের মানুষজন আগে গোসল করার জন্য আসত। করোনার পর থেকে তারা সেখানে যেতে পারছেন না। সনাতন মন্ডল-ই সাইনবোর্ড  দিয়েছেন না যাওয়ার জন্য। এই নিষেধ করার কারণে প্রতিবেশিদের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সনাতন মন্ডল এবং তাঁর পরিবার এক ধরনের মানসিক সমস্যায় আছেন বলা যায়। গৃহিনী লাবন্যপ্রভার সাথে কথা বলার সময় তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষজন একদম সচেতন না, আরো সচেতন না হলে অনেক সমস্যা সামনে ভোগ করতে হবে। মানুষ নিজের ভালোটুকু বোঝে না।”
গ্রামবাসী এখন পর্যন্ত এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাটেবাজারে যাচ্ছেন। কিছু মানুষ মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন। কেউ বা বাড়িতে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন। তারা বলছেন, ঈশ্বর দেখবেন। আবার কেউবা বলছেন, আল্লাহ দেখবেন। তারা মন্দির-মাদ্রাসায় যাচ্ছেন । প্রার্থনা করছেন। সরকারি দিকনির্দেশনা তারা তেমন জানেন না। অনেকের ধারণা করোনা বড়লোকদের রোগ। পরিশ্রমী মানুষদের তেমন কিছু হবে না। সন্ধ্যার সময় পুরুষরা মোড়ের চায়ের দোকানে যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। কারণ না যেতে পারলে তাদের ভালো লাগে না। তাদের ভাষায়, পেটের ভাত হজম হয় না। গ্রামে ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করতে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তরুণ সুজন মন্ডলের মতে, এ সময়ে খেলাধুলা করার কারণ হলো যাতে তাদের শরীরে রোগ না হতে পারে।

সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে তাদের মধ্যে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। এ সম্পর্কে সরকারি তথ্যগুলোও সঠিকভাবে জানেন না। আর এটা নিয়ে তেমন আগ্রহও নেই তাদের। তাদের ভয় যারা শহরে চাকরি করে তাদের। তারা কেউ কেউ বাড়িতে এসেছিল ঈদের ছুটিতে। তাদের বিশ্বাস করোনা ছড়ালে এই শহর থেকে আসা মানুষগুলোর মাধ্যমেই ছড়াবে। ‘হোম কোয়ারেনটাইন’ বলতে বোঝে কেউ অন্য জায়গা থেকে এলে তাকে বাড়িতে থাকতে না দেওয়া। তাকে বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও থাকতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে তারা জানিয়ে দেয়। তখন গ্রামের দফাদর (গ্রাম পুলিশ) বাড়িতে লাল পতাকা দিয়ে যায়। গ্রামের বাসিন্দা প্রৌঢ় আনোয়ার জানালেন, তার ছেলে গাজীপুরে গার্মেন্টেসে চাকরি করে। এবার বাড়িতে এলে তাকে ১৪ দিন বাড়ির বাইরে ঘেরে থাকতে হয়েছিল। সেখানে তার জন্য বাসা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় তাদের বাড়িতেও কেউ আসত না।

লকডাউন নিয়েও তাদের মধ্যে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন লকডাউন হলো কাউকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়া; কেউ বলছেন গ্রামের কোনো মানুষকে শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করা। কেউ কেউ তো বোঝেন-ই না এর মানে কী। নছিমন চালক সমারেশ রায় সে কথায় তাল মিলিয়ে বলছিলেন যে সবাই তার গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বসে। করার কিছুই থাকে না। অভাবের কারণে এই নছিমন চালকের মতো অনেকেই বাইরে কাজ করছেন। অসীম মন্ডল নামের এক বাসিন্দা বাগেরহাট গিয়ে ধান কাটছেন। আবার প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গ্রামের অনুষ্ঠানে কখনো কখনো প্রায় ১০০-২০০ মানুষের সমাগম হচ্ছে।
গ্রামের মানুষজন যে খুব বেশি সচেতন নন তা সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে অনেকবারই প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। অঘোষিতভাবে সরকারি লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিলেন। একটি জাতীয় দৈনিক থেকে জানা যায়, এ বছরের এপ্রিলে শুধু রাজধানী ছেড়ে গ্রামে গেছে ১ কোটির বেশি মানুষ। শহর থেকে আসা কারো কারো শরীরে করোনা উপসর্গ থাকায় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিভিন্ন জেলার এসব গ্রাম প্রশাসনের মাধ্যমে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। একজন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের সবাই বা প্রতিবেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কখনো ১৩ জন, কখনো ১৫ জন এভাবে একজনের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন। উপসর্গহীন অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ রোগে কারও মৃত্যু হলে কবরস্থ করা নিয়েও অনেক সময় বাঁধা পড়ছে। এ ছাড়া কেউ কেউ শহরে থাকতেই করোনা উপসর্গ নিয়ে পালিয়েছিলেন গ্রামে। সংবাদপত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে দাকোপ উপজেলায় ৬ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও গ্রামের মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন, কেনাকাটা করছেন।

করোনা টেস্ট নিয়েও তাদের কোনো ধারণা নেই। কেউ কেউ বলছেন ডাক্তারদের কাছে তারা যেতে চান না। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলাদা কোনো কিছু করেন না। বাড়িতে রেডিও বা মুঠোফোনে বিভিন্ন গান, কীর্তন ভজন, গজল শুনে তারা মানসিক শান্তি খুঁজে পান। মানুষের পাপের ফলে এ রোগ দেখা দিয়েছে বলে বিশ্বাসী মানুষও কিছু আছে। এর মধ্যে কাউছার নামের এক যুবক জানালেন, তিনি নিয়মিত ধূমপান করেন। তার মতে ধূমপানে গলায় তাপ লাগে; ফলে করোনা হওয়ার ভয় কম। তবে গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে পরিবারে গরম পানি পান, কালো জিরা খাওয়া চলছে। আবার কেউ থানকুনির পাতা, তুলসির পাতা, লবঙ্গ ইত্যাদি খাচ্ছেন। একটু বেশি সচতেন যারা তারা গরম চা-ও পান করছেন ঘনঘন।

কৃষক জাফর হাওলাদারের মতো অনেকে করোনা সংক্রান্ত খবর পান প্রতিবেশি বা রেডিও-এর মাধ্যম। তবে মহামারীর প্রকোপটা বুঝে উঠতে পারেন না। তেমন গুরুত্বও দিতে আগ্রহী নন। গ্রাম পর্যায়ে সরকারি নির্দেশনার কঠোর প্রয়োগ ও বিভিন্ন বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা যদি সচেতনতামূলক প্রচারণা বারবার চালায় সেক্ষেত্রে ভালো ফলাফল আসতে পারে। এ ছাড়া করোনা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা জরুরী। রোগী বা রোগীর পরিবারকে অচ্ছুত ভাবার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে এ মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। রোগী আসলে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বা একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা নয় বরং আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন অর্থ কী তা সবাইকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে পদক্ষেপ নিলে লাভ হবে।

একদিন এই মহামারি হয়তো দূর হবে, তবে তার আগে রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ও রোগের সঠিক দাওয়াই মেনে চলার মানসিকতা গড়ে তুলতে সবাইকে চেষ্টা করে যেতে হবে।
এ ছাড়া করোনা সংকট মোকাবেলায় সচেতনতার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার কিছু বিষয় উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। সেখানকার সরকার জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে নানা সাহায্য করছেন। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশীরা এরকম সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই চিকিৎসকদের জন্য দেশে পিপিই পাঠিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট শিক্ষার্থীদের দুপুর ও রাতের খাবার বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবে সমাজের যদি সবাই একে অন্যের পাশে দাঁড়ায় তবে করোনা সংকট মোকাবেলা কিছুটা সহজ হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক পরিচিতি:
তুহিন রায়: গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
সারা মনামী হোসেন: গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
কামরুল হাসান: গবেষক, শিক্ষক ও উন্নয়নকর্মী, প্রাক্তন প্রশিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। র্বতমানে ওয়র্স্টোন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্কমরত।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments