
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় মিডিয়ার মাধ্যমে একের পর এক ওষুধকে কার্যকর হিসেবে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার জন্য প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। অতীত ঘাটাঘাটি করলে পাবেন, আগেও বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে নানা ঔষধ নিয়ে মিডিয়াতে স্টান্টবাজি হয়েছে। এখনো সমান তালে চলছে।
শুরুতেই ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও ফেইসবুকে ঢাকঢোল পেটালো। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ে গেলেন এই ঔষধের মডেল। এসব যে অসত্য প্রচারণা, তা একে একে প্রমানিত হচ্ছে। ক্লোরোকুইন ফসফেট খেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর স্ত্রী মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ঔষধের অনুমোদন দেয়নি। তারপরও কেন বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কয়েকটি কোম্পানিকে এসব ঔষধ (করোনা চিকিৎসায় যথাযথভাবে প্রমানিত কিংবা পরীক্ষিত নয়) উৎপাদনের অনুমতি দিল? বিষয়টি বোধগম্য কিন্তু প্রমানের অভাবে প্রকাশযোগ্য নয়। ফলাফল যা হবার তাই হলো।
শেষ পর্যন্ত প্রমানিত হলো, করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এসব ঔষধ প্রয়োগ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে- করোনা রোগীরা ম্যালেরিয়ার এই ঔষধ গ্রহণ করলে রক্ত জমাটের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তারপর আরো কয়েকটি ঔষধ এল আর গেল। একটারও যথাযথ কার্যকারিতা প্রমানিত হলো না। কিন্তু ঢাক-ঢোল পেটানো বন্ধ হলো না। চলতেই থাকলো। কয়েকটি অসম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল নিয়ে কিছু দিন জাপানের অ্যাভিগান এর ব্যাপারে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করা হলো। কিন্তু অ্যাভিগানের কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত প্রমানিত হয়নি। কোনো কোনো চিকিৎসক মিনমিনিয়ে বললেন, ‘যেহেতু আর কোনো ঔষধ নেই, তাই ব্যবহার করা যেতে পারে’।

রেমডেসিভিরের কথা মনে আছে? বিজ্ঞজনেরা বললেন, ‘ঔষধটি আশাপ্রদ ও করোনা চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে’। কার্যকর হতে পারা আর কার্যকর হয়ে যাওয়া কি এক কথা? বৈজ্ঞানিক জগতে একটা ‘এসাম্পশন’ আরেকটা ‘পরীক্ষিত ফলাফল’। এসবের পার্থক্য কি বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসনের বিজ্ঞজন এবং সাংবাদিকরা বোঝেন না? ইবোলার জন্য আবিষ্কৃত এই ঔষধটি একটি ব্যর্থ ঔষধ । এটা যে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে কি না? তা গোল্ড স্টান্ডার্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (র্যান্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) ছাড়া বলার উপায় নেই। প্রাথমিক ফলাফলে বলা হলো- ‘এই ঔষধ রোগীর সুস্থ হওয়ার সময় ১৫ দিন থেকে ১১দিনে কমিয়ে আনে’। তাও আবার মৃদু আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে। ইন্টেন্সিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের জন্য ভাইরাল লোড বেশি হওয়ার কারণে ফলাফল মোটেই আশাপ্রদ নয়। অথচ র্যান্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম- ‘রেমডেসিভির করোনা চিকিৎসায় এক অনন্য ম্যাজিক বুলেট’। আর যায় কই!
বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে রেমডেসিভির উৎপাদন ও বিপণন নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। এসবের প্রত্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। একটি কোম্পানি ঔষধটিকে একমাত্র কার্যকর ঔষধ আখ্যায়িত করে উৎপাদন সম্পন্ন করে ফেললো। একই সাথে কার আগে কে উৎপাদন করলো তা নিয়েও শুরু হলো দ্বন্দ্ব। অথচ পৃথিবীর কোথাও এই ঔষধকে এখনো ‘একমাত্র কার্যকর ঔষধ ’ বলে সার্টিফিকেট দেয়নি। বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ঔষধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে উচ্চমান লিড নিউজ করল। কারণ পত্রিকাটির মালিকের কন্যা হচ্ছেন প্রথম রেমডেসিভির উৎপাদনকারী (কনটেস্টেড) কোম্পানি এসকেএফ এর মালিক। অন্যদিকে বেক্সিমকো উৎপাদিত রেমডেসিভির বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে দেদারসে ব্যবহার করা শুরু করলো।
মিডিয়া হাইপের সর্বশেষ সংযোজন হলো করোনা চিকিৎসায় ইভারমেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিন গবেষণার অসাধারণ সাফল্য। ইভারমেক্টিন হলো অ্যান্টিপ্রটোজোয়াল ড্রাগ আর ডক্সিসাইক্লিন একটি আউটডেটেট অ্যান্টিবায়োটিক। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ঔষধ দুটো কীভাবে কার্যকর হতে পারে? তা এখনো কেউ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমান দিতে পারেনি। তারপরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কার্যকর প্রমাণিত হলে আমাদের নিতে আপত্তি নেই। উল্লেখ্য – চিকিৎসকরা বলেছেন তাঁরা কোনো গবেষণাই করেননি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তো দূরের কথা। দেখুন মিডিয়ার দুই নাম্বারি কত প্রকার! একটি পত্রিকা লিখেছে- ‘করোনা চিকিৎসায় বিষ্ময়কর সাফল্য দেখছেন বাংলাদেশী গবেষক দল’। অন্য একটি পত্রিকা লিখেছে- ‘দেশে করোনা চিকিৎসায় বড় সাফল্য’। মিডিয়ায় বলা হয়- ‘এই দুটো ঔষধ প্রয়োগে তিন দিনে ৫০ শতাংশ করোনা রোগের লক্ষণ কমে যায় ও চারদিনে করোনা টেস্ট পজিটিভ থেকে শতভাগ নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার বিষ্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়’। উল্লেখ্য, অনেক চিকিৎসকরা পত্রিকার এসব স্টান্টবাজিকে সমর্থন করেন নাই। কিন্তু সেসব চিকিৎসকদের কথা মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করলো না।
পুনশ্চঃ
বাংলাদেশের বক্ষব্যাধী হাসপাতালের চিকিৎসকরা সিরিয়াসলি অসুস্থ কোনো রোগীকে এই দুটো ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা করেননি। করোনায় মৃদু আক্রান্ত ৬০জন রোগীর ক্ষেত্রে তাঁরা উক্ত ঔষধ দুটো প্রয়োগ করেন। এটা কি কোনো মান-সম্মত ড্রাগ টেস্টিং ট্রায়াল? মোটেও না। করোনায় আক্রান্ত পৃথিবীর ৮০ শতাংশের বেশি রোগী কোনো ঔষধ ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। এধরণের রোগীদের আটা বা ময়দার তৈরি ট্যাবলেট খাওয়ালেও তারা ভালো হয়ে যাবে। এটাকে বলা হয় ‘প্ল্যাসিবো ইফেক্ট’। এখন রোগী কি এমনি এমনি ভালো হলো নাকি ওষুধের কারণে ভালো হলো, তা কে বলবে? এই দুটো ওষুধের কার্যকারিতা কি রেন্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে? তা হয়নি। চিকিৎসকরা তা দাবিও করেননি। ‘ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’। এই প্রবাদটি বাংলাদেশের মিডিয়া, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা জগতে এখন স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কিসের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী এবং/অথবা অপরিপক্ক মিডিয়া অহেতুক বিভ্রান্তি ও প্রতারণায় মত্ত হয়ে পড়েছে? এ দেশের মানুষকে ঔষধ কোম্পানী এবং মিডিয়াওয়ালারা কী ভাবেন?
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
এপিডেমিওলজিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক হেলথ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।