করোনা: আতঙ্ক বা উৎকণ্ঠা নয় সতর্কতা জরুরী -শিল্পী রহমান

  
    

সময়টা খুব অস্থির। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যেই একটু স্থিরতা আনতে হবে। আমরা জানি অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা কখনোই আমাদের উপকারে আসেনা। তবুও এই উৎকণ্ঠা থেকে বের হয়ে আসা সবার জন্য সহজও হয়ে ওঠে না।
সত্যি করে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করুন তো , এর মধ্যে আপনার কয়বার সন্দেহ হয়েছে আপনার শরীরটা কি একটু গরম গরম লাগছে? টনসিলটা একটু ব্যথা করছে কি ? কাশি কিংবা গা ব্যথা ? আমার নিজেরও হয়েছে। হঠাৎ মনে হয়েছে সারা শরীরে মনে হয় কেমন যেন একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। আমার মেয়ে তো ধরেই নিয়েছিল ও সংক্রমিত হয়ে গেছে। সময়টাই এমন, তবে এতোটুকু সতর্ক থাকা খারাপ না। বরং বুদ্ধিমানের লক্ষণ কারণ আপনি সতর্ক হতে পারবেন। কিন্তু এটা যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এমন একটা পর্যায়ে যেখানে মানুষের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে, নিজের ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে, মেজাজ খিচড়ে যাচ্ছে যখন তখন, অনর্থক কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন তাহলে একটু লাগাম টানবার প্রয়োজন আছে।

শুনলাম নিউ ইয়র্কে একজন মানুষ একজন চাইনিজ ভদ্রলোকের মুখের ওপরে ডিটারজেন স্প্রে করে দিয়েছে। হয়তো ভেবেছিলো চায়না থেকেই এই ভাইরাস শুরু হয়েছে, সেই চাইনিজ ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে এবং সে খুব হাস্যকর ভাবেই তার সেই ভীতি প্রকাশ করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের কাছে যতই বিরক্তিকর বা হাস্যকর মনে হোক না কেন সেই নিউইয়র্কার আসলে উৎকণ্ঠায় ভূগছেন। ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, কি করবে করতে করতে কি করেছে নিজেও হয়তো জানে না।
অস্ট্রেলিয়াতে মানুষের টয়লেট রোল কেনার ধুম পড়ে গেলো, সবাই মিলেই কেমন একটা অস্বাভাবিক আচরণ করলো, যা নিয়ে আমরা বিরক্ত হলাম, অবাক হলাম, জোক করলাম কিন্তু ওই মানুষগুলো তো সত্যি সত্যি ভেবেছিলো যে  দেশ থেকে টয়লেট রোল শেষ হয়ে যাবে। আমরা যাই বলি না কেন এই সংকটের সময় ওদের কাছে এই আচরণের একটা কারণ অবশ্যই আছে। মানুষ বিপদে পড়ে কি করে সেটা বেশীর ভাগ সময় সে নিজেও জানে না।
কাল একজন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তার প্রয়োজনীয় একটা ইলেক্ট্রনিক্সের জিনিষ কিনতে যেয়ে জিজ্ঞেস করেছে এটা কোথাকার, বিক্রেতা বলেছে “মেইড ইন চায়না “, সেই মানুষটা সাথে সাথে বিক্রেতার  মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও একজন চাইনিজ । মুহূর্তে চিৎকার করে নিজের মুখ ঢেকে সে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি, সেই মানুষটা কাঁপতে কাঁপতে বাসায় এসেছে। ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার মতো এবং বেশ কিছু লেপ কম্বল নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবার পর ধীরে ধীরে সাধারণ অবস্থানে এসেছে। ঘন্টা দুয়েরও বেশী সময় সে এমন অবস্থায় ছিল। এই গল্পটা শুনে আমার মনে হয়েছে এটা একটা প্যানিক অ্যাটাক ছিল।

ঢাকায় মাস্ক কেনার হিড়িক

কিন্তু আমরা এসব প্রতিক্রিয়াকে ছোট করে দেখবো না বা তাদের নিয়ে হাসবোও না। কারণ সবাই কোন না কোন ভাবে চিন্তিত। এই ধরণের ভীতিকর একটা সময়ে মানুষের স্বাভাবিক মোকাবেলা করবার ক্ষমতা লোপ পায় আর যাদের পূর্বে উৎকণ্ঠা বা প্যানিক অ্যাটাক হবার অভিজ্ঞতা আছে , তাদের প্রতিক্রিয়া সাধারনের চাইতে একটু বেশী হতেই পারে।  তাই ওদের প্রতিক্রিয়া কে তিরস্কার করে উড়িয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না । বরং তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।
এর মধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি কি কি করা উচিৎ, যেমন ঘন ঘন হাত ধোয়া, শারীরিক স্পর্শ এড়িয়ে চলা, হ্যান্ড শেক বা আলিঙ্গন না করা , ঘন ঘন পানি পান করা, লবন পানি দিয়ে গার্গল করা ইত্যাদি। প্রত্যেকদিন সকালে একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে ১০ সেকেন্ডেরও বেশী ধরে রাখতে হবে, যদি কোন রকম কাশি না আসে তাহলে ধরে নিতে হবে সে ভালো আছে। আর যদি কাশি হয় বা অন্য কোন উপসর্গ  আছে বলে মনে হয় তাহলে নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফোনে ডাক্তারের সাথে আগে কথা বলতে হবে। চট করে ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই। এর পরের সিদ্ধান্ত ডাক্তারই দেবেন। সব রকমের সাবধানতা অবলম্বনের পরেও যদি আমরা আক্রান্ত হয়েই পড়ি তাহলে প্যানিক না করে আইসোলেশনে যাওয়া সবার জন্য ভালো। আমরা নিশ্চয়ই চাইবো না আমার কারণে আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো আক্রান্ত হোক !

যাদের প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে বা হচ্ছে, অর্থাৎ আপনার উৎকণ্ঠা হচ্ছে আর সেটার কারণে আপনি হয়তো শারীরিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। এই শারীরিক পরিবর্তন আপনাকে ভীত করে তুলতে পারে এবং আপনি হয়তো কোন প্রমাণ ছাড়াই তখন ধরে নেবেন, আপনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যেমন শ্বাস নিতে কষ্ট হলে হয়তো ভাবছেন ফুসফুসে সমস্যা, গলায় ব্যথা অনুভব করতে শুরু করতে পারেন, কিংবা শরীর ব্যথা ইত্যাদি ভাবনাগুলো আপনাকে আরও বেশী উৎকণ্ঠা দিতে থাকবে এবং তখন একটা চক্রাকারে বার বার ঘুরে ফিরে আসতে থাকে। ছোট একটা ভাবনা বড় হতে হতে আপনি  ভয়াবহ (catastrophic ) দৃশ্যকে সত্যিকারের বিপদ কল্পনা করে “যদি এমন হয়?” ভেবে আরও বেশী আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন। এরপর ব্যাপারটা আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না তখনই প্যানিক অ্যাটাক হয়।
আপনার যদি পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে আপনি নিজেও এই বিষয়গুলো জানেন তবু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না । আপনি যখন উৎকণ্ঠায় ভোগেন তখন আপনার শরীর এতে সাড়া দেয়, আপনার মধ্যে এক ধরণের শারীরিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এতে আপনার হয়তো কোন ক্ষতিই হবে না কিন্তু আপনার মনে হবে আপনার ভয়ানক কিছু হচ্ছে। আর আপনি যত বেশী এটা মনে করবেন ততো বেশী এই ভাবনায় জড়িয়ে পড়বেন।
এই উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণে আনবার অন্যতম চাবিকাঠি হলো গভীর শ্বাস প্রশ্বাস নেয়া।
মাইন্ডফুল বা সচেতন শ্বাস প্রশ্বাসকে শিথিল করবার একটি অতি উপকারী পন্থা হিসেবে গণ্য করেন বিশেষজ্ঞরা, যা ভয় এবং উদ্বেগ হ্রাস করবার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। সচেতন শ্বাস প্রশ্বাস ব্যবহার আপনার স্নায়ুতন্ত্রের সেই অংশটিকে উদ্দিপিত করে যা আপনাকে স্ট্রেস কমাতে এবং আরও স্পষ্টভাবে চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে। এটা আপনাকে উদ্বেগ ও আতঙ্কের অনুভূতি থেকে রক্ষা করবে।

সুখবর হলো, আপনি যে কোন সময় আবার সঠিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া শিখে নিয়ে নিজেকে স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতে পারেন। নীচের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করলে আপনার ডায়াফ্রেমেটিক শ্বাস প্রশ্বাসের উন্নতি করতে পারবেন বলে ডঃ ম্যাথিউ টাল মনে করেন।
• আরামদায়ক একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে পিঠের ওপর শুয়ে বা বসে পড়ুন। যদি বসার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে মনে করে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন, এবং আপনার কাঁধ থেকে সব টেনশন দুর করে দিন।
• চোখ বন্ধ করুন। আপনি চোখ খোলা রেখেও করতে পারেন, তবে চোখ বন্ধ করলে শ্বাস প্রশ্বাসের পদ্ধতির ওপরে আরও বেশী মনোনিবেশ করতে পারবেন।
• একটা হাত পেটের ওপরে আরেকটা হাত বুকের ওপরে রাখুন
• কয়েকটা শ্বাস নিন যেমন সব সময় নিয়ে থাকেন। আপনার পেট কি প্রতি নিঃশ্বাসে ওঠা নামা করছে ? যদি করে থাকে তাহলে খুব ভালো। এটাই স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেবার কায়দা। কিন্তু যদি আপনার পেট স্থির থাকে এবং বুক ওঠা নামা করে, তাহলে নিশ্বাস নেবার সময় আপনার পেট ওঠা নামা করবার অনুশীলন করুন।
• পেটের ওঠা নামার দিকে মনোযোগ দিয়ে গভীর শ্বাস নিন
• যতক্ষণ ইচ্ছে হয় করুন।
এছাড়াও ভয়টা যদি খুব বেশী জেঁকে ধরে , নিজেকে ডিস্ট্র্যাক্ট করতে চেষ্টা করুন। মুভি দেখুন বা বই পড়ুন। সংগ্রহে যত বই আছে, ব্যস্ততায় এতদিন পড়া হয়ে ওঠেনি, সেইসব বই পড়বার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। কিংবা অন্য কোন শখের কাজ জমে আছে, করে ফেলুন। পরিবারের সবাই মিলে কথা বলুন, অনেকটা গ্রুপ থেরাপির কাজ করতে পারে । মেডিটেশন করুন ১০ থেকে ১৫ মিনিট। অসুস্থ হবার আগেই অসুস্থ হবার প্রয়োজন নেই। তবে সাবধানতা অবলম্বনের কোন বিকল্প নেই।
ভালো থাকবেন সবাই, অনেক অনেক শুভ কামন রইলো এবং পুরো পৃথিবী যেন এই বিপদ থেকে অতি শীঘ্রই মুক্তি পায় সেই কামনা রইলো।

শিল্পী রহমান:
গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments