২০২০ সালের শুরুর দিকে রেডিও টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ অল্প অল্প করে জানতে শুরু করে নতুন এক ভাইরাসের নাম। যা Covid 19 বা করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। এখন পুরো পৃথিবীতে এক আতঙ্কের নামই এই করোনাভাইরাস। এই ভাইরাস প্রতিনিয়ত ধরন বা প্রকৃতি পরিবর্তন করে থাকে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপদজনক হচ্ছে এর ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট। এই করোনা ভাইরাসের থাবায় সারা বিশ্ব এ পর্যন্ত ২৩০ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪.৭ মিলিয়নের বেশি লোক মারা গেছে। এই রোগে বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যু সনাক্ত হয়েছে আমেরিকাতে যার সংখ্যা ৬ লক্ষ ৯১ হাজার এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভারতে ৪ লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশি।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমন দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ (Novel coronavirus ) বা COVID-19 নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৪ই মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১৩টিরও বেশি দেশ করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ “মুকুট”। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে। ধারণা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে। অনেকে আবার বিশ্বাস করে চীনের ল্যাবরোটারিতে এই ভাইরাস নিয়ে গবেষনার সময় অসাবধানতার কারণে দূর্ঘটনাবসত মানবদেহে সংক্রামিত হয়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং জনগনকে তা মানতে বাধ্যকরে। যার ফলে এ রোগ প্রথম ১ বছর ৬ মাস নিউ সাউথ রাজ্যে তেমন একটা ছড়াতে পারেনি। তবে হঠাৎ করে গত জুন মাস থেকে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে কভিড ১৯ ডেল্টা ভেরিয়্যান্টের কারণে পরিস্থিতি দিন কে দিন খারাপ হতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮৬ হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং ১১৬২ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। সরকার নতুন করে আবার চলাচলের উপর বিধিনিষেধ, লকডাউন ও কিছু কিছু এলাকায় রাতে কারফিউ সহ অন্যান্য নতুন কঠোর নিয়ম আরোপ করে এবং জনগন কে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য ভ্যাকসিন নিতে এগিয়ে আসার আহবান জানায়।
ফাইজার ও আ্যস্ট্রজেনিকা ভ্যাকসিন
অস্ট্রেলিয়াতে মুলত BioNTech এর Pfizer ও Oxford এর AstraZeneca ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য আমেরিকার কোম্পানির মর্ডানা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। করোনা আক্রান্ত প্রবণ এলাকাগুলিতে ভ্যাকসিনের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু চাকরিতে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তেমনি আমার সরকারী চাকরিতে টিকা বাধ্যতামূলক করায় টিকা নেওয়ার অনলাইনে Pfizer ভ্যাকসিনের জন্য ফর্ম ফিলাপ করে টিকা গ্রহনের তারিখ পেয়েছি কয়েক মাস পরে।

এ টু জেড মেডিকেল সেন্টার
আমি ফাইজার ছাড়া অন্য কোন টিকা নিতে ইচ্ছুক না এবং আমাদের সেন্ট্রাল কোস্ট এলাকায় করোনা ভাইরাসের হটস্পট না হওয়ায় AstraZeneca ভ্যাকসিন সচরাচর থাকলেও কোন ভাবেই Pfizer ভ্যাকসিনের বুকিং নিতে পারছিলাম না। অপরিহার্য কর্মী হিসেবে টিকা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় এবং করোনা হটস্পট না হওয়ায় কথা হয় ল্যাকেম্বাতে A 2 Z Medical Center এ কর্মরত আমাদের পরিচিত সাজিয়া আফরিন আপার সাথে। আপা ওনার মেডিকেল সেন্টারের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আমাদের কে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে টিকা নেওয়ার ব্যাবস্থা করে দেন।
টিকা নিতে যাওয়ার পুর্বে নিয়ম অনুযায়ী করোনা পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট এবং সাথে টিকা গ্রহনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কপি সাথে নিতে হয়। নিয়ম না মেনে বা প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদি সাথে না নিয়ে এক এরিয়া থেকে অন্য এরিয়াতে গেলে এবং পুলিশের হাতে পড়লে দিতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা।
সব নিয়ম মেনে আমি ও আমার স্ত্রী যাই এ টু জেড মেডিকেল সেন্টারে টিকা নিতে। মেডিকেল সেন্টারের রিসেপশন, নার্স ডাক্তার সবার খুবই আন্তরিক এবং তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে।
টিকা দিতে অপেক্ষারত সময় এ টু জেড মেডিকেল সেন্টারের ম্যানেজার ফিলিস্তিনি বংশদ্ভুত তারিক সালেহ্ নিজে থেকে এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোঁজ খবর নেন আমরা কোথা থেকে আসছি এবং কেনো এতোদূরে এসেছি। তারপর ওনার সাথে ওনার রুমে গিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালী কমিউনিটি প্রসঙ্গে।

ম্যানেজার বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জনের বেশি মানুষ এই মেডিকেল সেন্টার থেকে করোনা টিকা নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ল্যাকেম্বাতে অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের বসবাস এবং এ টু জেড মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার নার্স ও সংশ্লিষ্ট সবাই সবসময় বাঙ্গালী নাগরিকদের আন্তরিকতার সহিত সেবা দিয়ে থাকে।
এ টু জেড মেডিকেল সেন্টারের নার্স খুবই সুন্দর ভাবে টিকার উপকরণ, নিয়মাবলি ও টিকা নেওয়ার পর কি কি সমস্যা হতে পারে তা বিস্তারিত ভাবে বলেন। আমাদেরকে ১ম ডোজ টিকা প্রদান করে। এখন দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার অপেক্ষায় আছি এবং তখন চলাচলের জন্য আরো বেশি স্বাধীনতা পাবো। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সারা পৃথিবীর মানুষ করোনা ভাইরাস জয় করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। মানব জীবন হবে করোনা মুক্ত ও শান্তিময়।

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মুকুল
জন্ম: বাংলাদেশে চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে মাস্টার্স। ২০১৩ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়াতে আসা। বর্তমানে নর্থ সিডনি কাউন্সিলে সরকারি চাকুরী করছেন। শখ: ফুল ফল প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা এবং ছবি তোলা।