বেতফলের নসিব
বদরুজ্জামান আলমগীর
শিরোনামহীন
সবকিছু বন্ধ থাকার কথা- সবকিছু।
ওষুধের দোকান কয়েক ঘন্টার জন্য টেনেটুনে চালু, খাবার দোকানেরও কেবল জানালাটুকু কেজো ;
দেশে বিদেশে বিমান ফেরিওয়ালা, ইসকুল, কলেজ,
রেলগাড়ি বসা; বাস, সিনেমা হল, মন্দির,
ইবাদতঘর বন্ধ- সবকিছুর আগল আটকানো।
সুনসান নীরবতা ফিসফিস, হাড়ের ভিতর
শীত আর ভয়। সারাদিন কেবল সন্ধ্যা,
সন্ধ্যা চমচম সাঁঝের বেলা!
কেবল খোলা, মুখ হা করে আছে কবরখানা- গ্রেইভইয়ার্ড। বাকি সব লকডাউন।
বুক খুলে হাওয়ার মিনাবাজার বারণ,
হাত বাড়িয়ে প্রাণের ব্যথা বুকে টানা বন্ধ।
খালি শ্মশানঘাটা, কবরখানা খোলা!
কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি
কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি
মেঘের পরে মেঘের শরণার্থী শিবির।
কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি লাউনের বিল
জলি ধানের কোমর জড়িয়ে হাওয়ার ব্যাকুলতা
শুনতে থাকি।
অর্ঘ্য সেনের গলায় বসে জানলার বাইরে
দুয়ারের থেকে দূরে দিগন্তের সিথানে জলমগ্ন কথা।
নীলুফার ইয়াসমীনের কন্ঠে খয়েরি দেয়ালের বাইরে
ঝিরঝিরে নামে মেধাবী বর্ষার জল;
দেবব্রত বিশ্বাসের আহবানে আছড়ে পড়ে
রুয়াদরের বিল।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরের নকশি কাঁথায়
ফুটে ওঠে অন্তঃসলিলা তারা-
নমিত ধুলিপড়া তুলসি পাতা।
তাদের গানেরর নিচে আমি একা শুইয়ে থাকি
জলমগ্ন পাথর- শ্যাওলা জলে ধুয়ে যায়
অনাগত জন্মের করতল।
মেঘ ঘন হয়ে আসে নিমজ্জনের ঘোরে-
কোন জানালার শিকে মাথা হেলায়ে দাঁড়িয়ে আছো আমার সিজোফ্রেনিক বোন;
পাথরের সঙ্গে শুয়ে থাকো কেন ও আমার ভাই!
ডুমুর পাতার এতো অন্তরাল, এতোটা নিভৃতি কম্পনের সাথে মিলিয়ে যাও কোথায় জননী আমার!
স্মৃতিডোরের ওই পাশে ধরো ভাগ করে নিই
মেঘেদের জমে ওঠা।
ব্যথা জমিয়াছে- ছায়া ঘনাইছে,
কোথাও এমন ঘনাইছে বুঝি!
জীবিত ও মৃত
সবচেয়ে যে সুন্দর সে মৃত, যে মৃত সে সর্বাধিক জীবিত; চেনা কী অচেনা পরম আত্মীয় কেউ একজন ভেসেভেসে নদীর পাড়ের দিকে আসে! মানুষের জীবনের সাকল্য ধারণ করবার জন্য কেবল জীবনই যথেষ্ট নয়, মৃত্যুও তাকে কুর্নিশ করে চওড়া কাঁধ বাড়িয়ে দেয় জীবনের লাঞ্ছনা ও সম্ভ্রম বহন করে নেবার প্রত্যয়ে, জীবন ও মৃত্যু নামের দুই বেহারা মিলে পালকিতে বয়ে নিয়ে চলে একটি বড় তৃষ্ণার নাম।
মৃতরা ব্যতিক্রমহীনভাবে মানুষের দিকে, লোকালয়ের কল্লোলের পানে যাচিয়া যাচিয়া আসে, কী না-বলা ব্যাকুলতা বলিবার লাগি আধ-খাওয়া সফেদা ফলের মত উন্মুখ হয়ে থাকে!
চেনা কী অচেনা কেউ একজন পরম নৈঃশব্দ্য মাটি পাথারের উপর লুটিয়েলুটিয়ে লোকালয়ের কোলাহলের দিকে আসে, তখনও প্রত্যাখ্যানের গৌরব তার কপালে সেঁটে আছে!
পথ
বলতে বলতে বলা হয়ে গেল
আগাগোড়া সব কথা,
কেবল হলো না বলা আমার একান্ত ব্যাকুলতা।
চলতে চলতে চলা হয়ে গেল
শত মাইল সে-ও জানি
কেবল হলো না ছোঁয়া সেই দুঃখের দানাখানি।
হাসো, হাত বাড়িয়ে দাও
করোনা দিনকেদিন ছোটগল্পের চরিত্র নিচ্ছে- যেমন সত্যিকার একটি ছোটগল্প আদতে শুরু হয়, যখন তা শেষ হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টক শো, পত্রপত্রিকা, মোটিভেশনাল স্পিচ ইত্যাদির মাধ্যমে একটি মনোভাব ও সিদ্ধান্তমূলক জাজমেন্ট গড়ে উঠছে যে, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরক্ষর, গরীব, নিম্নবিত্ত, নিডি মানুষদের অশিক্ষা কুশিক্ষার কারণে করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না! বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো।
করোনা এসেছে মুনাফাখোর, লোভী, অমানবিক, নৃশংস, উচ্চবিত্ত শ্রেণি ও তাদের করপোরেট অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কারণে। গরীব, নিম্নবিত্ত, গৃহহারা মানুষকে যদি অসচেতন বলি তাহলে তার থেকে বড় অন্যায় কিছু নাই; তাঁরা অসচেতন নন- নিরুপায়; যার ঘরই নাই সে কীভাবে কোয়ারেন্টিনে যাবে, যার পেটে একদানা ভাত পড়েনি, সে কীভাবে ভিটামিন সি খাবে?
সামাজিক দূরত্ব বলে যে এক ভয়ানক শব্দবন্ধ চালু হয়েছে- তাকে মানবসংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন দেবার পরিকল্পনা করা হচ্ছে- এটি করোনা পরবর্তী কালের সবচেয়ে বিধ্বংসী সংবাদ। একটিই চ্যালেঞ্জ হোক- এ সামাজিক দূরত্ব কেবলই আপদকালীন, সাময়িক; এ-দূরত্ব যেন আমাদের সংস্কৃতিতে জন্মদাগের মতো বসে না যায়।
বিজ্ঞান জেগে আছে, দেশে দেশে বিজ্ঞানীরা রাতকে দিন দিনকে রাত করছেন প্রতিরোধ আবিষ্কার করার জন্য। সেইদিন খুব বেশি দূরে নয়- অবশ্যই বিজ্ঞান এইদিনকে নিয়ে যাবে সেইদিনের কাছে!
এ-বেলায় আমরা উন্মুখ হয়ে আছি আবার সেই নৈকট্য ও মায়ায় বন্দী হবার আশায়! আমরা পরিশ্রমী মানুষেরা ভাইরাস নয়, বহন করি প্রাণের ফল্গুধারা।
লম্পট ধনিক শ্রেণি ও পাগলাওঘোড়া করপোরেট পুঁজির একমাত্র দরকার মুনাফা- তাদের জন্য দূরত্ব বরং সুবিধাজনক, কিন্তু শতকোটি বছরে পরিশ্রমী মানুষ জীবন বাজি রেখে গড়ে তুলেছে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ জড়ানোর নকশিকাঁথা।
এই যে ঢলের মতো হেঁটে যাচ্ছে মানুষ, পথে পথে শুয়ে আছে মানুষ, দিনের পর দিন ঘরে আটকে আছে মানুষ,
বিজ্ঞানাগারে জীবন বাজি রেখে জেগে আছে মানুষ- একটিই স্বপ্ন- কতোদিন তুমি মুখ ঢেকে রেখেছো, কতোদিন ঢেকে রেখেছো হাত- এবার তোমার হাতটি বাড়াও ধরি, মুখটি খোলো, আদিবাসী মানুষের সারল্যে একবার হাসো।
তৃষ্ণা, তৃষ্ণা- হাত ধরার পিপাসা, হাসি দেখার বাসনা:
হাসো, হাত বাড়িয়ে দাও!
মহিষচরিত মানস
তুমি এমন সরল, বাতাসের বাথানে দাওয়াই!
তোমারে কষ্ট দিলে মনে হয়
ত্রিপিটকের একখান পাতা ছিঁইড়া ফেললাম!
তা-ও তোমারই মনে দাগ ফালাই।
ক্ষমাসুন্দর মনে দেইখো, এই মিনতি করি গো!
কাউরে কষ্ট দিতে না পারলে বাঁইচা থাইকা লাভ কী!
এককাপ চা না খাইলে তো
সকালটাই ম্যাড়মেড়ে লাগে,কী করুম কও?
তুমি উডানের কোণায় খাড়াইয়া আছো নিমগাছ
শুরুতে তুমি কিন্তু নিমগাছ আছিলা না
তুমি ছিলা ডেউয়া ফলের চারা।
ডেউয়া ফলে যে পানি থাহে
সেই পানি দিয়া আমি মুইচা দিচি হাসির দাগ,
ডেউয়া ফলে যেই না পানি মুচতে যাই
তুমি কও, আল্লা, আল্লা, পানি মুইচো না
তোমার পানির তিরাশ লাগবো,
লাগবোই খালি ঠাডামারা পানির তিরাশ!
চোখের পানি মায়ের আদর, বোইনের উমের চাদর!
একেএকে কতো পইখ পাখালি পাহাড় পর্বত
নদীনালা খাল বিল বাঘ বাঘালি হাত্তি সিংহ দেখলাম
কিন্তু আমার সবথাইকা ভাল্লাগে মহিষ!
আমার মনে হয়, একটা বোবা মেয়ের সবটা কথা,
রেল লাইনের পুরাটা সবুর মিলে হয় একটা মহিষ!
সব পক্ষী উইড়া যায়, বাঁশের আগায় কিচিরমিচির করে
সব খোঁয়াড়ের গবাদি গরুভেড়া চালাকচতুর হইয়া উডে
তামাম দুনিয়া নড়াচড়া করে,
খালি মাডি নড়ে না, কোনহানে যায় না-
জনম জনমভর একজায়গায় খাড়াইয়া থাহে,
আর নড়ে না মহিষ।
ধইরো, তুমিই আমারে মরণের পরেও ধইরো
তোমার কাঙখের কলসে আমি যমুনার জল হইয়া থাকুম,
তুমি কবরের লাহান শেষকথা, মহিষের সমান মেওয়া ফল।
ঘোড়াউত্রা গাঙ্গের কাছে কইচি, আমি তোমার কথা কইচি!