
গত পরশুদিন আমার এক পরিচিত লোক ফোন করে বাংলাদেশে করোনা বিষয়ক ত্রান কার্যক্রমে কত টাকা লাগতে পারে, তার একটা হিসাব দিলেন। আমি তো শুনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কারন তাঁর গণিত বিষয়ক জ্ঞানের প্রতি আমার কখনই কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি বেশ শিক্ষিত। অংকে বরাবরই ভাল, আমার মতো কাঁচা নন। তিনি একটা ঐকিক নিয়মের অংক বললেন,
অংক একঃ
-বাংলাদেশের ১৮ কুটি মানুষের জন্য ১৮ কুটি টাকা দিলেই তো প্রত্যেকে এক কুটি করে টাকা পাবে। শেখ হাসিনা কেন ৭২ হাজার কুটি টাকা বরাদ্দ করলো? এত টাকা বরাদ্দ করার তো কোনো দরকার ছিল না। আওয়ামীলীগের লোকেরা লুটেপুটে খাবে, বুঝছেন ভাইজান?
-হু। বুঝছি।
এটা তো পাবলিক পাটিগণিত অথবা ম্যাংগো ম্যাথামেটিক্স। তাই বুঝতে কোনো সমস্যা হয় নাই, এক্কেবারে পানির লাহান সোজা। অংকটির মহত্ত্ব নিয়ে ভেবে হঠাৎ মনে হলো, আরে এটা তো শুভংকরের ফাঁকি। ১৮ কোটি মানুষের জন্য ১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করলে প্রত্যেকে মাত্র এক টাকা করে পাবে, এক কোটি নয়।
চলুন, এবার আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারি পাটিগণিত, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির পাটিগণিতটা কেমন, সেটা একটু দেখি। মীরজাদী সেব্রিনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিবের হিসাবের ধরণ আসলে একই। উভয়েই আমাদেরকে যে সংখ্যাগুলো বলেন, তা কিন্তু শুধুমাত্র যাদেরকে টেস্ট করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, কতজন মারা গেল সেটা বলেন। যাদেরকে টেস্ট করা হয়নি, তাদের কথা তারা জানেন না, তাই বলতে পারেন না।
তামাম দুনিয়ায় যারা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন, তারা কি এই হিসাবে কনভিন্সড? আমি কনভিন্সড না, কারণ আমার সামান্য বুদ্ধিতে এটা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু এতে সমস্যা কি? সমস্যা আছে। এতে সত্য লুকানো আছে। একজন গবেষকের কাজ সত্য খুঁজে বের করা এবং তা প্রকাশ করা।
উদাহরণ স্বরূপ, যে কোনো গবেষণায় স্যামপ্লিং করে গবেষণা করা হয়। তার মানে ৫০০ অথবা ১০০০ মানুষের উপর একটি গবেষণা করে বলা হয়, “কোনো একটি রোগে কত মানুষ আক্রান্ত হতে পারে অথবা মারা যেতে পারে”। যেমন, ইতালিতে ৯০৬৮৬৪ (নয় লাখ ছয় হাজার আটশো চৌষট্টি জন মানুষকে টেস্ট করে ১৪৭৫৭৭ (এক লাখ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশো সাতাত্তর) জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। যা ১৬.৩%। এটা কিন্তু ইতালির মোট জনসংখ্যার হিসাব নয়। চলুন আরেকটি পাটিগণিত অংক করি। তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যেতে পারে।
অংক দুইঃ
বাংলাদেশে যদি ৭৩৯৪ জন মানুষের করোনা টেস্ট করে ৪২৪ জন করোনা আক্রান্ত রোগী (শনাক্ত করা হয়েছে) পাওয়া যায়, তাহলে ১৮ কোটি মানুষকে টেস্ট করলে কতজন রোগী পাওয়া যাবে?
যারা অনেক লেখাপড়া জানেন, এসব ফালতু অংক করে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার দরকার নাই। আপনার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যারা ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ে তাদেরকে দিন, ইনশাল্লাহ দুই-এক মিনিটের মধ্যেই অংকটি করে ফেলবে। অংকটির রেজাল্ট ১,৩২,১৮৮২ (এক কোটি বত্রিশ লাখ এক হাজার আটশো বিরাশি জন)। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫.৭৩%।
কি জনাব, মাথা ঘুরছে? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? কেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? হিসাবটি কি যুক্তিসঙ্গত নয়? চলুন অন্যদেশগুলোর দিকে তাকাই। একই নিয়মে হিসাব করে দেখা গেছে, যাদেরকে টেস্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে ফ্রান্সে ৩৭.৪%, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯.৭% মানুষ করোনা আক্রান্ত। উক্ত দেশগুলোতে যাদেরকে টেস্ট করা হয়নি, তাদের মধ্যে কত পারসেন্ট? আমরা তা জানি না।
এই অংকেও ঘাপলা আছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এক কোটির বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত, তা কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তাহলে প্রকৃত ঘটনা কি? যাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হবার কোনো লক্ষণ নেই, তাদেরকেও এই অংকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেটা কেন করা হবে? তাই অংকটিতে বিরাট সংখ্যক মানুষের করোনা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এটাই এই অংকের প্রধান দুর্বলতা। তার মানে এটাও ম্যাংগো ম্যাথামেটিক্স অথবা পাবলিক পাটিগণিত।
যাদের মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ নেই তাদেরকে আমরা হিসাবের মধ্যে আনবো কেন? এমনকি যাদের মধ্যে করোনার মতো লক্ষণ আছে, তাদের টেস্ট করেও মাত্র ৫.৭৩% মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। সুতরাং জ্বর কিংবা কাশি হলেই কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, চট করে তা বলা যায় না। কেবলমাত্র পরীক্ষা করেই বলা যাবে। অতএব হিসাবটা অন্য রকম হওয়া উচিৎ। সেই হিসাবটা কি? এ ব্যাপারে জানার জন্য জার্মান দেশের দুই পন্ডিতের কাছে যাওয়া যাক-
সেন্ট্রাল জার্মানির গ্যোটিংগেন ইউনির্ভাসিটির দুই গবেষক ক্রিস্টিয়ান বোমার ও সেবাস্টিয়ান ভল্মের মাসিক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি গবেষণাপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করেন। তারা করোনা আক্রান্তের আনুষ্ঠানিক রেকর্ড কতটা ঠিক সেটা মূল্যায়ন করতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যু এবং সংক্রমিত হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মাঝের সময় নিয়ে হিসাব করেন। এতে দেখা যায়, পৃথিবীজুড়ে দেশগুলো গড়ে মোট আক্রান্তের মাত্র ছয় শতাংশ শনাক্ত করতে পেরেছে।
অধ্যাপক ভল্মের বলেন, ‘আসলে করোনা সংক্রমণের মোট সংখ্যা ইতোমধ্যেই কোটি ছাড়িয়েছে। তাই সরকার বা নীতিনির্ধারকদের করোনা সংক্রমণের সংখ্যার ভিত্তিতে কোনও পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে চরম সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।’ বিভিন্ন দেশে টেস্টের পরিমাণ ও টেস্টের ফলের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যেও ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে বলে সতর্ক করেন অধ্যাপক ভল্মের। তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক এসব তথ্য খুব একটা সাহায্য করতে পারবে না।’ দুই গবেষক বলেন, ৩১ মার্চ পর্যন্ত জার্মানিতে হয়তো চার লাখ ৬০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে হয়তো মোট সংক্রমণ এক কোটি ছাড়িয়েছে। স্পেনে ৫০ লাখের বেশি, ইতালিতে ৩০ লাখের বেশি এবং যুক্তরাজ্যে ২০ লাখের মত মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন।
অথচ জন হপকিন্স ইউনির্ভাসিটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে নয় লাখের মতো মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, অপর্যাপ্ত এবং দেরিতে টেস্ট করানোর ফলেই হয়তো ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপের কয়েকটি দেশে জার্মানির তুলনায় করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর হার এত বেশি। এই গবেষকরা বলছেন, জার্মানি তাদের মোট আক্রান্তের প্রায় ১৬ শতাংশকে শনাক্ত করতে পেরেছে। সেই তুলনায় ইতালি মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্পেন ১ দশমিক ৭ শতাংশ সংক্রমণ শনাক্ত করেছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্তের হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ আর যুক্তরাজ্যে এ হার ১ দশমিক ২ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের শতকরা কতভাগ শনাক্ত করতে পেরেছে? কিংবা পারবে?
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
এপিডেমিওলজিস্ট, একাডেমিক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।