
আমি পেশাদার লেখক নই। তবে সঠিক খবরের জন্য একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসি। নিজের অনলাইনের সম্পাদনা এবং প্রবাসের কর্মব্যস্ততার জন্য অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তেমন লেখালেখি করা হয়না। ব্যস্ততার কারণে সংবাদপত্র জগত থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেস্টাও করেছি। কিন্তু বন্ধু সিডনি প্রতিদিন সম্পাদক নাঈম আবদুল্লাহ এবং প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমানের অনুপ্রেরণায় দু’একটি লিখছি। প্রশান্তিকায় পর পর দু’টি লেখা পাঠিয়েছি এবং তিনি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেছেন। গতকাল ইনবক্সে তিনি প্রথম লেখাটির একটি স্ক্রীন শট পাঠিয়ে বলেছেন, ‘ভাই আপনার লেখাটি আমাদের মূল পেজ এবং ফেসবুক পেজ থেকে অসংখ্যবার শেয়ার হয়েছে।’ এটা জেনে আরো উৎসাহিত হয়েই করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক পরিবর্তন নিয়ে আমার আজকের এই লেখাটি।
আমার ত্রিশ বছরেরও অধিক সময়ের সাংবাদিকতা জীবনে করোনাভাইরাস রোগের মত বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব ও দ্রুত বিস্তারের ঘটনা, বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এমনভাবে প্রভাব এবং প্রাকৃতিক ভারসম্যের পরিবর্তন কখনো দেখিনি। বিশ্ব মিডিয়াকেও এমনভাবে ঐকবদ্ধভাবে কাজ করতে দেখিনি।
গত ১১ই মার্চ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৯৯টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৭ লক্ষ ২২ হাজার ১১৯ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৩ হাজার ৯৭৬ ব্যক্তির মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি অস্ট্রেলিয়ায় নিউ সাউথ ওয়েলসে রাজ্যে বসবাস করি। অস্ট্রেলিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪,১৬৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করলো ১৭ জন। এদের মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসে আক্রান্ত হয়েছেন ১,৯১৮ জন।
মহামারী করোনাভাইরাস আজ সারা বিশ্বে এক আতঙ্কের নাম। ছোট্ট একটি ভাইরাসের কাছে দুনিয়ার সমস্ত শক্তি আজ পরাজিত। মজলুম থেকে শুরু করে বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও আজ মৃত্যুর ভয়ে অস্থির। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে
বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং মানবতাবোধে বলীয়ান হওয়ার অবারিত সুযোগ এসেছে। সুযোগ এসেছে ধর্ম-বর্ণ, হিংসা-বিদ্বেষ, ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতার লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নতুন মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার।
ইউরোপের দেশ স্পেন ৭১১ খ্রীস্টব্দে মুসলমানদের আধিপত্বে আসে এবং ১৪৯২ খ্রীস্টব্দে মুসলিম শাসনের অবসানের পর দেশটি খ্রিষ্টানদের শাসনে পরিণত হয়। এরপর থেকে দেশটিতে প্রকাশ্যে বা উচ্চস্বরে আজান দেয়ার কোনো ইতিহাস নেই। করোনাভাইরাসের ভয়ে এবার প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে আজানের অনুমতি দিল দেশটির প্রশাসন। আজানের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো পুরো স্পেন।
ইতালীর প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তেরে টুইটারে বলেছেন, ‘কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে।’ তিনি সব ধর্মের লোকের কাছে তাদের নিজ নিজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন। মুসলমানদের নামাযের সাথে অনেক বিধর্মীও আজ নামাযে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
করেনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ পর চীন সরকার উইঘুর প্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর বিতর্কিত কার্যক্রম ও নির্যাতন বন্ধ রেখেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট মুসলিমদের বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। করোনা প্রভাবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন, কাশ্মীর ও অন্যান্য দেশে সম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্হ্য সচেতনতা ফিরে এসেছে। করোনাভাইরাস রোধে এবং দরিদ্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছন বিত্তবানসহ সাধারণ মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র সাহায্য করছে অপর রাষ্ট্রকে। বিশ্বের ২০টি ধনী দেশের জোট জি-টোয়েন্টি, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। মহামারী করোনাভাইরাস বৈশ্বিক সৌহার্দ্যের মাধ্যমে মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
করোনাভাইরাসের লকডাউনের পর ধীরে ধীরে প্রকৃতিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের দিকে তাকালে দেখা যায় ডলফিন, পাখি, বানর, হরিণসহ নানা জাতের প্রাণী অবাধ বিচরণ করছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় যেন এক অমূল পরিবর্তন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যখন তোমরা শুনবে যে, কোন শহরে প্লেগ প্রভৃতি মহামারী দেখা দিয়েছে, তখন সেখানে যেও না। আর যদি কোন এলাকাতে এ রোগ দেখা দেয় এবং তুমি সেখানেই থাক, তবে সেখান থেকে পলায়ন করবে না।‘ [বুখারী ৩৪৭৩, মুসলিম: ২২১৮]
মহামারী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সারা বিশ্বে আজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে সমগ্র বিশ্ব প্রায় লকডাউন হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের দেশের মধ্যে নানা রকম কঠোর থেকে কঠোরতম বিধি-নিষেধ জারি করেছে এবং নাগরিকদের জন্য সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গতকাল রোববার রাতে জাতীয় মন্ত্রিসভায় একাধিক বৈঠকে নতুন নীতিমালার বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা একমত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ও অঞ্চলগুলি আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ভাড়াটিয়ারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারলেও তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। আগামী ছয় মাসের জন্য উচ্ছেদের উপর এই স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকবে।
এছাড়াও ক্লাব, জিম, সিনেমা, বীচ, খেলার মাঠ, পার্ক, স্কেট পার্ক, উপাসনালয় বন্ধ থাকবে এবং একজনের বেশী লোক জরো হওয়া যাবেনা। ৭০ বছর বয়সে উর্দ্বে বয়স্কদের ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা যেদেশেই থাকিনা কেন নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, এবং দেশের স্বার্থে সরকারের দেয়া বিধি-নিষেধগুলো আমাদেরকে অবশ্যই পালন করতে হবে। সর্বাপরি সৃষ্টি কর্তার প্রতি ধৈর্যধারণ করতে হবে।
মোহাম্মাদ আব্দুল মতিন : সাংবাদিক, সম্পাদক: বিদেশবাংলা , সাধারন সম্পাদক: সিডনি প্রেস এন্ড মিডিয়া কাউন্সিল।