করোনা ভাইরাস : অভিমান, উপলব্ধি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা । শিল্পী রহমান

  
    

আমার মেয়ে নদী করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো মার্চ মাসে। ও নিউ ইয়র্কে থাকে। তখনও নিউ ইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা তেমন একটা বাড়তে শুরু করেনি। আমার মেয়ে একজন আর্কিটেক্ট,  সাবওয়ে ব্যবহার করে প্রতিদিন অফিসে যায় বলে প্রথমেই ভয় পেয়েছিলাম । তার দুয়েকদিনের মধ্যে অফিস থেকেও ঘরে বসে কাজ করবার অনুমুতি দিয়ে দিয়েছিলো ওকে। তারপরেও আক্রান্ত হয়েছিলো আমার ২৬ বছরের মেয়ে নদী । হয়তো গ্রসারি করতে যেয়ে কিংবা অন্য কোনভাবে লেগে গিয়েছিলো । ও খুব সাবধানী মেয়ে, তাই দৃঢ়টার সাথে বলতে পারি ও নিয়ম পালনে কোন অবহেলা করেনি, তবুও সংক্রমিত হয়েছে। ১৪ দিন খুব কঠোর কোয়ারেন্টাইনে ছিল, মাইল্ড উপসর্গ ছিল বলে সুস্থ হয়ে গিয়েছে ।

প্রথম ৩/৪ দিন ছিল খুব ভয়ঙ্কর রকমের উৎকণ্ঠার সময় । মেয়েটা একা জ্বর, গা ব্যথা, কাশি, শ্বাস কষ্ট, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, বমি এবং ফ্যাটিগ নিয়ে কি করবে ? কতোটা কষ্ট হচ্ছে, বাঁচবে কিনা কতো রকমের শঙ্কা যে কাতর করে রেখেছিলো মন। আল্লাহ্‌র কাছে কান্না কাঁটি করা ছাড়া কিছু করবার ছিল না দূর থেকে।

বেশী মানুষকে বলিনি তখন, একদম পরিবার ছাড়া খুব কম লোকই জানতো। বিভিন্ন রকমের প্রচার মানুষকে কত দূর্বল করে দেয় তার একটা প্রমাণ হলো আমার ওই সময়কার মানসিকতা। আমার অনেককেই বলতে ইচ্ছে হয়নি তার একটা কারণ হলো, মানুষ যদি আমাকে বা আমার মেয়েকে জাজ করে দুটা কটু কথা বলে আমি সেটা নিতে পারবোনা । আমার খুব পরিচিত একজন বলেছিলসত্যিই তো, লক্ষ্য করে দেখো, কাফেররাই বেশী মারা যাচ্ছে আমি অবশ্যই এই কথা বিশ্বাস করি না কিন্তু আমার মেয়ের অসুস্থতা শুনে কেউ যদি ঘুণাক্ষরেও এমন একটা কথা মনে আনে তাহলে সেটা নেওয়া সম্ভব হতো না। যদিও আমি এইসব ব্যাপারে এবং আমার সন্তানদের যে কোন বিষয়ে মানসিক ভাবে অনেক শক্তি রাখি কিন্তু এই সময়টাতে বা নিজের সন্তানের অসুস্থতার কারনেই হয়তো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম  আর সেই কারনেই  খবরটা জানার পরেও দুয়েকজনের নির্লিপ্ত ভাব দেখে খুব অভিমান হয়েছিলো আমার, কাছের ভেবেছিলাম বলেই হয়তো এই অভিমান। পরে ভেবেছি, সবার এমন ত্রাহি ত্রাহি একটা অবস্থা, নিজে কিভাবে সুস্থ থাকবে সেই ভাবনায় অস্থির মানুষ এর মধ্যে আমার অভিমান করার কোন মানেই হয়না  তাই ভুলে গেছি সেই অভিমান। তাছাড়া এখনকার সময়টা মানুষকে ক্ষমা করে দেবার জন্য, অভিমান করার জন্যে নয়। নিজের পরিবার এবং অনেক বন্ধুরাই আবার খুব আন্তরিক ভাবেই খোঁজ খবর নিয়েছিল তখন  তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

এই সত্য অনুভূতিটা অকপটে স্বীকার করলাম, কারণ আমি এক আত্মীয়ের সামান্য খোঁজ না নেয়ার জন্য অভিমান করে বসেছিলাম অথচ বাংলাদেশে একজন সন্তান তার বাবাকে ফেলে চলে গেছে, এক বন্ধুর আকুল আবেদনেও আরেক বন্ধু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে না বলে সেই অসুস্থ বন্ধু সিঁড়ির মধ্যে পড়েই মৃত্যু বরণ করেছে, আপন মানুষ মৃত মানুষের সৎকার করা থেকে দূরে থাকছে, ১০ বছরের বাচ্চা মেয়েটার মৃত দেহটা সৎকারের সময় একটা খাটিয়া পায়নি, বাড়িওয়ালা তার অসুস্থ ভাড়াটেদের বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে , ডাক্তারদের বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে না কারণ তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী বলে; এমন আরও কতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কি এক অমানবিক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মানবসভ্যতা ! যা এক সময় সিনেমাতে দেখেছি তা এখন প্রতিদিনকার খবরে শুনি।

এই সময়টাকে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই, আমরা এর মধ্যেই আছি এবং আমরা সবাই আমাদের পরিচিত সীমানাকে অতিক্রম করছি প্রতিনিয়ত। যা পারবো না বলে ভাবতাম একসময়, তাই পারতে বাধ্য হচ্ছি। নিজেকে , নিজের ক্ষমতা বা দক্ষতাকে চিনতে পারছি নতুন করে, কতো অসম্ভবকে সম্ভব করছি। আজ দেখলাম একটি সংস্থার ( আল মারজাকুল ইসলাম) একদল মানুষ বিভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মৃতের সৎকার করছেন । এটা তো উনাদের জন্য একটা বিরাট সীমানা অতিক্রমকারি কাজ এবং অত্যন্ত মহৎ কাজ , উনারা নিশ্চয়ই স্বপ্নেও কোনদিন ভাবেননি অন্য ধর্মের মৃতের সৎকার করবে। উনারাও কিন্তু নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে এই কাজে নেমেছেন।
আমার ধারণা আমাদের সবার একটা স্পিরিচুয়াল পরিবর্তন আসবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আমরা অবশ্যই কেউই আর একই মানুষ থাকবো না, পরিবর্তন হবেই অর্থাৎ আমরা বেড়ে উঠবো। এটাতে ভয় পাবার কিছু নেই, আমার বিশ্বাস এই সময়টা পার হয়ে গেলে আমরা যেই মানুষটাতেই রূপান্তরিত হই না কেন সেটাই হবে আমাদের সত্যিকারের পরিচয়, কারণ আমরা সবাই ঘষে মেজে আপন রঙ নিয়ে বের হয়ে আসবো এই সঙ্কট থেকে। মানুষ যখন অসহায় হয় তখন সে তার সর্বশেষ চেষ্টা দিয়ে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করে । সেই জায়গাটা সাধারণত সবার অপরিচিত থাকে, এমন অপরিচিত জায়গা থেকে নিজেকে উদ্ধার করে আনতে পারলে মানুষ তো পরিবর্তন হবেই।

আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবার পর নিউইয়র্কের অবস্থা অনেক বেশী খারাপ হয়েছে, প্রতিদিন খবর দেখেছি আর আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি। অসুস্থ হবার ৭ দিনের মাথায় ওর চাকরিটাও চলে গেছে । একদিকে শরীর খারাপ অন্যদিকে ভবিষ্যতের চিন্তা কারণ চাকরী চলে যাওয়া মানে শুধু অর্থনৈতিক সংকটই নয়, অন্যান্য আরও অনেক সমস্যা এসে সামনে দাঁড়ালো। ৬০ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে। এদিকে আমার কাছে নিয়ে আসবো তারও উপায় নেই। নিজে ওর কাছে যাবো সেটাও সম্ভব হয়নি। আমার মেয়েটা ভালো হয়ে গেছে ভেবে যখন স্বস্তি বোধ করছি ঠিক তখনই আবার শুনতে পেলাম পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বস্তি মেলে না কিছুতেই ! কবে যে মিলবে স্বস্তি, এই ভেবে আমরা সবাই বুকে সাহস খুঁজতে চেষ্টা করি।
আমার মেয়েটা খুবই সাহসী । অন্য কেউ সংক্রমিত হতে পারে ভেবে ওই শরীরে উবার না ডেকে, ২০ মিনিট পায়ে হেঁটে হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করিয়েছে। টেকনোলোজিকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ, ভিডিও কলে সারাটাক্ষণ পাশে থাকতে পেরেছিলাম বলে। এই সুবিধাগুলো না থাকলে এই সময়টা আরও বেশী কঠিন হয়ে যেতো মানুষের জন্য।
Zoom এর মাধ্যমে এখন সে সপ্তাহে ৪ দিন Yoga ক্লাস নেয়, মানসিক শক্তি বজায় রাখবার জন্য মেডিটেশন করে, সঠিক শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে নিজেকে শান্ত এবং সুস্থ রাখতে চেষ্টা করে। নদী ফিরে যাবে ব্রিসবেনে মে মাসের মাঝামাঝি। সেখানেও আমরা নেই, তবুও ওটা ওর দেশ সেটাই ভরসা।

আমি জানি আশাহত হবার মতো অনেক কিছু হচ্ছে চারিদিকে কিন্তু সেগুলো দিয়ে এমনিতেই পৃথিবী ভরে গেছে তাই আর ওসব বললাম না । অনেককেই দেখছি অন্যকে ভাগ্যবান মনে করছেন। যারা বাইরে কাজ করছেন তারা ঘরে থাকতে পারলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতেন, কেউ আবার ঘরে থাকবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে গেছেন মানব কল্যানের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করবার জন্য। বিভিন্ন রকমের চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলি দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে কতো মানুষ যে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যে যেভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে। অনেক মানুষ নিজে রান্না করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে মানুষের হাতে হাতে খাবার দিয়েছে, অনেক বাড়িওয়ালা তার ভাড়াটেদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছেন না, অনেক মানুষ তার বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে ডাক্তারদের থাকবার জন্য, ওষুধের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করছে । আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমার ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করা বন্ধুকে বলে ঢাকার বাইরে অসুস্থ মানুষের কাছে ওষুধ পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আমি কিছুই করিনি শুধু ফোন করেছি, দয়া দেখিয়েছেন ওষুধ কোম্পানি। এইসব সাহায্যগুলো আশীর্বাদের মতো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষের। অনেক হতাশার মাঝে এগুলো আশার সঞ্চার করে।
সবশেষে ধন্যবাদ জানাবো সেইসব অসাধারণ সাহসী মানুষদের যারা প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হবার সময় জানেন না আজ তারা সংক্রমিত হবেন কিনা, যারা নিঃস্বার্থভাবে মানব সেবায় নিয়োজিত করেছেন নিজেদের। হাসপাতালের ডাক্তার নার্স থেকে শুরু সমস্ত কর্মীরা , ব্যাংকার, পোস্টম্যান, বাইরে আর্মি, পুলিশ, র্যাব, এসি ল্যান্ডের কর্মীরা, আর রয়েছেন আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের দল। আপনাদের কারো ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না, শুধু দোয়া করি আপনারা সবাই সুস্থ থাকা অবস্থায় এই করোনা সঙ্কট দুর হয়ে যাক। আর যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিয়েছেন তাদের প্রতি রইলো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনাদের আত্মার শান্তি কামন করি।

শিল্পী রহমান:
গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
 প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments