কলিকাতা হারবাল -আরাফাত তন্ময়

  
    

সমস্যাটার গোড়ায় অবশ্য অমরাবতী।
তার রাগে বলি হয়ে যদি অমর্ত্যের সাথে হারবালের কোম্পানির বিজ্ঞাপনদাতা অমূল্যের দেখা না হতো  তাহলে এই মহাকাণ্ড ঘটত না।
অমর্ত্য তার একমাত্র বউকে আদর করে ‘অমি’ বলে ডাকে। ‘কলুরবলদ’ অমর্ত্য টাকার অভাবে স্ত্রীর শখ-আহ্লাদ মেটাতে পারে না। তবে তাকে প্রাণের অধিক ভালোবাসে। তার হাইব্রিড কথায় স্ত্রীকে ভুলিয়ে রাখাতে চায়; অমরাবতীর এবার সোনার গয়না চাই’ই চাই। কিন্তু তার স্বামীর সেটা দেয়ার যে মুরোদ নেই! তবে অমর্ত্য হার মানতে রাজী নয়। সে ইঙ্গিতে জানান দিল, গয়নাগাটি সে অপছন্দ করে এবং ভোগ-বিলাসের জন্যই দেশটা নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে। অতএব,…..
কথাটি সম্পূর্ণ শেষ করতে পারল না।

অমরাবতী স্বামীর এসব কথাবার্তার সাথে সুপরিচিত। যতসব তাকে গয়না কিনে না দেয়ার ধান্দা। অমর্ত্য যে অপারগ এবং সে তা কোনোভাবেই স্বীকার করতে নারাজ তা অমরাবতী ভালোভাবে বুঝে। কিন্তু নারীর সৌন্দর্য যে গয়নাতেই লুকায়িত এ কথাটিও ভুলে থাকা দায়! অমরাবতী রেগে উঠে বলল, যার এলার্জী থায়, সে মাইনষে আবার ফুলের গেরান হুঁইকতে যায় ক্যান!
অমর্ত্য ভাবল, দারূণ কথা!
সব কথার ইতি কথা হলো, সে পুরুষ মানুষ। মেয়ে মানুষের ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় রক্ত মাথায় চড়ে। অমর্ত্য বউয়ের সাথে বাকবিতণ্ডায় না জড়িয়ে ঘরে ঢুকে কোষ ভরে নবরত্ন তেল মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

চৈত্রের রোদ চরমভাবে গায়ে লাগে। সবকিছু পুড়ে যাবার অবস্থা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল দীঘির ঘাটে। দীঘির ঘাটে বসামাত্র নিজের পায়ের দিকে খেয়াল করল সে। হনহন করে আসার সময় কখন যে গোবরে পা দিয়ে এসেছে তা বুঝতে পারল না। ঘাট থেকে উঠে পা ধোয়ার জন্য যাবে ঠিক সেই সময় অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে শুনতে পেল, ‘আর নয় হতাশা, আর নয় ব্যর্থতা। এক পাইলেই যথেষ্ট……’
অমর্ত্য চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল একদম অচেনা এক ভদ্রলোক মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রিকশায় বসে থেকে তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে! অমর্ত্য তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে পা ধুয়ে পাড়ে এসে দাঁড়াল।
কলিকাতা হারবালের একমাত্র পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনদাতা অমূল্য চক্রবর্তী মুখে হাসি নিয়ে রিকশায় বসে আছে। অমূল্যের অবশ্য এই গাঁয়ে আসার কথা ছিল না। শহরের পথ ধরেছিল কিন্তু পথিমধ্যে সামান্য সমস্যার জন্য সকালের বাসের নাগাল পায়নি, বিকাল চারটা নাগাদ শহরে পৌঁছানোর আর কোনো বাস নেই। উপায়ন্তর না দেখে সে মাইক আর রিকশা ভাড়া করে গ্রামে বেরিয়েছে। যদি কোনো মক্কেল পাওয়া যায়! অবশ্য হারবালের ক্রেতাদের আবার সবাইকে মক্কেল বলার দুঃসাহস কারোর নেই।
বিস্মিত অমর্ত্য বলল, আপনে এইখানে কোত্থেকে আইলেন?
‘আর নয় ব্যর্থতা, আর নয়….’
কথাটি শেষ হবার আগেই অমর্ত্য বলে উঠল, তা তো বুইঝলাম। কিন্তু আপনে কোত্থেকে আইলেন? গাঁয়ে আমরা এট্টু শান্তিতে। আপনেরা এসে জুইটলে তো…..
অমূল্য বলল, ব্যবহার করে দেখুন। ভালো কাজ করে।
তেল ভর্তি মাথায় হা বুলাতে বুলাতে অমর্ত্য বলল, কচু।
একটু হেসে অমূল্য বলল, আজ্ঞে না। ভালো কাজ করে, একবার ব্যবহার করে দেখুন।
এক মুহূর্ত পর অমর্ত্য দেখতে পেল অমূল্য হাতে একটি ফ্রেমে বাঁধা ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শীর্ণ লিকলিকে দেহটার পাশে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী এক নারী!
অবাক বিস্ময়ে অমর্ত্য হা করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হাজারো প্রশ্ন বান ভেঙেছে।
নীরবতা ভেঙে অমূল্য বলল, আমার বেগম। কতই না সুখে আছি! সব ওই উনার দয়া।
এবার অমর্ত্য আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, শালা ভাঁওতাবাজির আর জায়গা পাস না?
তবে অমূল্যের চেহারায় চওড়া হাসি লেগে রইল। অমর্ত্য আরও কয়েকটি কথা শুনিয়ে দিতে লাগল, আপনেরা হইলেন দেশের শত্রু। আপনেগো মতো লোকেরা দেশকে ডুবাইচ্ছে।
অমূল্য তাতে দমে যাবার পাত্র নয়। সে দরাজ কণ্ঠে বলতে লাগল, বিবাহিত জীবনে আপনার কাঙ্ক্ষিত সুখের নাগাল…..
মাঝখান থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে অমর্ত্য বলল, দাদা সরে পড়ুন। আমাগোরে শান্তিতে থাইকবার দেন। আর কথা বাড়ালে ভালো হবে না বলে দিলুম।
শত হলেও অমূল্যও রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। প্রতিবাদ স্বরে সে বলল, তা আপনিই কি এই গ্রামের মালিক?
যথোপযুক্ত হলেও উত্তরটি অমর্ত্যের গায়ে লাগল। সে বেকার তা সত্য, টাকাকড়ি নেই তা সত্যি, গায়ে যে শক্তি সামর্থ্য আছে তাও সত্য বটে! যদিও সে এই গ্রামের মালিক নয় তবুই এই হতচ্ছাড়াকে গ্রাম থেকে তাড়াতে হবে। এই হারামজাদারাই দেশের যত অপরিণামদর্শী যুবক-যুবতীগুলোকেই ক্ষেপিয়ে তুলেছে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় আবার হারবালের ওষুধ! কাঁধে থাকা গামছাটি কোমরে পেঁচিয়ে অমর্ত্য বলল, বেরিয়ে যান কইছি গাঁয়ের থে।
কিন্তু অমূল্য দমে যাবার পাত্র নয়। সে রাগতস্বরে বলল, গ্রাম থেকে বের করে দেবার আপনি কে?
আর কোনো কথা না বলেই অমর্ত্য গায়ের সব শক্তি দিয়ে অমূল্যকে ধাক্কা মারল। তার এমন ব্যবহারে অমূল্য বেশ অবাক হলো। তবে এখনও ঢের বাকি আছে!
ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে অমূল্য মাটিতে পড়ে গেল। তখনই তার পকেট থেকে একটি চিরকুট বেরিয়ে এলো।

ভাঙা ভাঙা অক্ষরে চিরকুটে লেখা, ‘ফেরার সময় হর্স পাওয়ার না আনলে খবর আছে।’
স্তম্ভিত অমর্ত্য তার দিকে তাকিয়ে আছে। অমূল্য ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল, দাদা বড্ড ভুলোমন আমার। বিবি তাই মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এমন ফন্দি করেছে বোধহয়। কিছু নিবেন?
এবার তার গলাটা খানিক ধরে এসেছে। দরদ গলায় বলতে লাগল, কেন গায়ে হাত তুলছেন? গরীব মানুষ, এই করে কোনোরকম সংসার চালাই।
নির্বাক অমর্ত্য কী করবে বুঝতে পারল না।
খানিক ভেবে বলল, আচ্ছা দেন এক বোতল পাইল!

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments