একজন সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষেরই রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। কারণ যদি প্রতিটি জনগণ তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের সমসাময়িক কর্মপন্থা বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন তবেই সেই দেশের সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক চর্চা করতে বাধ্য। পলিসির রাজনীতির চর্চাও তখনই শুরু হয় যখন সেই দেশের জনগণ ব্যক্তি বা দলের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর পলিসি বা কর্মপন্থার/নীতি উপর নজরদারি করেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক ধারা আদৌ কোনোদিন শুরু হবে কিনা আমার জানা নাই। এখানে দল ও দলের সমর্থকরা নীতি-নির্ধারণীর দিকে নূন্যতম নজর না দিয়ে ব্যস্ত ব্যক্তি তোষণে ও ব্যক্তি আক্রমণে।
বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশের জনগণ আছেন যারা মূলত দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন আর যত সেক্যুলার ও প্রগতিশীল সমাজেই বাস করুক না কেন তারা মূলত কাল্পনিক ফ্যান্টাসিল্যান্ডে বাস করেন। তারা যে দেশে বা সমাজে থাকে, খায়, সুবিধা নেয় সে সমাজ ও দেশ নিয়ে নূন্যতম মাথা-ব্যাথা নাই, আবার বাংলাদেশ নিয়েও তাদের কোনো আশা বা গর্ব নেই। এঁরা আপাত দৃষ্টে খুবই রাজনীতি সচেতন জনগণ, তবে সেটা শুধুই দেশকে ছোট ও অপমান করার ক্ষেত্রে। আর যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে আওয়ামীলীগ তবে তো আর কথাই নেই। দেশের কোনো খারাপ ঘটনা, দেশ বা সরকারকে নিয়ে কোনো খারাপ সংবাদ তারা ‘সিক্স-জি‘-এর গতিতে ছড়িয়ে দেয়। এই ক্ষেত্রে ওই সংবাদটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য , সংবাদের বিপরীতে তথ্য প্রমান আছে কি নেই, বা কোন ব্যাক্তি কি উদ্দেশে এই সংবাদ ছড়াচ্ছে তার বাছ-বিচারের কোনোই প্রয়োজন পরে না। আবার এই একই গোষ্ঠী দেশের কোনো সম্মানের খবর অর্জনের খবর যদি তথ্য, প্রমান ও উপাত্ত সহ আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠান থেকেও করা হয় উনারা এসে বলবেন, “এই সংবাদের আরো নির্ভরযোগ্য কোনো ভিত্তি আছে?” বিষয়টা হলো, ভালো সংবাদে এরা খুবই সচেতন হয়ে উঠেন নির্ভরযোগ্য তথ্য ও ভিত্তির খোঁজে কিন্তু মিথ্যা , সত্য-মিথ্যার মিশ্রনে বানোয়াট কিছুতে সেই সচেতনতাবোধটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
আবার আসি রাজনৈতিক সচেতনতা বোধ নিয়ে! আর এই সচেতনতা বোধটা প্রবাসী বাংলাদেশীরের প্রেক্ষাপটে, বা আরো পরিষ্কারভাবে অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশীরের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে। বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের একটি বিশাল অংশ খুবই রাজনীতি সচেতন, এদের সামাজিক মাধমের সকল প্রকাশ, সকল আবেগ এই রাজনীতি সচেতনতা কেন্দ্রিক; যা মূলত বাংলাদেশের সরকারের আরো নিদৃষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনায় মুখর। আমি এতে খুব দোষের কিছু দেখি না, কারণ কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় বা সরকারের নীতিমালা শতভাগ জনবান্ধবও নয়। এটা যেকোনো দেশের প্রেক্ষাপটেই অসম্ভব, কারণ একটি সরকার কোনোদিনই সেই দেশের শতভাগ মানুষের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসে না। তাই, আমি এই সমালোচনাকে পজেটিভ ও দরকারি মনে করি। কিন্তু আমার মূল সমস্যা অন্যখানে আর তা হলো, এই বাংলাদেশের সমালোচনায় মুখর খুব কম জন‘ই স্থানীয় রাজনীতি বা নীতিনির্থারণ বা বৈষম্য নিয়ে সজাগ। আমি গত কিছুদিন আমার লিস্টের‘ই কিছু ব্যাক্তির সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট দেখে খুবই কৌতুহলী হলাম! ভাবলাব সবাই এতো রাজনীতি সচেতন চিন্তা করেই আহ্লাদিত হামলা। এখনের স্থানীয় রাজনীতিতে আমি অল্প-বিস্তর জড়িত, কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্মে বা মিটিংয়ে বা আলোচনায় আমি তাই আমার স্বজাতিদের দেখার জন্য মুখিয়ে থাকি। তাই ভাবলাম এখানে বসে উনারা বাংলাদেশের সরকারের বা রাষ্ট্রপ্রধানের নিপাত করছেন যেহেতু নিশ্চয় বর্তমান বাসভূমির অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি নিয়েও এতটাই সচেতন। কিন্তু দেখলাম উনাদের সমালোচনার ১০০% বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ট্রল, আর বাইরে আর কিছু নাই।
এবার আসি কেন এটা, এই এক পাক্ষিক রাজনীতি সচেতনতা বোধ মূলত একটি সমস্যা বা প্রবলেমেটিক! একটা বিষয় মনে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি যে, যে দেশে আপনি এখন আছেন (এই লেখার প্রেক্ষাপটে, অস্ট্রেলিয়া) সেই দেশের রাজনীতি, কৌশল, নিয়ম-কানুন, কর্মপন্থা ও বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ মূলত আপনাকে ও আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে সরাসরি প্রভাবিত করবে, আপনার ও আপনার সন্তানের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করবে। সেই বিষয়ে সচেতন না হয়ে যখন শুধুমাত্র বাংলাদেশের সমালোচনায় মশগুল থাকেন তখন বিষয়টা হাস্যকর ও উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। এখানে আপনার সচেতন ব্যাক্তিত্বের আগে সমানে আসে আপনার ব্যাক্তি আক্রমণের চেহারা, যার সঙ্গে আর যাই হোক, দেশপ্রেম বা রাজনৈতিক সচেতনার কোনোই সম্পর্ক নেই।
আপনি/আপনারা অস্ট্রেলিয়র পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরছেন, সপ্তাহ বা মাস শেষে বেতনের প্রতি পয়সার ট্যাক্স দিচ্ছেন, আপনার সন্তান এই সমাজের ভবিষৎ হিসেবে বেড়ে উঠছে! কিন্তু আপনি কি কখনো প্রশ্ন করেছেন আপনার সরকারকে কোনো অনিয়মের বিষয়ে? মুখর হয়েছিলেন যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গোপনে নিজ মন্ত্রণালয়ের বাইরেও আরো পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজ কব্জায় নিয়ে নিয়েছিল কাউকে না জানিয়ে, এমন কি নিজ দলের এবং সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও না জানিয়ে? কিম্বা সমালোচনা করেছিলেন যখন বছরের পর বছর শ্রীলঙ্কান রিফুজি পরিবারটিকে অমানবিকভাবে ডিটেনশন সেন্টারে রেখেছে দুটি অবুঝ শিশুসহ? কখনো প্রশ্ন করেছেন নিজেকে, মাল্টিকালচারাল দেশ অস্ট্রেলিয়া কিন্তু আপনার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আসলে কে, সে কি আপনার প্রতিনিধি? বা কেন ভিক্টোরিয়ার পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণের চেয়ে পিছিয়ে? কেন সকল ভালো পাবলিক স্কুলগুলি সব ভিক্টোরিয়ার পূর্বে আর দক্ষিণে? বা কেন এমন দুর্মূল্যের বাজারে সরকার বিগত সরকারের লেভেল-ত্রি ট্যাক্স কাট‘কে বাস্তবায়নের কথা বলছে? এই অস্ট্রেলিয়াতেও কেন হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে রাস্তায় খোলা আকাশে ঘুমায়? ভেবেছেন কখনো? ভাবুন, ভাবার প্র্যাক্টিস করুন !
আজ থেকে ত্রিশ/পঁচিশ বছর আগেও কি কেউ চিন্তা করেছে পেয়ারার জুস হবে আর তা বোতলে বা ক্যানে করে বিক্রি হবে, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে? কিন্তু পান করছেন তো এখন পেয়ারার জুস! বাজারে প্ল্যান্ট-বেসড-মিট পাওয়া যায় এখন, যা আপনাকে মাংসের স্বাদ দিবে কিন্তু মাংস নয়, বহু রেস্টুরেন্টে বার্গারে মাংসের পেটির পরিবর্তে মাশরুম ব্যবহার করে, ভেজিটেরিয়ান অপশন হিসেবে। আর আপনারা খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ট্রল করতে ব্যাস্ত। কাঁঠালের বার্গার বলে উনি মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছেন, কিন্তু এটা ভেবে দেখেন নি যে, এটা একটা সম্ভাবনাও হতে পারে। কারণ আপনাদের চিন্তা ও চেতনায় শুধুই একটা ধারণা বিরাজ করে আর আপনাদের মগজকেও প্রি-অকুপাইড করে রেখেছে আর তা হলো শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের বদনাম, সেখানে এই দুনিয়ার আর কোনো আলোক-রশ্মি প্রবেশের কোনো পথই নেই।
তাই সবশেষে আবারো বলি, ভাবুন, ভাবার অভ্যাস করুন।অস্ট্রেলিয়া বাক স্বাধীনতার দেশ, এখানে নিশ্চই মুক্ত চিন্তাতে আপনাদের ভয় নেই। দিনের মধ্যে যতবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাসিস্ট বলে গাল দিচ্ছেন তার অর্ধেকটা সময় অন্তত এই বাসভূমির রাজনীতি, পলিসি ও বৈষম্য চিন্তা করুন। শেখ হাসিনার নিপাত করে আপনার সন্তানের জন্য বৈষম্যহীন সমাজ আপনি অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।
মিতা চৌধুরী : চিত্রশিল্পী, লেখক, সংগঠক; মেলবোর্ন প্রধান, প্রশান্তিকা ।