১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবির প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আজ থাকছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ ফিচার। ফিচারটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন তাঁর বড় ছেলে রওশন আলম মনি এবং তাঁর স্মৃতি কথা লিখেছেন ভাতিজী নাজমুন নাহার লিপি।
মোঃ আশরাফুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা
নাজমুন নাহার লিপি: ১৯৭১ সনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। সেই আন্দোলন গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। আমার মেজো কাকা আশরাফুল ইসলাম দুদু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। চারিদিকে আনন্দ মিছিল। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তান জেল থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু তখনও আমার কাকা ফিরে এলেন না। এলাকাবাসী, আত্নীয় স্বজন এমনকি তাঁর সহযোদ্ধারা যারা ফিরে এসেছেন, কেউ জানেনা কাকা কোথায়। দীর্ঘ তিন মাস পর কাকা বাড়ি ফিরেছিলেন। এই তিন মাস একজন মা এবং বাড়ির সবার কিভাবে দিন কেটেছে এই গল্প আমার দাদিমার কাছে শুনেছি।সেই কাহিনী শুনে চোখের পানি ধরে রাখার সাধ্য কার!
সেসময় ঘুমের ঘোরেও কেঁদে উঠতেন আমার দাদীমা, ছেলেকে ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য পরনের শাড়ীর আঁচল ভিজিয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ছেলে ভিক্ষে চাইতেন,দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটে যেতেন রাস্তায় আহারে মায়ের আকুতি! তিন মাস পরে কাকা ফিরে এলেন স্বাধীন দেশে বাংলাদেশে নিজের দেশে।
কোথায় ছিলেন এই তিন মাস? সেই গল্প শুনেছি আমাদের যুদ্ধ ফেরত কাকার কাছে! তিনি বললেন, যুদ্ধের শেষের দিকে বুলেটের আঘাতে কাকার বুকের বামপাশে আঘাত লাগে। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন এক বাড়ির মানুষেরা কাকাকে সেবা দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। কাকা যতদিন বেঁচে ছিলেন মাঝে মাঝেই বুকের ব্যথা জাগত, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো।আমরা দৌঁড়ে পানি এনে দিতাম, বুক মালিস করে দিতাম। মানুষকে খুব ভালবাসতেন কাকা। কারও কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। নিজের না থাকলেও সব সময় পরের উপকার করতে চাইতেন। আমরা কাকার জন্য গর্ব বোধ করি। স্বাধীন দেশে লাল সবুজের পতাকা উড়তে দেখলেই মনে হয় এই সুন্দর দেশটা, দেশের পতাকাটার জন্য আমার কাকাও যুদ্ধ করেছেন।

জন্মঃ ৩১ মার্চ ১৯৫২, বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের ঘোড়াগাছা গ্রামে। বাবার নাম জলিল বক্স সরকার (গ্রাম সরকার প্রধান), মা আমিনা বেগম।
প্রশিক্ষণ: শৈশব থেকেই দুরন্ত আশরাফুল ইসলামকে সবাই দুদু নামে ডাকতো। ১৯৭১ সালে কলেজপড়ুয়া আশরাফুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তাঁর বড়ভাই আওয়ামীলীগ নেতা পরবর্তীতে কাজিপুর আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস সরকারের সহায়তায় ১৫/১৬ জন সহযোদ্ধাসহ নৌপথে কাজীপুর থেকে আসামের ধুবরি হয়ে দার্জিলিংয়ের পানিঘাটা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান। দুই মাসের স্বল্প প্রশিক্ষণ শেষে তাকে ৭ নং সেক্টরে নিয়োগ দেয়া হয়।

যুদ্ধ: তিনি বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে অংশ নেন। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন ভারতীয় এস এল আর। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ কমান্ডার সদরুদ্দিন (স্কোয়াড্রন লিডার) তাঁকে মুক্তিবাহিনি থেকে অব্যাহতি দেন।
পেশা: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সহধর্মিনী রওশন আরা বেগমও শিক্ষকতা করতেন। আশরাফুল ইসলাম নিজ এলাকায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদান রাখেন।

মৃত্যু: ২০০৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও কাজিপুর থানা পুলিশ বাহিনী তাঁকে সেদিন গার্ড অব অনার প্রদান করে। তিনি স্ত্রী, মেয়ে, ছেলে, নাতি নাতনী ও অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
জীবদ্দশায় তিনি চাইতেন বাংলাদেশ আধুনিক, সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রে পরিনত হোক। প্রায়ই তিনি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে (পানিঘাটা, দার্জিলিং) প্রশিক্ষণকালীন এবং সম্মুখ যুদ্ধে নিহত সহযোদ্ধাদের।
alhamdulillah… amrao nijer jonno kisuta vaggoban mne kori amn ak jon person amder bongsher…..