গল্প
কালো চশমা
ইসহাক হাফিজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। সামনের জোড়া গাছটার নিচে বসে চা খাচ্ছি। এখানে পড়ার অনেক শখ ছিল। পারিনি। তাতে কী। আজ আমার অনেকেই এখানে পড়ে। ওদের দুহাত ভরে টাকা দিই। পড়াশোনায় উদাসীনতা টের পেলেই ইচ্ছেমতো বকাবকি করি। মনে মনেভাবি, কোনো ব্যর্থতার কষ্ট বুকে জমা করে রাখতে নেই। বরং তার চেয়েও বড় কোনো সফলতা দিয়ে ওই কষ্টটা ঢেকে দিতে হয়। কারণ, জীবন আসলেই সুন্দর। আমাকে ঘিরে বসে আছে নাজিব, সেতু, মিম, সামু, মাহিসহ অনেকে। নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধির আনন্দে কিছুক্ষণপরপর শিহরিত হয়ে উঠছে আমার চোখ দুটো। অফুরন্ত আড্ডায় গল্প চলছেই। হঠাৎ করে একুশ–বাইশ বছর বয়সের একটি ছেলে এসে রীতিমতো কদমবুচি করে বসে। অতি বিনয়ের সাথে বলে,
মামা, কেমন আছেন? অনেক বছর পর আপনাকে দেখছি।
হ্যাঁ ভালো। কিন্তু তোমাকে তো…
আমাকে চিনতে পারছেন না! আমি রিফাত। বাবাকে দাফন করার সময় আপনি একটা কথা বলেছিলেন। ওই কথা অন্তরে গেঁথে রেখেছি। বুঝতে চেষ্টা করছি। আজো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।
তুমি…
জি মামা, আমার বাবার নাম আয়নাল।
ও আচ্ছা। চিনতে পেরেছি। তোমার আব্বু বাউল গান করতেন।
জি মামা।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
প্রায় এক যুগ আগের কথা। সেদিন বাড়ি যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে নেমেই এলাকার পরিবেশটা কেমন ভারি ভারি লাগছিল। লোকজনের মাঝে কেমন এক রহস্যময় উত্তেজনা। কেউ কোনো কথা বলছে না। অতি পরিচিত মুখগুলোও কেমন যেন হালকা দু–একটা কথা শেষে সরেপড়ছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি, মা জামগাছটার নিচে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে।
মা, তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে!
মা কোনো কথা বলে না। প্রায় দুই মাস পর বাড়িতে এসেছি। অথচ মা কেমন নির্বিকার।
মা, আমি এসেছি। কী হয়েছে, মা?
বাবা রে, এমন কাণ্ড জীবনে দেখিনি। আয়নাল ফকিরের জানাজায় বিরাট মারামারি লাগছে।
কী, জানাজায় মারামারি!
ফকিরের ভক্তরা জানাজা করতে এসেছে। ওদিকে উগ্র কয়েকজন এসে সবাইকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। দৌড়ে গিয়ে দেখি, কয়েকজন গোরস্থানে কবর খুঁড়ছিল। তাদেরও তাড়িয়ে দেয়া হয়।
ফকিরের একটা জমি ছিল। উপায়ান্ত না দেখে ফকিরের বউ তাদের প্রতি হাতজোড় অনুরোধ করলে ওই জমিরই এক প্রান্তে একটা গর্ত খোঁড়া শুরু হয়। গিয়ে দেখি, লাশ নিয়ে অপেক্ষমাণ কয়েকজন। পাশেই দ্রুত গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। ভক্তরা এমনকি ফকিরের স্বজনদের কাউকেসেখানে আর দেখা যায় নি।
এ ধরনের অপমানজনক শেষকৃত্য জীবনে দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি। গায়ের কাপড়, শরীরে জড়ানো চাদর, হাতের ঘড়ি— সব তেমনই আছে। মাটি খুঁড়ে কবরের আকৃতিও করা হয়নি। চাটাই–বাঁশ কিছুই নেই। খাটিয়া থেকে লাশটা গর্তে ফেলে ঝপাঝপ মাটিচাপা দেয়া হয়।
আয়নালের বউ অদূরে একটা কড়ুইগাছের নিচে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। ছোট্ট মেয়েটা জড়িয়ে ধরে আছে মাকে। ওই দৃশ্য আজ আর বর্ণনা করা যাবে না। রিফাত তখন আট–নয় বছরের হবে হয়তো। অশ্রুভেজা অসহায় চোখে এদিক–ওদিক তাকিয়ে এক দৌড়ে কাছে এসেআমার একটা হাত ধরে সে বলে—
মামা, মামা, আমার আব্বুর ওপর সবাই পা দিয়ে মাটি চাপছে। আমার আব্বু কষ্ট পাচ্ছে, মামা। ও মামা, তুমি ওদের মানা করো। কিছু বলো।
মামা রে, ওরা কারো কথা শুনবে না।
আজ সেই ছেলেটি অনেক বড় হয়েছে। কষ্টের স্মৃতি কেবল কষ্টই বাড়ায়। তাই ওই দিনের কথা আজ আর স্মরণ করতে চাই না। তবে পড়ালেখার প্রতি ছেলেটার আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগছে। সবার সাথে রিফাতকে পরিচয় করিয়ে দিতেই দেখি রিফাতের সাথে তাদের বেশ ভালোজানাশোনা। নাজিব বলে—
কাকা, রিফাত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। অ্যানথ্রোপোলজিতে পড়ে। ওর সাথে আড্ডায় কীভাবে যে সময় যায় টেরই পাই না।
ও আচ্ছা, বেশ।
রিফাতের চোখেমুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। কী করবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না যেন।
মামা, কী খাবেন?
আহা, কী আর খাব। বসো মামা। তোমাকে দেখি। তোমার আম্মু, ছোট বোনটা। সবাই ভালো তো?
জি মামা, ভালো। মগবাজারে আমাদের একটা দোকান আছে। মা দেখাশোনা করে আর ছোট বোন রেবা মতিঝিল আইডিয়ালে পড়ে। মামা, আপনার ওই কথাটা…
মামা, কী যেন বলেছিলাম, ভুলে গেছি যে।
রিফাত বলে—
কাল্পনিক বাস্তবতার কাছে হেরে গেছে বস্তুগত বাস্তবতা। শুধুই জ্ঞানের অভাব। মানুষের বানানো গল্পে অন্ধ হয়ে গেছে মানুষ। জীবন থাকতে মরা। দর্শন–দারিদ্র্যে সর্বশান্ত ওরা ধর্মের নামে চোখে লাগিয়েছে অধর্মের কালো চশমা।
তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, মামা, খুব ভালো করে লেখাপড়া কোরো। এসব থেকে নিজেকে বের করে আনতে হবে। নইলে জীবনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ধন্যবাদ তোমাকে এমন সুন্দর করে মনে রেখেছ। খুব ভালো।
মামা…
হ্যাঁ, বলো।
জীবনের প্রকৃত রূপ কীভাবে দেখব?
হ্যাঁ মামা, বলছি শোনো…
ঠিক তখনই হঠাৎ করে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়। আমরা সবাই ছুটোছুটি করে ক্যানটিনে ঢুকে পড়ি।