ছেলেবেলায় আমরা মা বোনদের রান্না করতে দেখে বুঝতাম এ কাজ নারীর। বাঙালি সমাজে এখনো এই ধারণা বদ্ধপরিকর। ঘরে সংসারে অলস পুরুষ জানে যা কিছু রান্না যা কিছু ভোজন আহার তা বানাবে ঘরের নারী। আর তিনি খাবেন পায়ের ওপর পা তুলে। অথচ এই পুরুষ মানুষটি যখন বন্ধু বান্ধব বা পরিবার পরিজন নিয়ে কোন সস্তা কিংবা দামী হোটেল রেঁস্তরায় খেতে যান তখন কিন্তু চোখের সামনেই দেখেন খাবার পরিবেশন করছে পুরুষ আর শেফ নামে পরিচিত সাদা গাউনের বাবুর্চিগুলো সবাই পুরুষ।
দেশে আরো একটা বিষয় দেখে বড় হয়েছি। বড় বড় দাওয়াত নিমন্ত্রনে রান্নাঘরের সামাল দিচ্ছেন নারীকর্মীরা। কেউ বাটনা বাটছে। কেউ মশলা পিষছে। কেউ তরকারী কাটছে। সবকিছু গুছিয়ে রান্নাযোগ্য করে তোলার পর বড় ভুঁড়ি নাড়িবে মহান পুরুষ বাবুর্চি এসে হাজির। গম্ভীর চেহারায় চুলাগুলোর সামনে গিয়ে হাঁড়িতে কড়াইতে টগবগ করে ফুটতে থাকা তরকারী মাছ মাংসের ওপর গোলাপ পানি আতর মশলার গুঁড়ো ইত্যাদি ছিটিয়ে গম্ভীর কন্ঠে হুকুম দেন এতটার ভিতর নামিয়ে ঢাকনা খুলে রেখো। অত:পর রাতে আগত অতিথি মেহমানেরা জানলেন অমুক জামাল বাবুর্চি কিংবা মোহন বাবুর্চি র রান্না খেয়ে আজ তারা ধন্য।

যতদূর মনে পড়ে রান্না বিষয়ক শো প্রথম দেখি জি টিভিতে। সনজীব কাপুর নামের এক ভদ্রলোক এই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পরে এই খানা খাজনা নামে আমার পুত্র একটি শর্ট ফিল্ম বানিয়ে পুরষ্কারও জিতে নিয়েছে সিডনিতে।
ধান ভানতে শীবের গীত থাক। আমাদের দেশের রান্নার শো এখন অপরিহার্য টিভি অনুষ্ঠান। প্রত্যেক চ্যানেলে এই শো হয়। কেউ বিরক্ত করেন আর কেউ করেন মনযোগী। সিদ্দিকা কবীরের পর আর কাউকে তেমন মনে ধরেনি আমার। তবে রান্নার শো করা সেলিব্রেটিদের চাপ যে কি তা আমি খুব ভালো জানি। সুদীপার রান্নাঘরে যাবার জন্য আমি মিস করেছি নবনীতা দেবসেনের সঙ্গ। এই আফসোসের পর ও রান্নার বিষয়ে লেখার কারণ এক বাঙালি নারী। যে এখনো তারুন্যে। কিন্তু ইতোমধ্যে অর্জন করে নিয়েছে সেলিব্রেটির সম্মান ।
না পরিমিত বা আনন্দ ও কলহমুখর বাঙালি সমাজে না। সরাসরি অষ্ট্রেলিয়ার মূলধারায়। ফ্রান্ক রডাম নামের এক ভদ্রলোক রান্নার শো চালু করেন ১৯৯০ সালে। ২০০৫ সালে বিবিসি এর আধুনিকায়ন করে। যার নেপথ্যে ছিলেন রডাম জন সিলভার আর কারেন রস। সে থেকে তুমুল জনপ্রিয় এই শো ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। বলাবাহুল্য ইংরেজদের হাতে গড়া তাদের আদলের দেশ অষ্ট্রেলিয়া তা লুফে নিতে দেরী করে নি। এখন এটি এখানকার চ্যানেল টেনের এক অন্যতম জনপ্রিয় শো।

এই শোতে এতোদিন আমাদের জনগোষ্ঠী ছিলো দর্শক। কিন্তু কিশোয়ার চৌধুরী নামের ছিপছিপে এক তরুণী প্রশান্তপাড়ের বাংলাদেশিদের তো বটেই সাথে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে পুরো দুনিয়ার বাঙালির। এমন কি আজ সাদা কালো পিঙ্গল সব বর্ণ আর চামড়ার মানুষের চোখে কিশোয়ার জনপ্রিয় এক রন্ধনশিল্পী।
রন্ধনশিল্পী আর রাঁধুনীর ভেতর আমি যে তফাৎ দেখি তা খুব সোজাসাপটা- বড় মোচা মাছের ঝোল মাংস সব বাঙালি রাঁধতে জানেন। পরিবেশন এবং ফিউশানের নামে জগাখিচুড়ি পাকানো ব্যতিরেকে নিপাট বাংলাদেশী খাবার পরিবেশন রান্না আর চ্যালেন্জ মোকাবেলায় কিশোয়ার অনন্য আর অনবদ্য। আমি বিষয়টাকে যে ভাবে দেখি, এতোদিন আমাদের রেঁস্তরা কিউজিনগুলো বাঙালি বাদে খাদ্যরসিক টানতে পারেনি। এসব উন্নত নিরাপদ খাদ্যের সমাজে ভাবমূর্তি বিশাল ব্যাপার। ইন্দোচাইনীজ নামের দোকানগুলো চাইনীজ নামটাবলছে শুধু মাত্র বিশ্বাসভাজন হবার জন্য। ভিয়েতনামী দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে হয় থাই নয় চাইনীজ রেঁস্তরা লেখার কারণও তাই। সিডনির বাংলাদেশী রেঁস্তরাগুলো ইন্ডিয়ান কিউজিন লেখার কারন দুটো প্রথমত এমনটা লিখলে উপমহাদেশের সবাই আসবেন। দ্বিতীয়ত আমাদের খাবারের ষ্টাইল এখনো অপরিচিত আর রান্নার উৎকর্ষ প্রশ্নের বাইরে না।
সেখানে অজি বিচারকদের তাক লাগিয়ে দিয়ে মাছের ঝোল থেকে মিষ্টি পান নেহেরী খাইয়েই সে পৌঁছে গিয়েছে ফাইন্যালে। বৃটিশ জাজ জেক বলেন, কিশোয়ারের শক্তি তার রান্নার স্বাদ আর বাহারী পদ। কিশোয়ারই জানিয়ে দিলেন আমাদের রান্না আর ঐতিহ্য কতোটা শক্তিশালী।
বলি কি, দেশের রাজনীতি দেশের সমাজনীতি বা বিভিন্ন বিষয় আমরা সবাই চর্চা করি বটে কিন্তু তাতে শুধু আমরা আমরাই। এর বাইরে মূলধারায় পা রাখতে হলে দেশের মান সম্মান এমনকি বাঙালি জাতির মর্যাদা তুলে ধরতে হলে মূলধারায় নতুন কিছু করার বিকল্প নাই। করছেন অনেকেই । কেউ নাটকে কেঊ চলচ্চিত্রে কেউ মূলধারার রাজনীতিতে কাজ করছেন। কিন্তু মেলবোর্ণের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম চৌধুরী ও তাঁর পত্নী লায়লা বেগমের কন্যা। মোনাশ থেকে স্নাতক শেষ করে লন্ডনে গ্রাফিক ডিজাইনে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট করা কিশোয়ার আজ প্রতিষ্ঠিত রন্ধনশিল্পী।
ফাইন্যালে কি হবে জানি না। কিশোয়ার চৌধুরী জিতুক আর না জিতুক ইতোমধ্যে সে জিতিয়ে দিয়েছে আমাদের। রান্না করেও যে একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা যায় একটি জাতির ভাবমূর্তি আকাশচুম্বী করে তোলা যায় সেটা তাকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব ছিলো ।
শুভকামনা। গুডলাক কিশোয়ার, প্রবাসে বাংলার মুখ।
অজয় দাশগুপ্ত
ছড়াকার, কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।