কয়েক বছর আগের কথা। আমার অফিসের ডাইনিং রুমটা ছিল ১৪ তলার উপরে। বিশাল জানালা দিয়ে তাকালে সিডনী হারবার ব্রিজ আর অপেরা হাউস। উইকেন্ডে বাসায় গরুর মাংস আর পোলাও রান্না হয়েছিলো। বক্সে করে তাই তুলে রেখেছিলাম পরদিনের লাঞ্চ হিসেবে। ওটা গরম করে নিয়ে জানালার পাশে বসে ফোন গুঁতাচ্ছি খাবার একটু ঠান্ডা হবার ফাঁকে, হঠাৎ দেখি অন্য সবদিকে খালি টেবিল রেখে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসার অনুমতি চাইলো এক কলিগ। পিওর সাদা চামড়া, ইয়া লম্বা একজন চমৎকার সুপুরুষ, নাম জেমস।
আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম বোস।
জেমস ভূমিকা ছাড়াই বলে বসলো, তোমার খাবারের গন্ধ অসম্ভব সুন্দর! কোন্ দেশী কুজিন?
আমি হেসে বললাম বাংলাদেশী রান্না, প্লেট আর চামচ নিয়ে এসো, টেস্ট করো। বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে জেমস ওই খাবার খেয়েছিলো। এরপরে প্রায়শই আমাকে ঘ্যান ঘ্যান করে বলার চেষ্টা করেছিল রেসিপি দিতে। আমি নিজে রান্না করি ফ্রেশ আদা রসুন ব্লেন্ড করে নিয়ে। গরম মসলা গুলোও নিজের মতো গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নেই এবং কয়েক ধাপে ছিটাই। এইটুকু বলার পরে জেমস এর মুখ চুপসে গেলো। আমাকে বললো, তুমি কি আমাকে গ্রেভিটা বানিয়ে দিবা? আসলে কিন্তু ফারিনা তুমি গ্রেভিটা কমার্শিয়ালি বিক্রি করতে পারো! শুনে আমার মাথায় বাজ!

উরুগুয়ের মেয়ে লরা আমার মুরগির মাংস রান্না আমার বাসায় এসে ভিডিও করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমার প্রতিবেশী এলান আর হেলেন দম্পতি ভীষণ মজা করে আমার বাড়ির টক ঝাল মিষ্টি সব খায়। কি ভাবছেন? নিজের ঢোল আজ পিটিয়ে ফাটিয়ে ফেলবো? না পাঠক, কেবলমাত্র এইটুকু বোঝানোর জন্যই ভূমিকাটা লিখলাম যে আমার মতো এলেবেলে মানুষের আটপৌরে রান্নায় যদি নানা দেশ জাতির মানুষের জিহবা আর মন একদম গলে যায়, তাহলে বুঝেন আমাদের খাবার আসলে কতটা মজা হয় !
বাংলাদেশী অনেক শেফ নাম করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। ব্রিটেনে টমি মিয়া অথবা বেক অফ এর নাদিয়াকে মানুষ চেনে ঠিকই, তবে ঠিক বাংলাদেশী কুজিনের শেফ হিসেবে না। সীমিত কিছু বাংলাদেশী খাবার তারা রান্না করলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিউশন।
বিশ্বের লাখো বাঙালীর এই আফসোসের একটা বিহিত করতেই যেন ধনুক ভাঙা পণ নিয়ে এবার অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় দাপিয়ে ও কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন মেলবোর্নে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী! খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা, ফুচকা, রেজালা পরোটা, ভাঁপা মাছ, রাঙামাটির কোরাল মাছ, কালাভূনা, আলু মাছের ঝোল.. প্রতিটা খাঁটি বাংলাদেশী খাবার দিয়ে মন জয় করেছেন বাঘা তিন বিচারকের আর হাজার হাজার দর্শকের। প্রশংসায় ভেসেছেন, আনন্দে কেঁদেছেন কিশোয়ার। টেলিভিশনের সামনে বসে উল্লাসে ফেটে পড়েছি আমরা!
কিশোয়ার আসলে সম্ভাবনার সেই দরজাটা হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়েছেন, যে দরজার হারিয়ে যাওয়া চাবিটা খোঁজার তাগিদও হয়তো খুব একটা ছিলো না আমাদের কারো! আটপৌরে বাংলাদেশি খাবার, আমাদের মা খালার হাতের চিরন্তন রান্না যে আসলে কোন পর্যায়ের মুন্সিয়ানার ধারক ও বাহক, তা হয়তো আমরা নিজেরাও বুঝিনি!
মাস্টারশেফ যারা দেখেন তারা জানেন কি পরিমান চ্যালেঞ্জিং একটা প্ল্যাটফর্ম এটা। পদে পদে নিত্য নতুন কৌশলে এলিমিনেশনের চোখ রাঙানো! এখনো পর্যন্ত টিকে আছেন কিশোয়ার, বিদেশে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা কিশোয়ার! বাংলাদেশে জন্মানো কত শতাংশ এই প্রজন্মের মেয়ে এতো গুলো পদ রান্না করতে পারে, তা নিয়েই আমার ঘোর সন্দেহ আছে! কিশোয়ার প্রমান করেছেন, শেকড়কে আঁকড়ে ধরলে, ভালোবাসলে কেউ ঠকে না, জিতে যায় খুব দাপটের সাথে। তবে হ্যাঁ, রণকৌশল জানাটা খুব জরুরী, জরুরী নিজেকে প্রস্তুত করা।
কিশোয়ার, আপনার হাত ধরেই সীমানা পেরিয়ে অসীম সম্ভাবনায় জ্বলে উঠুক আমাদের নিত্য জ্বলন্ত উনুনের সৃষ্টিগুলো! বিশ্বের দরবারে অসামান্য শিল্প হয়ে উঠুক আমাদের রসনাবিলাসের গল্পগাঁথা, আপনার হাত ধরেই।
ফারিনা মাহমুদ
প্রদায়ক সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।