কী ভীষণ এই অসহায়ত্ব । নাদেরা সুলতানা নদী

  
    

আমরা দেখি কিভাবে এমন একটি কালো অধ্যায় রচিত হয়। আমরা যারা সাহসী রোজিনা ইসলামকে চিনতাম, সেই রোজিনার কান্না চাপা মুখ দেখি বিস্ময়ে। কারাগারের পথে প্রিজন ভ্যানের ছিদ্র দিয়ে তাঁর বিস্ময় ভরা চোখ দেখি। হাতের আঙ্গুলগুলোও চোখ এড়ায় না। কতোটা অপমানিত হলে, হেনস্তা হলে এমন হতে পারে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি।

কী ভীষণ এই অসহায়ত্ব!

অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতা বলে যে একটা শব্দ আছে এবং এই সময়ের বাংলাদেশে যে বা যারা নিষ্ঠার সাথে এই কাজটি করে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের মুলধারার সংবাদপত্র এবং বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত সাংবাদিকদের যারা চেনেন, জানেন বা পড়েন এই নামটি শুনে থাকবেন। তিনি সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক।

এবং নিকট অতীত বা দূর অতীত, রোজিনা ইসলামের কাছের বা দূরের আত্মীয় পরিজনদের যাদের চিনি, সেই সুবাদে এটি অনেকটাই নিশ্চিত যে, চুরি বা ডাকাতির কোন রেকর্ড তার নামের পাশে ছিলোনা ! এবার হলো, সচিবালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে রোজিনা ইসলাম চুরি করে হাতে নাতে ধরা পড়েছেন ! তাই তো বলছেন আপনারা, মান্যবর আমলাবৃন্দ?

অফিসের টেবিলেই রাখা ছিল এমন কিছু এবং ছবি তুলে নাকি তা চুরি করছিলেন। দাবী অনুযায়ী এটা এমনই গর্হিত কাজ যে দেশের ভাবমূর্তি এবং ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্ক রীতিমত হুমকির মাঝে পড়ে গিয়েছিল। তাই সচিবালয়ের কর্মরত অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা রীতিমত জান বাজি রেখে রোজিনার মত একজন দেশবিরোধীকে রুখে দিয়েছেন ! বাহ, এজন্য নিশ্চয়ই তিনি পুরস্কৃত হবেন, রাষ্ট্র তাকে খুব শীঘ্রই পরাবে ‘’হার না মানা হার’’!

আপনারা যারা টুকরো ভিডিও চিত্র এবং স্থির চিত্রে দেখছেন সেই বড় অফিসের বড় কর্মকর্তা কাজী জেবুন্নেসা রোজিনার গলা চেপে ধরার চেষ্টা করছেন। আপনারা ভুল দেখেছেন। ঘটনা উল্টা ঘটেছিলো। রোজিনাই নাকি তার জন্যে হুমকি হয়েছিল, রোজিনাকে কেউ কোন হেনস্তা বা শারীরিক নির্যাতন করেনি।

এইটুকু পড়ে যারা বিভ্রান্ত তাঁদের বলছি, এই সবই, রোজিনাকে হেনস্তার মত কালো অধ্যায় রচিত হবার পর, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মাননীয় (!) মন্ত্রী বলেছেন।
সুতরাং আমাদের এটা বুঝে নেয়া উচিত যে,
রোজিনার উপর এমন চড়াও হয়ে যাওয়া সরকারী সেই কর্মকর্তার কোনরকম অন্যায় নেই।

৫ ঘন্টা আঁটকে রাখার বিষয়টা কী হতে পারে… এই নিয়ে তাই কোন প্রশ্নই করা যাবেনা। প্রশ্নের কোন অবকাশই রাখা হয়নি। নইলে সদ্য টীকা দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তাকে হেনস্তা করা হয়েছে। এক ঘন্টা বা দু’ঘন্টা নয় ৫/৬ ঘন্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। তারপরও তাকে ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু না, মহা শক্তিধর আমলারা হাসপাতালের কথা বলে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। মধ্যরাতের এক নাটকে অসুস্থ এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আসলে ঠিক কী কী হয়েছে তার অসংখ্য টুকরো চিত্র উঠে এসেছে আমাদের সকলের সামনে, নিশ্চয়ই আরো আসবে। আমি বেশ কিছু নিউজ ফলো করে গত প্রায় ৩/৪ ঘন্টায় যতটুকু জানতে পারলাম, রোজিনা ইসলাম, যেভাবে তার পত্রিকার জন্যে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে সচিবালয়ে যেতেন, ঠিক সেভাবেই গতকালও গিয়েছিলেন। এরপর তার পরিবার এবং সহকর্মীদের বরাত দিয়ে যা জানা যায়, রোজিনা কিছু তথ্য এবং প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন তার সংবাদ রিপোর্টিং এ যা যা কাজে লাগতে পারে বা কাজে লাগাবেন।

কিন্তু এর মাঝেই হয়তো নিজের অজান্তেই কিংবা জ্ঞানতই পা দিয়েছিলেন সাপের লেজে…
ফুঁসে এলেন সরকারী কর্মকর্তাদের একজন নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী নারী সহ বেশ কজন। এবং ধারণা করছি বেশ কিছু স্ক্রিপ্ট দ্রুতই রচিত হয়ে যায়। আমাদের সামনে উঠে আসে টুকরো ভিডিও এবং স্থির চিত্র।

আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি,
আইনের হাত লম্বা বলে জানি, সরকারী কর্মকর্তা কারো কারো হাত কী তার চেয়েও লম্বা? যে হাত রোজিনার গলা চেপে ধরে সে হাত আসলে কত লম্বা, কতোটা শক্ত!

স্বাস্থ্যখাতের নানান অনিয়ম, বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির পর একের এক পর বেশ কিছু রিপোর্ট রোজিনা করেছেন আমরা জানি। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা হয়তো হাজারো অনিয়মের টুকরো কিছু চিত্র পেতাম বা পেতামনা…
কিন্তু দুর্নীতি বা অনিয়মের কিছু যদি বের হয়ে আসে বা আসতো সেটা কার হতো ক্ষতি, কোন সে প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান না কী রাষ্ট্র? কার হতো ক্ষতি!
আজ সকালেই যখন ঘুম ঘুম চোখে রোজিনার ছবি দেখছিলাম, পড়ছিলাম কিছু সময় আমার মাথা কাজ করছিলোনা, ঠিক কী দেখছি !

একটা সময় পর আমার অন্য রকম ভালো লাগছে, দিন শেষে একজন রোজিনা যখন শতেক পুলিশী পাহারায় আদালত পাড়া থেকে কারাগারে যাচ্ছেন আমি দেখছি কী ভীষণ শক্তিশালী এই রোজিনা…
অনেক তো হয়েছে, এবার আমি শুধু বলবো, যা কিছু অন্যায়, তার বিরুদ্ধে যে যার অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলুন, কালোকে কালো এবং সাদাকেই শুধু সাদা বলুন এক সাথে।
হোক প্রতিবাদ।
রোজিনাকে হেনস্তা করা সংশ্লিষ্ট সকলকে বিচারের আওতায় আনতেই হবে। রোজিনাকে নয় রোজিনাকে অত্যাচার করলো যারা তাদের শাস্তি চাই। রোজিনাকে এখুনি মুক্তি দিন। আমাদের প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
হোক প্রতিবাদ!

নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments