কাজী মাহবুব হাসান, অনুবাদক; আগ্রহের ক্ষেত্র বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ইতিহাস, এবং সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে এই দুটি ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়া। তিনি লেখালেখি করেন তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগ জীবনের বিজ্ঞানে (kmhb.wordpress.com) । প্রকাশিত বই: রিচার্ড ডকিন্সের দ্য গড ডিল্যুশন, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, সভ্যতা: একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শনের সহজ পাঠ, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, চার্লস ডারউইন: একটি ধারণার বিজয়, দ্য ম্যাজিক অব রিয়েলিটি, বিবর্তন কেন সত্য, দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং। কাজী মাহবুব হাসান বাস করছেন টরন্টো, কানাডায়।
চারপাশে ঘেরা অদৃশ্য আয়না,
বাতাসে প্রতিফলিত প্রতিকৃতি আমার
ফিরে আসে বুমেরাং হয়ে,
অহংকারী একাকিত্ব
প্রতিধ্বনিত হয় শেওলা অন্ধকারে,
আবার ফিরে আসে আমারই অশ্রুজলে,
চারপাশে ঘেরা অদৃশ্য আয়না,
চমকে উঠি প্রতিবিম্বে তোমাকে দেখে !
(বুমেরাং : আসমা সুলতানা)
শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রহস্যময়তা অনুপস্থিত থাকে যখন শিল্পী আজন্মই শিল্পী। আসমা সুলতানা শিল্পী হয়েই জন্মেছিলেন। যার সহজাত অন্তর্গত ভাবনাগুলোই সৃজনশীল রুপে বিবর্তিত হয়েছে পরিশীলিত একটি অভিব্যক্তিতে, যেখানে সৌন্দর্য, আবেগ, সময়ের অতিক্রমণ আর সযত্নে লালিত স্বপ্নগুলো তাদের থমকে থাকা শ্বাস ফেলতে পারে মহাকাব্যের পরিসরে। যারা মনের সংযোগকে সুনিশ্চিৎ করে ২০০৪ এ আসমা সুলতানার প্রথম একক প্রদর্শনী ‘এপিক’ – এর ক্যানভাসগুলোয় চোখ রেখেছিলেন, কিংবা শিল্পীর বিবৃতিটি পড়েছিলেন তারা হয়তো আসমার সাম্প্রতিক কাজ দেখলেই অনুভব করতে পারবেন শিল্পীর সেই মহাকাব্যিক যাত্রার গন্তব্যটির অভিমূখ। আর যারা প্রথমবারের মত দেখছেন, তাদের মনের ভিতর ভেসে ওঠা প্রশ্নটির উত্তর প্রশ্নের সম্পূরক হয়ে ওঠে যখন মৃদুভাষী শিল্পী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, তার সৃষ্টিকর্মে তিনি তার জীবনের কথাই বলছেন, এবং তিনি তাদেরই একজন, আমাদের আগেই যারা আমাদের কথা বলেন। আমাদের পক্ষে অনুভব করার সম্ভাবনা আরো ত্বরান্বিত হয় যখন আমরা বুঝতে পারি, আসমা সুলতানা ক্রমশ দুর্লভ হয়ে ওঠা সেই শিল্পীদের একজন যার শিল্পকর্মের মূলভাবনা আত্মজৈবনিক। শিল্পী হিসাবে বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক-ভৌগলিক পরিবেশে নিজের পরিচয় খুঁজে নেবার সংগ্রাম, মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাড়াবার নিরন্তর যুদ্ধ, অপমান, বঞ্চনা আর আত্মত্যাগের নানা আখ্যান প্রতীকী রুপ খুঁজে পেয়েছে যেমন তার ক্যানভাস, প্রিন্ট এবং স্থাপনা শিল্পে তেমনি তার কবিতার শব্দে।
শিল্পী একক প্রদর্শনীতে, ২০১৮, গ্যালারী১৩১৩, টরোন্টো, কানাডা
২০১৭ র নভেম্বরের শীতে টরোন্টোর গ্যালারী ফিফটিতে শিল্পী আসমা সুলতানার সাম্প্রতিকতম প্রদর্শনী ‘লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড’ ছিল তার সেই মহাকাব্যিক যাত্রারই আরেকটি সংক্ষিপ্ত বিরতি, শিল্পীর মনোজগতের শারীরিক একটি প্রকাশে দর্শকরা সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সম্প্রসারিত সমন্বয়পন্হী এক মনে প্রবেশ করার জন্য। শিল্পীর কথোপকথনের শব্দহীন অভিব্যক্তিগুলো যেখানে রুপ পেয়েছিল ছাদ থেকে মেঘের মত ভেসে থাকা বারোটি সাদা শিশুদের জামা, কিংবা ছাদ থেকে মাটি স্পর্শ করা জরায়ুর দুটি হাতের রক্তাক্ত প্রতীকি ছাপসহ দীর্ঘ একটি জামা, যন্ত্রণার অস্বস্তিকর চুলসহ নকশি কাজের হৃদপিণ্ড, জরায়ুর বেশ কটি রুপ, ভ্রূণ, কাপড়ের খামে প্রজাপতির ভাঙ্গা ডানা, কিংবা শুকনো বীজের একটি ডাল, সিল্কের ফিতায় চুল দিয়ে সেলাই করা সময়ের সাক্ষী হয়ে তাকিয়ে থাকা অষ্টাশিটি নক্ষত্রপুঞ্জ, কিংবা কাগজে হাতের আঙ্গুলে ছাপে আঁকা অনুপস্থিত শিশুর জামায়।
লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড, ২০১৬, শিল্পীর চুলদিয়ে সেলাই করা কাপড়ে, ১৪ বাই ১৪ ইঞ্চি
শিল্পীর অজাত শিশু শিল্পীরই শিল্পকর্ম, মায়ের জরায়ুতে যেমন করে মায়ের পুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে ভ্রূণ, শিল্পী মনের স্বপ্নে আর আশায় পুষ্ট হয় তার শিল্পকর্ম, যেন শরীরের বাইরে জন্ম নেয়া শিশু। যে শিশু শিল্পী গর্ভে ধারণ করেনি, সেটি আসলে তারই মনের সৃষ্টি, আর সেটাই বাস্তব রুপ পায় তার নিজের হাতে বানানো শিশুর জামায়, কাপড়ে তোলা নকশি কিংবা আঙ্গুলের ছাপে আঁকা ড্রইং এ। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে যখন দেখা যায় শিল্পী পরম মমতায় সংগ্রহ করা নিজেরই মাথার পরিত্যক্ত চুলকে তার শিল্পকলার অংশ করে নিয়েছেন। আর এই ঝরে পড়া আর কিংবা শিকড়চ্যুত চুল প্রতীকী তাৎপর্যে অর্থবহ উঠে শিল্পী জীবনের অভিজ্ঞতার নানা স্তরে। তার সেলাইয়ের কাজে সুতোকে প্রতিস্থাপিত করেছে চুল, আর এই চুল সংগ্রহ,পরিষ্কার ও তাদের সংরক্ষণ, সব কিছুই তার কাছে খুব সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কোনো কাজের মতই, যেন কোনো শিশুর প্রতিপালন। এভাবেই শিল্পী নিজের সাথে নিজের একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন, রূপান্তরিত হন তার নিজেরই জননী এবং সন্তানে।
শিল্পীর ‘লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড’ কল্পনার একটি প্রবেশ আর প্রস্থান বিন্দু, মাধ্যাকর্ষণমুক্ত বিষন্নতার সাথে একটি ক্ষতকে ব্যাখ্যা করা প্রয়াস। চিরায়ত নকশিকাঁথা সেলাইয়ের একটি ভিন্ন রুপকে নতুন করে উপস্থাপন করা, যাকে শিল্পী বিনির্মাণ করেছেন গল্প বলার গোপন শক্তিটির সম্ভাবতা যাচাই করার জন্য, সচেতন স্তরে যা শনাক্ত করার আগেই এর প্রথাগত উপস্থাপনায় সামাজিক মনস্তত্ত্ব আর আড়ষ্ট নিয়ম প্রায়শই যেখানে শুষে নেয় এর গল্প বলার আর স্বাধীন অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতাটিকে। আমার অজাত শিশুর প্রতি চিঠির কাজগুলো শিল্পীর যে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করছে, সেই জীবনে প্রবেশ করার দরজাটি সংবেদী কোনো দর্শকের মনে হতে পারে একটি ক্ষতচিহ্ন, যেখানে প্রবেশ আর বের হয়ে আসার পথেই শিল্পীর যন্ত্রণাময় শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতাটি প্রতিস্থাপিত হয় নন্দনতাত্ত্বিক সমীকরণের উভয় পাশেই। বিষন্নতার নির্ভার সেই অনুভূতিগুলো আরো নিকটবর্তী করে শিল্পীকে আমাদের নিজেদের স্বীকৃতিহীন অনুভূতিগুলোর দুঃসহ বিলাপে।
এ্যালকেমি অব লসেস, ২০১৬, শিল্পীর চুল দিয়ে সেলাই করা কাপড়ে, ১২ বাই ১৬ ইঞ্চি
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কৃষ্ণতম অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া শিল্পী তার পরিবারের টিকে থাকার অর্থনৈতিক সংগ্রাম, অবহেলিত শৈশবের অমোচনীয় স্মৃতিকে অনায়াসেই চিহ্নিত করতে পারেন তার জীবনের গল্প বলার জন্য শিল্পকলায় আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞানে। নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার অমসৃণ সংগ্রামটিকে আসমা নিঃসংকোচে তুলনা করতে পারেন দমকা বাতাস থেকে সারাক্ষণই মোমের প্রায় নিভু নিভু শিখাকে বাঁচানোর অন্তহীন প্রচেষ্টার সাথে। শিল্পী মনে করিয়ে দেন ভালোবাসার মৃত্যুর প্রথম শিকার হচ্ছে সত্যিকারের স্মৃতিগুলো; সততা, নিরপেক্ষতা আর শ্লীলতার সাথে স্মৃতিচারণের কোনো সুযোগ থাকেনা, যা বর্তমানের জন্য খুবই অস্বস্তিকর, অসুবিধাজনক আর গর্হিত। আমাদের ব্যর্থতা আর হতাশার উৎসবে যা অশরীরি আত্মার মত অনাহুত। কিন্তু শিল্পী বিস্মরণের সেই দমকা হাওয়ার মুখেই তার সততার প্রদীপ শিখাটি তুলে ধরেন, কতটা পথ সেটি আলো দেখাতে পারে সেটি জানার জন্য। তার স্বভাবসূলভ সূক্ষ্মতায় তিনি মনে করিয়ে দেন নৈরাশ্যবাদ খুব সহজ, এমনকি আকর্ষণীয়, বৌদ্ধিক আর নন্দনতাত্ত্বিক অভিব্যক্তিতে, কারণ এটি আমাদের মুক্ত করে সমাধান খোঁজার দুরূহ দ্বায়িত্ব থেকে, আমাদের উত্তেজিত করে গুরুত্বহীনতার মহাউৎসবে মত্ত হতে। কিন্তু শিল্পী সেটি চাননি, কোনো শল্য চিকিৎসকের ছুরি হাতে তিনি মহাজাগতিক সেই বাস্তবতাটিকে উন্মুক্ত করেন, বোধগম্য মিথ্যার গভীরে দুর্বোধ্য একটি সত্য।
বিশুদ্ধ সুন্দরকে অনুসরণ করেই একদিন আকাশের ওপারে অন্য আকাশের ঠিকানায় দেশান্তরী হয়েছেন, স্থায়ী হবার জন্য এখনও যে যাযাবর জীবন খুঁজে পায়নি উর্বর মাটি। চলমান জীবনের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন তার শিল্পে, নিজের জীবনটাকেই একান্ত নিজের করে নিয়ে সৃষ্টিতে আত্মমগ্ন হয়েছেন, যেখানে নিজের অস্তিত্ব মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর যাপিত জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতার স্মারক। নিজের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রত্যয়ে তার শরীরেরই অনন্য অংশ, হাতের আঙ্গুলের ছাপ প্রতিস্থাপিত করে তুলি, মাথার চুল জায়গা নেয় সুতোর – প্রতিকীরুপে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে শিল্পীর জীবনের কোলাজ। অবশ্যই এই মহাকাব্য এখনও পরিণতি পায়নি, শিল্পী মনে করিয়ে দেন; আর তার সেই মহাকাব্যকে বুঝতে আমাদের সচেতন স্মৃতিতে ধরে রাখতে হবে মহাকাব্যের সূচনাটিকে। আর অতীত, অতীত হবার কারণে আমাদের কাছে যা অস্পৃশ্য রয়ে যায় চিরকালই – সময়ের ধ্বংসলীলায় টিকে থাকা অবশিষ্টাংশগুলোই কেবল টিকে থাকে সময়ের সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে পুনঃসৃষ্টি করার জন্য। আর স্মৃতির সেই কথোপকথনের অনুরণন শিল্পীর সৃষ্টিতে প্রাণ খুঁজে পায়।
মগ্ন শিল্পী
শিল্পীরে কাজে তীব্রতম অনুভূতির সূঁচ ফোটানো জমিন যেন সেই অস্থির প্রান্ত, শিল্পী যেখানে কিছু খুঁজে বেড়ান, হয়তো সেখানে, এর পেছনে লুকানো আছে, যা তার নিজের খুব গভীরেই, কিন্তু কি সেটি, শিল্পী বলেন তার সত্তা, তার আত্মপরিচিতি। শিল্পী মনে করিয়ে দেন আমরা এমন একটি যুগে বাস করি সেখানে আমাদের সেই সত্তা আর আত্মপরিচয় আবৃত আর আশ্রিত ভুল কোনো ঠিকানায়। যখন আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোর সাদৃশ্যতা এত বেশী হয়ে ওঠে, দূঃখজনকভাবে আমরাও সদৃশ্য হয়ে উঠি, খুব সহজে যা সৃষ্টি করে সংশয়, কারণ পাশের অন্য কোনো মানুষ থেকে আমরা আর কতটাই ভিন্ন হতে পারি, খুব সামান্য, কোনোমতে স্পর্শযোগ্য, আর যদি এর সাথে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়, এই পরিস্থিতি আমাদের জানিয়ে দেয় মানুষ কেবল অন্য মানুষকেই অনুকরণ করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পরিসংখ্যানগতভাবে পরিমাপ করতে পারি, তাদের মতামতকে প্রভাবিত করতে পারি, আর সেকারণে মানুষ এখন কোনো একক ব্যক্তি নয় বরং একই জনগোষ্ঠীর উপাদান।
ব্যক্তিপরিচয়ের এই অনিশ্চয়তায় শিল্পীর সূঁচ তার নিজের সত্যটি অনুসন্ধান করেন নিজের গভীরে তার আত্মপরিচয়ের শনাক্তকারী চিহ্নগুলোকে আরো প্রকট করে। অন্যভাবে হয়তো বলা যায় শিল্পী নিজেকে প্রশ্ন করেন তার সত্তার সীমানাকে নির্দেশ করার জন্য। তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সেই প্রকটতা তাকে কতটুকু বদলে দিয়েছে, বর্তমান আর অতীতের সংযোগকে তিনি কি স্পর্শ করতে পারবেন অবিচ্ছিন্ন জীবনেরই একটি অংশ হিসাবে। কোথায় সেই সীমানাটি, যেখানে শিল্পী নিজেকে অনন্য করেন অসংখ্য অভিন্ন সত্তা থেকে। অন্য শিল্পীর ব্যতিক্রম তিনি আসলেই নিজের কথাই বলেছেন, শিল্পী জীবনের শুরুর সেই অভ্যাসগত প্রক্রিয়াকে তিনি পরিত্যাগ করতে পেরেছেন আর তার ফ্রেমে ঠায় নিয়েছে বিশুদ্ধ কিছু প্রতিক্রিয়া, আর সেটাই তাকে ভিন্ন করে তুলেছে ও তুলছে। আধুনিক শিল্পকলার অন্ধবিশ্বাসীদের তিনি প্রতিহত করেন, যারা সেই ঐতিহ্যবাহী আর আধুনিক শিল্পকলার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছেন, শিল্পীর কাছে তাই শিল্পকলার ইতিহাস তার সামগ্রিকতায় পূর্ণ, আর সেকারণে সেখানে সরল কোনো বার্তা নেই আপাত সরল উপকরণের ভীড়ে, আমাদের তিনি প্ররোচিত করেন নিজের খুব ভিতরের একটি অনুভূতির সাথে বোঝাপড়া করার জন্য, কখনো নিঃশর্ত আত্মসমর্পন অথবা কখনো কৌশলগত প্রস্থানের মাধ্যমে।
শিল্পী জানেন বর্তমানে শিল্পকলা তত্ত্বের অতিকথনে আড়ষ্ট, যা শিল্পকলাকে সরাসরি স্পর্শ করতে দেয়না তার দর্শককে, শিল্পী খুব সরলতায় সেই পথটি অস্পষ্ট করে দিয়েছেন যেন এটি আবদ্ধ না হতে পারে শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার অকপট স্বীকারোক্তি হিসাবে। আমরাও যেন শিল্পীর আপাতদৃষ্টিতে উপস্থাপিত নৈরাশ্যবাদকে রুপান্তরিত করতে পারি আনন্দময় নৈরাশ্যে, কারণ আমরা আমাদের নিজেদের শিকড়টাকে সেখানে স্পর্শ করছি, আর সেটাই সত্যিকারের নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতি, বিক্ষত হৃদয়ের এই আর্তনাদ তাই আমাদের শঙ্কিত করেনা, এর উপস্থাপনের সরলতা মনে করিয়ে দেয়, শিল্পী আমাদের আগেই আমাদের কথাগুলো বলছেন। আমরা আমাদের প্রতিবিম্বকে দেখি, আমাদের গভীরের লুকিয়ে থাকা আমাদের অনন্য সত্তার হীরক খণ্ডটি, আমাদের যে প্রতিবিম্বটি মনে করিয়ে দেয় সেই শক্তিময় দূর্বল আর অসীমভাবেই ভঙ্গুর সত্তা যা আমাদের শরীরের মধ্যে এখনও কম্পমান, যেখানে আমরা অর্থহীন দুর্ঘটনার এই জীবনটিকে কাটানোর কারণ অনুসন্ধান করি।
রবার্ট ম্যাকলগলিন গ্যালারী, ওশোয়া, কানাডা, শিল্পীর কাজের সামনে দর্শক ও শিল্পী নিজে, ২০১৪
২০১৪ র কানাডার অশোয়ায় রবার্ট ম্যাকলগলিন গ্যালারী আর সাউথ এশিয়ান ভিজ্যুয়াল আর্ট সেন্টার আয়োজিত প্রদর্শনী ‘বিয়ন্ড মেজার: ডোমেস্টিকেটিং ডিসট্যান্সে’ আসমা উপস্থিত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্বৈততা এবং এর মাধ্যমে উদ্ভুত মিশ্র পরিচয়টির ব্যবচ্ছেদের সহজাত বিশ্লেষণী দক্ষতায়। তার শিল্পকর্মে সম্মিলিতভাবে অনুভব করা কাহিনীতে এই দুটি পরিচয় আর স্থানের মধ্যবর্তী শুন্যতা আরো বেশী অর্থবহ হয়ে ওঠে। স্মৃতিচারণ, আখ্যাণ এবং পর্যবেক্ষণ আর ভাবনায় পুষ্ট তার কাজটি অচেনা ভূমিতে চেনা প্রান্তর আর বর্তমানের সময়ের কাঠামোয় অতীতকে পুনঃব্যবহার করে দেশান্তরের প্রাসঙ্গিকতায় নিজেদের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখি।
শিল্পীর যে স্থাপনা শিল্পটি এই প্রদর্শনীর অংশ ছিল সেটির শিরোনাম ‘হোয়েরেভার দ্য গ্লিম্পস অব এ ফ্রি স্পিরিট এক্সিস্ট, দ্যাট উইল বি মাই হোম’ ; শিল্পীর ধারাবাহিক কাজেরই একটি – যে প্রধান ধারণার শিকড়ের উপর দাড়িয়ে আছে, তাহলো শরীরের বাইরে বেড়ে ওঠা শিল্পীর স্বপ্নশিশু। এবার শিল্পীর এই স্বপ্নশিশুটি নকশিকাঁথার বুননে মাথার চুল দিয়ে সেলাই করা একটি সাদা শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজ। নিজের মাথার চুল দিয়ে সেলাই এর বুনন সেই তীব্র আবেগের ইশারা দেয়, প্রতিটি স্বপ্ন তার মত করে বেড়ে ওঠার জন্য ঠিক কতটুকু আত্মত্যাগের পুষ্টি দাবী করে। যেন পরিত্যক্ত, নির্বাসিত কোন অবয়বহীন অশরীরির সত্তাকে আকড়ে ধরে রাখা সফেদ শাড়ি সহস্র মাইল পেরিয়ে আসা দূরত্বকে সংক্ষেপিত করে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাসে। ভাঁজ করে রাখা পেটিকোট আর ব্লাউজ ভাঁজে ভাঁজে মাথার চুলের বুনন উঁকি দেয়, গোলাপের নক্সা আঁকা চুলের সুতোয় দেখি ব্যস্ততা, নির্ভার কোন শরীরের উষ্ণতা যেখানে এখনও মাকড়শার জালের মত আকড়ে আছে।
আজ আমার ঘরের নম্বরটি মুছে দিয়েছি,
মুছে দিয়েছি গলির মাথায় গলির নামও
মুছে দিয়েছি প্রতিটি রাস্তায় আমার ঠিকানা দেখানো সব চিহ্নগুলো
কিন্তু তারপরও আমার সাথে
যদি সত্যি দেখা করতে চাও
তাহলে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শহরের প্রতিটি রাস্তায়
প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়ো –
এ এক আশীর্বাদ, আবার অভিশাপও –
আর যেখানেই দেখা মিলবে মুক্ত কোন আত্মার,
জানবে সেটাই আমার ঘর।
(মেরা পাতা, অমৃতা প্রিতম, অনুবাদ- কাজী মাহবুব হাসান)
শিল্পীর নিজের ভাষায় – কাজটির আংশিক অনুপ্রেরণা অমৃতা প্রিতমের মেরা পাতা কবিতাটি। তার স্থাপনা শিল্পটির শিরোনাম হিসাবে বেঁছে নিয়েছেন কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদের শেষ দুটি পংক্তি। আর সেখান থেকে শিল্পীর সৃষ্টিটি অনুভব করার আগেই আমরা শিল্পীর মনে প্রবেশ করতে পারি, অনুভব করতে পারি ঠিকানা থেকে ঠিকানায় যাযাবরের মত ঘর বদলানো শিল্পীর কাছে টিকে থাকা একটি ধ্রুব – যেখানে মুক্ত আত্মা শ্বাস নিতে পারে – যে আকাশের নিচেই সেই ঠিকানা হোক না কেন, সেখানেই তার বসবাস।
দিখণ্ডিত আমি সত্তায় সত্তায়
মাটি থেকে আকাশ, আর আকাশ মেঘে
দেহ থেকে আত্মা হারালে বলে মৃত
আর আত্মা থেকে দেহ হারালে বলে স্খলিত
আমি দুটোই, তাই নেই ঘর, নেই কবর।
(স্বাধিষ্ঠ: আসমা সুলতানা)
শিল্পীর চুল দিয়ে সেলাই করা, সিল্কের ফিতায় শিশুদের ঘুমপাড়ানী গান, ২০১৬
বেশ কয়েক বছর আগে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অমৃতা প্রিতমের কবিতাটি তিনি পড়েছিলেন- কবিতার শব্দগুলো তাকে স্পর্শ করেছিল কারণ নিজের জীবনের প্রেক্ষাপটে অর্থবহ ছিল এর মূলসুর। এই কবিতার মতই তাকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে পরিচিত পরিসর, পরিবার, বন্ধু, ঠিকানা, দেশ এবং মহাদেশ – নিজেকে বিকশিত করার অপরিহার্য কিছু স্বপ্ন। পাখির মত বাতাসে ভর করা ডানায় তাকে বহু পথ অতিক্রম করতে হয়েছে বেশ কিছু ভৌগলিক সীমারেখাকে শঙ্কা আশা আর উৎকন্ঠায় দ্রবীভূত করে। অচেনা ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর প্রবাহিত কোন নদীর মত। শিল্পী মনে করিয়ে দেন যখনই কোন প্রবাহমান নদী কিংবা আকাশে মুক্ত পাখির দেখা মেলে – তখন শিল্পীকেও আমরা মনে রাখবো। নিজের কাজকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আত্মজীবনীমূলক হিসাবে। আমরা কাছাকাছি পৌঁছে অনুভব করতে পারি শিল্পী কেন তার শিল্পকলার সাথে সম্পর্কটাকে উপস্থাপন করছেন জীবন্ত কোন চরিত্রের মত – বিদ্যমান সম্পর্কগুলো যেখানে অনির্বচনীয় জটিলতায় ভারাক্রান্ত। আর সেই সম্পর্কগুলো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের বোধগম্যতর কাছে অতিক্রম্য হয়ে ওঠে শিল্পী যখন নিজের পরিবার আর স্বদেশের সাথে নিজের সম্পর্কটাকে একই সমান্তরালে তুলনা করেন। তার সাহসী স্বীকারোক্তি জানান দেয়া শব্দতো বটেই শিল্পের প্রেক্ষাপটে যা ব্যাখ্যা করা যন্ত্রণাময় আর কঠিন – তারপরও তার সৃষ্টিকর্মের মূল ভিত্তি সেই সম্পর্কগুলোই, নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই আমরা তার কাজে মূখর হয়ে উঠতে দেখি প্রত্যাখান আর বিসর্জনের তীব্র নীরবতায়।
শব্দগুলো তখনো পায়নি কবিতার শরীর
অনুভূতিগুলো পায়নি নাম সেইদিনও, যাকে বলা যায় কবিতা
কবিতাগুলো তখোনো অলিখিত, ছড়ানো ছিটানো ছিল
নক্ষত্রের বুদ বুদে, জলের ঢেউয়ের কন্টুরে কন্টুরে,
আমার চুলের ক্লিপের দুই বাহুতে…আঙ্গুলে…
তোমার হাতে বাধা সুইস ঘড়ির কাঁটায়,
শব্দগুলো ছিল ; আমাদের হৃদয়ের বোতাম বন্ধ জামাগুলোতে
অক্ষরগুলো ছিল রূপকথার খাঁচায় পোরা
সোনার টিয়া পাখির হিরেয় বাধানো ঠোঁটের ভাঁজে–
কবিতাগুলো তখনো কবিতা হয়ে ওঠেনি
আমার জরায়ুর ভেতর তখনও ঘুমন্ত ভ্রূণের মত ছিল,
শেষ হেমন্তের সন্ধ্যাবেলায়, কালপুরুষকে সাক্ষী রেখে…
(মার্গিক মুর্ছনা: আসমা সুলতানা)
শিল্পীর চুল দিয়ে সেলাই করা বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের আদলে, কিছু অংশ, ২০১৬
শিল্পীর জন্মের সময় বাংলাদেশে বয়স মাত্র পাঁচ, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষে বিধ্বস্ত, ক্ষত বিক্ষত মানুষগুলো তখন কেবল দেশটাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সময়ের সেই অনিশ্চয়তাকে ভাষা দিয়েছিল অস্থির রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের পাত্রপাত্রীরা, দীর্ঘদিনের সামরিক দূঃশাসনের শৈত্য প্রবাহ থমকে দিয়েছিল সব সৃজনশীলতার বিকাশ। শিল্পীও সেই সব অনিশ্চয়তাকে আত্মীকৃত করে বেড়ে উঠেছিলেন সমস্যা জর্জরিত একটি পরিবারে। শৈশবের সেই সংগ্রামের সময়গুলো তাকে পরিবর্তনও করেছিল ভিন্ন একটি পরিচয়ে, যে পরিবর্তনগুলো তিনি শনাক্ত করেছেন আরো অনেকদিন পর- কাল অতিক্রমনের পর অতীতমুখী পর্যবেক্ষণ তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে কেন তাকে এই পথেই হাটতে হয়েছে। অনুভব করতে পেরেছেন, কিভাবে সবাই তার সংবেদনশীল মনন থেকে নিজেদেরকে আবেগময়তার স্তরে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কোন দ্বীপের মত। শুধু মানসিক স্তরেই নয় – শারীরিকভাবেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভেবেছেন তিনি। এই সঙ্গহীন উপেক্ষিত অস্তিত্বের একটি আশ্রয় তাকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। শৈশবের প্রথম অনুভবগুলো তাই তিনি অনায়াসে খুঁজে পান নিজের সৃজনশীলতায় – শিল্পী হবার সংকল্পে। সৃষ্টি করার তীব্র স্পৃহা যেন রক্ষাব্যুহের মত তাকে ঘিরে রেখে রেখেছিল একটি মাত্র স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে- একটি মাত্র স্বপ্ন যা কখনই বিস্মরিত হয়নি – শিল্পী হবার স্বপ্ন। বিষণ্ন আত্মবিশ্বাস সহ তাই শিল্পীকে আমরা বলতে শুনি এখনও তার পথ চলা অনেক বাকী – এই বর্তমানটি শুধু বলা যাবে কেবল নিজেকে শিল্পী হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় একটি পদক্ষেপ। কোথাও শিকড় না গাড়তে পারা অস্থির জীবনের একমাত্র স্থিরতা, একমাত্র ধ্রুব এই স্বপ্নটিকে অনুসরণ করতে তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতা। শিল্পীর এই সংগ্রাম সেকারণেই তার সৃষ্টি কর্মে – কবিতা কিংবা শিল্পকর্ম – যুক্ত করে প্রায় স্পর্শযোগ্য একটি সততা। অনুভব তো বটেই – আমরা প্রায় সেটি স্পর্শ করতে পারি।
মগ্ন দর্শক ‘এ্যালকেমি অব লসেস’- একক প্রদর্শনী, ২০১৭, ঢাকা, বাংলাদেশে
২০০৪ সালে প্রথম একক প্রদর্শনীর পর শিল্পী প্রথম বারের মত বহু সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করে প্রবাসী হয়েছিলেন – কিন্তু সেখানে সহজতর হয়ে ওঠেনি তার সংগ্রাম। তবে নতুন আবহাওয়া, সংস্কৃতি, ভাষা মানুষের মাঝে খাপ খাইয়ে নেবার প্রচেষ্টা তার দৃষ্টিভঙ্গীর দিগন্তকে প্রসারিত করেছিল। সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের নমনীয় একটি স্থিতিস্থাপকতা তাকে সুযোগ করেছিল দুটি সমাজের সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্যকে মূল্যায়ন করার জন্য, পরিশেষে যা তাকে সেই সব শিল্পীদের মত ভাবতে সাহায্য করেছিল – স্বদেশ থেকে নির্বাসিত যে শিল্পীরা ভিন্ন পরিবেশে দাড়িয়ে যেভাবে সৃজনশীল সংবেদনশীলতায় নতুন করে অনুভব করেন পরিত্যক্ত স্বদেশকে। আসমা সুলতানার সৃষ্টিতে – কবিতা কিংবা ক্যানভাসে – শামুকের ধীর দৃঢ়তা নিয়ে ফিরে আসে স্বদেশ – নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে। আমরা তার শিল্পী হিসাবে প্রসারিত হবার একটি নিয়ামক, তার বক্তব্য অনুযায়ী দেখতে পাই – ইউরোপ জুড়ে বহু চিত্রকর্ম দেখার অভিজ্ঞতা, আরাধ্য শিল্পীদের ক্যানভাসের সামনে দাড়ানো সেই অতুলনীয় স্বর্গীয় অনুভূতি তাকে শুধু অনুপ্রাণিত করেনি, নিজের মৌলিক স্বকীয়তা খোঁজার তাড়নায় রুপান্তরিত হয়েছিল। যে নির্দেশনাটি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে পারেনি কখনো। শিল্পকলার ইতিহাসে তার আগ্রহী মন ব্যাখ্যা খুঁজেছে শিল্পীরা কিভাবে সভ্যতার অনুঘটকের কাজ করেছে, আমাদের সংবেদনশীলতাকে পরিশীলিত আর সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে শেখানোর মাধ্যমে। তার বর্তমান কাজটি অনুপ্রেরণা আমরা শুধুমাত্র অমৃতা প্রিতমের কবিতা না, তার অভিজ্ঞতাও প্রসূত হিসাবে আমরা অনায়াসে কল্পনা করতে পারি।
প্রথম প্রবাসে সংক্ষিপ্ত সময়ে নিয়তির অন্য পরিকল্পনা ছিল, তাকে আবার দেশান্তরী হতে হয়, শিল্পী তার জীবনের সব একাকীত্ব আর নির্জনতা, কষ্টগুলোকে পাতন করে ঘনীভূত করেন তার শিল্পকর্মে ব্যবহৃত সব প্রতীকীকে। পরিবার বিচ্ছিন্ন এবং পরিবারহীন শিল্পী তার সেই শিল্পকর্মকে লালন করেন তার সন্তানের মত – যা তার একান্ত নিজস্ব পরিবার। কখনো তারা অতীত কোন সময়ে নিয়ে যাবার যন্ত্রযানের মত, যা অনায়াসে তাকে তার হারানো শৈশবে নিয়ে যেতে পারে, যাদের সামনে দাড়িয়ে ফেলা প্রতিটি পলক রুপান্তরিত হয় টাইম ট্রাভেলে।
আমার শব যাত্রায় সেদিন সকলে উপস্থিত ছিলো
সেই মধ্য মে তে, দম বন্ধ করা ঢাকার গরমে
সকলেই উপস্থিত ছিলো সেদিন,
আমার মা, আমার নানী মায়ের
দেয়া রূপার চামচ, চাচাতো বোন
তার যত সব, তাবিজ-কবচ
বাবা আর বাবার চশমায় ঝাপসা কুয়াশা…
ভাইয়ের পাঞ্জবীতে রক্তের অমাবস্যা।
আমার শব যাত্রায় সেদিন সকলেই উপস্থিত ছিলো,
আত্মীয়, অনাত্মীয়, জীবিত বন্ধু সকল,
মৃত বন্ধু আর তার আত্মাও জ্বলজ্বল,
আমার শব যাত্রায় সেদিন সকলেই উপস্থিত ছিলো
যদিও অনেকের আসায় ছিলো বারণ,
হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এসে জানিয়ে দিলো
তোমার না আসার কারণ!
(২০ মে , ২০০৪: আসমা সুলতানা)
ড্রইং এবং পেইন্টিং এ প্রধানত প্রশিক্ষিত হলেও শিল্পী বহু মাধ্যমেই কাজ করেন। ২০১২ সালে আসমা সুলতানা কাপড়ের কোলাজ নির্ভর কিছু মিক্সড মিডিয়ার কাজ থেকেই মূলত তার কাজের উপাদান হিসাবে জায়গা করে নেয় কাপড়। আর সেলাই করার দক্ষতাও তাকে আরো সাবলীল করেছে এই মাধ্যমে। এই একই সময় আমরা তার কাজে দেখতে পারি তুলি নয় বরং আঙ্গুল আর হাতে ছাঁপ জায়গা করে নিয়ে ড্রইংয়ের টুল হিসাবে। আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করার সাথে নিজের স্বকীয়তা আর আত্মপরিচয়ের ভাবনাটি ছিল প্রগাঢ়। সুবিশাল কাগজের উপর অসংখ্য আঙ্গুলের ছাপ – যা আমার জানি প্রতিটি মানুষের জন্য অনন্য– শিল্পী আত্মপরিচয় খোঁজার অস্তিত্ববাদের টানাপোড়েন এর তীব্র ইঙ্গিত হয়ে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। নিজের অনন্য চিহ্নকে গর্ভজাত সন্তানের মত শিল্পকলার নিজের শিল্পকর্মের সৃষ্টির সাথে একাত্ম করার প্রচেষ্টা আমরা অনুভব করতে পারি। ঠিক যেন প্রজন্মান্তরে নতুন জীবনের নিজের অমর ডিএনএ হস্তান্তর।
শিল্পী পরবর্তী একক প্রদশর্নীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ২০১৮, টরোন্টো, কানাডা
সেই একই তাড়নায় তিনি অনুসন্ধান করেন আর কি আছে যা তার একান্ত নিজস্ব, যাকে আঙুলের ছাপের মত নিজেরই শিল্পকর্মে অমর করে রাখা যেতে পারে। যা শিল্পকর্মের সাথে অবিচ্ছেদ্য একটি সেতুবন্ধন রচনা করবে – নিজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশের সাথে। সন্তানহীন শিল্পীর কাছে তার শিল্পকর্মই নিজের গর্ভজাত সন্তানের মত, শরীরের বাইরে বেড়ে ওঠা সেই সৃষ্টি তার নিজের অংশ – যারা জরায়ুতে নয়, শরীরের বাইরে শিল্পীর গভীর মমতায় বেড়ে ওঠে। এই ভাবনা থেকে সূত্রপাত হয় কাজে তার নিজের মাথার চুলের ব্যবহার। তার বৈশিষ্ট্যসূচক বড় চুল যখন মাথা থেকে পড়ে যায়, কিংবা চিরুনীর ভাঁজে আটকে যাওয়া চুল পরম যত্ন সহকারে সংগ্রহ করতে শুরু করেন। পরিত্যক্ত সেই চুল একটি একটি করে তিনি সংগ্রহ করেন সযত্নে, যে যত্ন আর আবেগময় ভালোবাসা তিনি কারো কাছে পাননি, তিনি সেই
লেটার টু মাই অনবর্ন চাইল্ড, ২০১৬, শিল্পীর চুলে সেলাই করা শিশুর জামা, টরোন্টো, কানাডা
পরিত্যক্ত চুলকে তার শিল্পকলার অংশ করে নেন। আর এই ঝরে পড়া আর কিংবা শিকড়চ্যুত চুল প্রতিকী তাৎপর্যে অর্থবহ উঠে শিল্পী জীবনের অভিজ্ঞতার নানা স্তরে। এই চুল সংগ্রহ,পরিষ্কার তাদের সংরক্ষণ সব কিছুই তার কাছে হয়ে উঠে একটি আচার অনুষ্ঠান, যেন খুব সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কাজ –শিশুর প্রতিপালনের মত। এভাবেই শিল্পী নিজের সাথে নিজের একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তিনি রুপান্তরিত হন তার নিজেরই জননী এবং সন্তানে।
মাথার দীর্ঘ চুল এখনও বাঙালী রমণীর সৌন্দর্যর সংজ্ঞার অংশ হয়ে আছে – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে দীর্ঘ ঘন চুলের গুরুত্ব তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে বহু দিন আগেই। চুল আমাদের আমাদের শরীরের চামড়ারই একটি সম্প্রসারিত অংশ। চামড়ার নীচে ডুবে থাকা লোমকূপের গভীরে যারা নিরন্তরভাবে তৈরী হতে থাকে – লোমকূপের গোড়া থেকে জন্ম নেয়া কোষগুলোই মৃত সুসজ্জিত হয়ে তৈরী করে চুল। এই চুলের মূলেও থাকে আমাদের সবার নিজস্ব একটি অনন্য শনাক্তকারী ডিএনএ – শিল্পীরও আত্মপরিচয় – শিল্পী আমাদের জানান এই আত্মপরিচয়টাকে তিনি চেয়েছেন তার শিল্পকর্মে জায়গা করে দেবার জন্য। আঙ্গুলের ছাপ আর চুলের ব্যবহার তার সতন্ত্র সত্ত্বারও প্রতীক। পরিচিত সম্পর্কগুলোয় ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব কখনোই কমাতে পারেননি তিন – বিচ্ছিন্ন একটি জীবনে সেই উদ্বাসনের যন্ত্রণাকে ভুলতে নিজের শরীরের অংশ দিয়ে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন তার শিল্পকর্ম। সেই শূন্যস্থানটাকে পূর্ণ করার চেষ্টাই তার শিল্পকর্ম। আবারো নতুন করে নিজের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টা এই বিশাল বিশ্বে- সেই পার্চমেন্টের প্যালিমসেস্ট এর মত যেখানে পুরোনো সব লেখা মুছে আবারো নতুন করে লেখা হয় নতুন শব্দমালা।
২০১২ সালে নিজের চুল দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন একটি বিশাল চাদর, সেলাই করেছেন বেশ কিছু শিশুদের পরনের জামা। প্রদর্শিত কাজটি শিল্পীর সেই সৃষ্টিরই ধারাবাহিকতা। এবারে তিনি কাজটি করেছেন একটি সাদা থান শাড়ীর উপর । শিল্পীর খুব প্রিয় একটি পরিচ্ছদ শাড়ি, যখন সাধারণ পরিস্থিতিতে শাড়ি পরা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে তখনও তার নিয়মিত পোষাক ছিল শাড়ি –সেলাইশূন্য যে কাপড়ের পরিসর তার কাছে প্রবাহিত নদী কিংবা দীর্ঘ চুলের মতই অর্থবহ। দেশ ছাড়ার পর শাড়ি পরার সেই সুযোগটাকে তিনি স্মৃতিবেদনার অংশ করে নিয়েছেন – জীবন থেকে হারানো জিনিসের তালিকায় এখন যার জায়গা। সেই ধারণার উপর ভিত্তি করে এই প্রদর্শনীর কাজটি ছিল একটি শাড়ী। যারা সারা জমিন জুড়ে শিল্পী তার মাথার চুল দিয়ে সেলাই করেছেন। শিল্পীর কাছ থেকেই জানা যায় এই সেলাই করা তার জন্য অনেকটাই ধ্যান করার মত। কাপড়ের সুতোর বুননের মধ্যেই তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলে হেলান দেয় সুঁচ তার নিজের অনমনীয় নমনীয়তার সাথে তার পথ খুঁজে নেয়, টেনে নিয়ে যায় শিল্পীর চুল – শিল্পীর মনোজগতের সব অভিব্যক্তিকে সে প্রতীকের রুপ দেয় কাপড়ের জমিনে। শাড়ীর সুতোর বুনোটের গোলকধাঁধায় সুঁচ যেন শিল্পীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে
মাস্কড মেমোরি, ২০১৭, কাগজে কালি ও শিল্পীর আঙ্গুলের ছাপ, ৫৯.৫ বাই ৬৮ ইঞ্চি
যায় অস্থির এক প্রশান্তির প্রতিজ্ঞা সহ। যেন কেউ সাঁতার কাটছে ঢেউয়ে উত্তাল নিরন্তর উৎস থেকে গন্তব্যে ছুটে চলা কোন নদীর বুকে। যেখানে কোন কিছু চলতে চাইলে থেমে থাকতে পারেনা। ছুটে চলতে হয় প্রবাহের সাথে। নতুন কোন গন্তব্যে – যেমন শিল্পী নিজেকে জন্ম দিয়েছের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে।
তার কাজের নিকটে এসে দাড়ালে দেখা সম্ভব শিল্পীর চুলের সুতোয় তোলা ঢেউ এর বঙ্কিম রেখাগুলো। যে রেখাগুলো আমরা যখন অনুসরণ করি শিল্পীর নদীটিকে আমরা অনুভব করি, যা জীবনের মতই নিরন্তর প্রবাহমান। যেমন তার ‘হোয়েরেভার দ্য গ্লিম্পস অব এ ফ্রি স্পিরিট এক্সিস্ট, দ্যাট উইল বি মাই হোম’ স্থাপনা শিল্পটিতে আমরা শাড়ি ছাড়াও পেটিকোট আর ব্লাউজ দেখি। চুল দিয়ে সেলাই করা এই শাড়ীর এই অনুসঙ্গ সাদা কাপড়েই সৃষ্টি করা একটি পেটিকোট এবং ব্লাউজ। খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো, চুলের সেই সেলাইগুলো নানা ভাঁজে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে – স্থাপনায় তারা যেভাবে সাজানো, মনে হতে পারে কেউ যেন এখনই বিছিয়ে রেখেছে হয়তো পরার পর কিংবা এখনই কেউ সেগুলো তুলে নেবে পরিধানের জন্য। তার একটি কাজ, ভাঁজ করে রাখা ব্লাউজটির পেছনে আমরা চুলের সেলাই দিয়ে করা একটি গোলাপের নকশা দেখতে পাই। গোলাপের খুব পরিচিত রুপ যা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে। এই ফুলটি শুধু ব্যতিক্রম ঢেউ এর মত সরল রৈখিক বাকী সেলাইয়ের প্রেক্ষাপটে – আমাদের কাছে এই আটপৌরে সাদা পরিচ্ছদে যখনই মনে হবে এই গোলাপটির উপস্থিতি কেন – আমরা অনুভব করতে পারবো এটি যে কোন বঞ্চনা আর দুর্ভোগের মুখোমুখি এটি সুন্দরের উদ্ধত উপস্থিতি – বৈরী পরিস্থিতির অতিক্রান্ত হলে আবারো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসার সেই স্থিতিস্থাপকতা যা আমাদের বদ্বীপকে এখনও জনশূন্য করে দেয়নি। সেই স্বপ্নময় আশা নিয়ে বেঁচে থাকা – শিল্পীর কাছে যে স্বপ্নময় আশা শিল্পকলা, গোলাপের মতই যে তার সুন্দরকে চিরআরাধ্য করে রেখেছে।
তার কাজে সর্বব্যপী সাদা রঙ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এটি বিসর্জনের রঙ – কোনো কিছু হারাবার রঙ – একই সাথে রঙটি পরিশুদ্ধতার- আশারও। নতুন করে কিছু শুরু করারও – যার সাথে যুক্ত হওয়া লাল রঙ উৎসব আর নতুন বছরের সূচনার চিরন্তন প্রতীক আমাদের সংস্কৃতিতে। শিল্পীর কাছে সাদা জমিন কাগজেরও মত, চুলের কালো রেখা যেখানে কোন মহাকাব্যের পংক্তির মত, শিল্পীকে তার কবি সত্তার কথা মনে করিয়ে দেয়, কাগজে ড্রইং এর রেখার বিরামে যে শব্দগুলো তার নিজের জীবনের কথা বলে অপ্রস্তুত করে দেয়ার মত সততায়। শিল্পীর মুক্ত আত্মার মত – ঠিকানা বিহীন পরিশুদ্ধ যে আত্মা অদম্য আশায় – নতুন সূচনায়। বহু মহাদেশ পেরিয়ে – বহু দেশকে আপন করে নিলেও শিল্পীর শিকড়কে আমরা অনুভব করি বাংলাদেশের পলিমাটিতে – পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম যে বদ্বীপে – অসংখ্য নদী যেখানে শিল্পীর শাড়ির জমিনের তোলা চুলের নকশার মত তাদের পথ খুঁজে নিয়েছে মানুষ তাদের জীবনের অংশ করে নেবার বহু হাজার বছর আগেই। মহাকাব্য আর কিংবদন্তীর চরিত্র তারা, সময়ের সীমানায় যারা বন্দী নয় কখনোই । আর এটাই শিল্পীর আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব – যে পরিচয় তাকে সাহসী করেছে আর শক্তি যুগিয়েছে একজন শিল্পী আর মুক্তমনের মানুষ হিসাবে নিজের নিয়তি পুনর্লিখনে।
কষ্টের পেয়ালা পূর্ণ আজ আমার
পূর্ণিমার চাঁদের মতো ভরপুর
সক্রেটিসের হেমলকের পাত্র থেকেও বিষাক্ত
বুঝি সে সুরা, সাকিও অনেক নিষ্ঠুর,
বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী হয়ে যায় নাকি দুঃশাসনের ?
তাই -কুন্তলার কেশের চাইতেও
দীর্ঘ আমার অভিশপ্ত মহাভারত
কুঁকড়ে যাই আর যেতে যেতে …
ভাবি আমি তবু অনুতপ্ত নই !
(হেমলকের পাত্র – আসমা সুলতানা)
একক প্রদর্শনীত, ২০১৭, গ্যালারী৫০, টরোন্টো, কানাডা