কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘বিদ্রোহী’। এই কবিতাটি কেবল নজরুলেরই নয়, বাংলা সাহিত্যেরই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রোহের কবিতা। যদি ‘দ্রোহের কবিতা’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ নাও করি, তথাপি এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যেরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে অনায়াসে স্থান পাবে। বিদ্রোহী কবিতাটি ছাড়াও নজরুল দ্রোহের কবিতা লিখেছেন আরও অনেক। সম্ভবত বাংলা ভাষায় দ্রোহের কবিতা নজরুলেরই সর্বাধিক। ফলে, তাঁর নামের সাথে এই খেতাব জুড়ে গেছে – বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

অথচ নজরুল আমাদের কাছে কেবলই বিদ্রোহের কবি, বিদ্রোহী কবি।
নজরুল যে কেবল সমসাময়িককালে গণচেতনার ডাকে সাড়া দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসকের বিপক্ষেই লড়েছেন, তা নয়। তাঁকে লড়তে হয়েছে তাঁর নিজ ক্ষেত্র – সাহিত্যাঙ্গনেও। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার শুরু যদি মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে হয়ে থাকে, তবে তাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এমন এক জ্যোতিষ্ক, যার তাপচ্ছটায় ম্লান হয়ে যেতেন অন্য সব কবি-সাহিত্যিক। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ রজনীকান্তরা তো সরাসরিই তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে সেই ধারাতেই লিখে গেছেন, কোনও বেগড়বাঁই করেননি। জীবনানন্দ তা না করে সমকালে পাত্তা পাননি। একাধিকবার রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের কবিতা পাঠিয়েছেন সমর্থন কিংবা প্রশংসার আশায়। তেমন উদারতা রবি বাবু দেখাতে পারেননি। বড় মানুষের ছোট মনের পরিচয় পেয়ে জীবনানন্দ দুঃখ পেয়েছেন, মেনে নিয়েছেন, কিন্তু আপোষ করেননি, নিজের লেখনী বদলাননি। কিন্তু নজরুল শুরু থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা। কলম হাতে উঠে আসলে আর কারো পরোয়া করেননি। কিছুটা হাস্যকর হলেও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় একটা উদাহরণ টানা যায় সাম্প্রতিক একটা ঘটনা থেকে। বলিউডের এক সময়ের দুই প্রতাপশালী নায়ক অমিতাভ ও মিঠুনকে নিয়ে একটা সুক্ষ তুলনা তাদের পিক-টাইমে চলতো – কে বেশি জনপ্রিয়? কে ভালো অভিনেতা? ইত্যাদি ইত্যাদি। তো, এই প্রশ্নটাই সম্প্রতি একটি টিভি অনুষ্ঠানে করা হলো মিঠুনকে। তিনি বললেন, যদি আমাকে সিনেমার একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে ধরে নাও, আমি অবশ্যই অমিতাভকে বেছে নেবো। কিন্তু যদি আমাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দাও, অমিতাভ কেন, পৃথিবীর কাউকে আমার সমকক্ষ মানবো না। … এই কথাটা নজরুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খুবই প্রকটভাবে প্রযোজ্য। সাহিত্যের পাঠক অনুরাগী হিসেবে আর সব বাঙালীর মতো নজরুলেরও প্রিয় হয়তো কাজী’র চেয়ে ঠাকুরই বেশি। কিন্তু যখন তিনি লেখক, তখন তাঁর ধারেকাছে আর কাউকে তিনি ঘেঁষতে দেননি কখনো। তাই শুরু থেকেই লিখে গেছেন নিজের স্টাইলে; লেখায় নিজস্ব ক্রাফটিং, নিজস্ব ভাষার চলন, ছন্দ-উপমা-অলংকার ছড়িয়ে দিয়েছেন মণিমুক্তার মতো। ভাবুন দেখি – ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল উয়োহি মেরা ফাঁস গ্যায়ি’ – এই লাইন কোনওদিন কি রবীন্দ্রনাথ, ডিএল রায়, অতুল প্রসাদরা লিখবেন? বাংলার সাথে উর্দুর এমন মিক্সআপ! সাহিত্য কোথায় যাচ্ছে!! এই ছোঁড়া পেয়েছেটা কী? বাংলা ভাষার এমন দৈন্য এসেছে যে, তার ভাব প্রকাশ করতে হবে উর্দু শায়েরি দিয়ে? আবার ধরুন – ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা…’ লিখছেন যিনি, তিনিই লিখছেন ‘আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ’। এ তো দুধেও আছে, তামাকেও আছে! এ হলো, আমজনতার সেন্টিমেন্ট ধরে ধরে গান-কবিতা লিখা। না হে, এভাবে তো তুমি সাহিত্যের বনেদীয়ানায় ঠাঁই পাবে না। সাহিত্য আমজনতার জন্য নয়। সাহিত্য পথেঘাটে গামছা পেতে আড্ডাবাজি করা হেঁটো লোকের আলোচনার বিষয় নয়। সাহিত্য হলো সফিস্টিকেটেড বিষয়, একটা ডিগনিফাইড ব্যাপার। এটা এলিটদের এজেন্ডা, একে এভাবে অকূলে ভাসিয়ে দেয়ার এখতিয়ার তোমায় কে দিয়েছে হে ছোকরা? পারো তো তেমন গান করে দেখাও। মার্গসংগীত বলে যাকে। একেবারে উচ্চাঙ্গের কলা। … তা, নজরুলের ভাণ্ডার তো এত ছোট নয়। বরং সবাই যতটা ধারণা করতে পারে, তার চেয়েও বহু বহুগুণ সমৃদ্ধ। ফলে তিনি সেই উচ্চাঙ্গের কলাও একের পর এক সৃষ্টি করে যেতে লাগলেন। ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী-ভিখারি …’ – এমন গান শুনে স্বয়ং বোদ্ধারাই ভড়কে গেলেন! কিন্তু নজরুল থেমে থাকলেন না সেখানেই। একের পর এক রাগপ্রধান গান সৃষ্টি করতে করতে নতুন কতগুলো রাগেরই সৃষ্টি করে দিলেন তিনি।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, নজরুল স্থিতধী ছিলেন না। স্থির হয়ে বসেননি তিনি কোথাও। ছন্নছাড়া জীবনের মতো তাঁর সৃষ্টিও ছন্নছাড়া। এই তিনি কবিতা লিখছেন তো এই গানে চলে যাচ্ছেন। আবার সব ছেড়েছুড়ে পত্রিকা সম্পাদনায় নেমে পড়ছেন। তা করতে গিয়ে কারাবন্দী হয়ে যাচ্ছেন। বেরিয়ে এসে আবার আস্তানা গাড়ছেন গ্রামোফোন কোম্পানীর স্টুডিওতে। হিন্দুস্থানী রাগ নিয়ে কাজ করতে করতেই পারসিয়ান সুরে কাওয়ালী গেয়ে ফেলছেন। শ্যামাসঙ্গীত করতে করতেই হামদ-নাতে ঝুঁকে পড়ছেন। এত বিচিত্র প্রতিভা আর তার এত ব্যাপক প্রকাশ – সাহিত্যের এলিট-বাবুরা তল পান না তাঁর। ফলে, তাঁরা একটা শর্টকাট বেছে নেন তাঁকে অপাংক্তেয় করে দিতে – উনি তো বিদ্রোহী কবি, বিদ্রোহ আর লাঠালাঠি নিয়েই মেতে আছেন। স্থির হয়ে বসবেন কবে যে, অমর সাহিত্য সৃষ্টি করবেন? ‘আমার কৈফিয়ত’ – এই এক কবিতাতেই তার বিশদ জবাব দিয়ে দিয়েছেন নজরুল। সাহিত্যের ‘হল অব ফেম’-এ তাঁকে স্থান না দেয়ার পেছনে সমালোচকদের নানান অযুহাতের বিশদ বর্ণনা এই কবিতার ছত্রে ছত্রে লিখেছেন কবি। তা নিয়ে তাঁর আক্ষেপও যে কম ছিলো না, সে কথাও কৈফিয়ত আকারে লিখেছেন তিনি। ‘আক্ষেপ নেই’ বলাটাই যে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ – এ কথা কে না বোঝে?
“কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি শুধু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!’
এই অংশে, রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনা দিয়ে তাঁর অমর কাব্য লিখতে না পারার দরুণ সমালোচকদের খোঁটার কথা স্পষ্ট করেই লিখেছেন নজরুল। আর উপসংহারে নিজের কৈফিয়তটা লিখেছেন এভাবে,
‘বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছ সুখে
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’
তো, যে কথা বলছিলাম। নজরুলকে বিদ্রোহের কবি কিংবা বিদ্রোহী কবি বলে সম্বোধন করাটা একটা সময় পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু আমি মনে করি, এই সম্বোধন বরং তাঁকে শ্রেণিবদ্ধ করে ফেলে, তাঁকে কিছুটা অবজ্ঞাও করা হয় এই খেতাব দিয়ে। খানিকটা উপহাসও কি নয়? আমি তাই তাঁকে কখনোই বিদ্রোহী কবি বলি না। বিদ্রোহীর মতো মাস্টারপিস তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে লেখা সম্ভব ছিলো না জেনেও আমি তাঁকে বিদ্রোহী’র কবি কিংবা বিদ্রোহী কবি বলতে চাই না। আমার কাছে তিনি মানবতার কবি, সাম্যের কবি, সবহারাদের কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহেরও কবি, তিনি আপামর সহজিয়া বাঙালির কবি। তিনি বাংলার কবি। তিনি বিশ্বকবি নন বটে, বরং একশোভাগ দেশজ কবি, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়েই দেখা যায় গোটা বিশ্ব। তাই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাঙালী যেমন পৃথিবীর বুকে একটি এলিট সম্প্রদায় নয় বরং সফিস্টিকেটেড জাতি, বাংলাদেশের মানুষ যেমন মূলত সহজিয়া মতাদর্শের সাধারণ মানুষ, আমাদের জাতীয় কবিও তেমনি একজন সহজ-সরল, মাটিতে পা রাখা, মানুষ-ঘেষা, স্বভাব-আমুদে অথচ চিরদুঃখী একজন কবি, যিনি নিজের ভেতর ধারণ করেছেন একাই একটি বিশ্ব! কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে বেছে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বরং এই জাতিকেই সম্মানিত করেছেন, মহিমান্বিত করেছেন।
পুনশ্চ: ১১ই জ্যৈষ্ঠ বা ১২ই ভাদ্র কিংবা ২৪ মে বা ২৯ আগস্ট এগুলো শুধুই ক’টা তারিখ। বলা যেতে পারে, বুকমার্ক বড়জোর। চলতে চলতে হঠাৎ একটু জিরিয়ে নেয়া আরকি। নচেৎ, তিনি তো মহাকালের, তিনি অনন্তের। তিনি হলেন শক্তির মতো। শক্তির যেমন সৃষ্টি ও লয় নেই, আছে কেবলই রূপান্তর, নজরুলেরও তেমনি জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু নেই। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অসম্ভব পরাক্রমশালী শক্তি। সেই শক্তির বড়জোর রূপান্তর হয়েছিলো আজকের দিনে, এর বেশি কিছু নয়। নজরুলের মৃত্যু নেই।
গুঞ্জন রহমান : গীতিকার, লেখক। ঢাকা, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত গ্রন্থ- প্রবন্ধ সংকলন: আলো যায় রাত্রি আসে, গল্পগ্রন্থ: কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
কাব্যগ্রন্থ: সামরিক প্রটোকল
আত্মজৈবনিক: মহিমাগঞ্জ
প্রবন্ধ সংকলন: বাবা – একলা পুরুষ কর্তব্যে (ইবুক)
কাব্যগ্রন্থ: দুঃখ পেয়ো না (ইবুক)
প্রবন্ধ সংকলন: ছুটির দিনের কথামালা (যন্ত্রস্থ)
উপন্যাস: ত্রিস্রোতা (প্রকাশিতব্য) ।