আমার কোন গোত্র নেই। সহপাঠী বন্ধু নেই। আমি সবার সঙ্গে চলি, অকপট মিশি, হুল্লোড় করি। আমার ভাব ভালবাসার আলাদা কোনো নিক্তি নেই। যখন যেখানে, সেখানেই সহকর্মী, সহযোদ্ধা; সেখানেই স্বজন, মেশামিশি, যাপন। চায়ের আড্ডায় পুরনো নতুন বুঝি না। সময় বুঝি, মানুষ বুঝি। আমি মন্দ কিংবা ভালো, কুট কিংবা জটিল- জানি না। একবার যাকে চোখে ধরে, মনে পড়ে- প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, আড়ালে আবডালে পুষি, ভুলি না।
কিছু মানুষ, সময়, গল্প- আমি মনে রাখি না, ভুলে যাই। ভেতরের পাপ-পঙ্কিলতা, কালো বেড়ালের মতো ভয়ঙ্কর মুখ বেরিয়ে এলে, আমি টানি না। সম্পর্ককে তার উৎসমুখে রেখে পথ ধরি নিজের মতো। আমার পথ, পছন্দ, রেখার টান- দীর্ঘ, ঋজু, সাহসী। আমার অনেক গল্প, গল্পের মানুষ। মুখড় আড্ডায় আমি নিত্য নতুন গল্প বুনি।
চোখ ও মনের ভাষা এক। যে বর্ণমালায় লিখা উচ্ছ্বাস, আবেগ-অনুরাগ, তার সুর ছন্দ তাল এক সুতোয় বাঁধা। আমি লিখি, গান করি, কবিতা পড়ি- আমার পছন্দে, সুরে, তালে। যেটুকু শ্বাস আনন্দ দেয়, ফুসফুসে শক্তি জোগায়, আমি তার মধ্যেই ঘুরিফিরি, নাচি, চিৎকার করি। আমি মুক্ত বাতাসে নির্মল হাসি মেখে রোজ লুটিয়ে পড়ি আকাশে উড়িয়ে দেই সুন্দর সুষমা।
আমি দীর্ঘপথ সময় ঘটনা, অপেক্ষা করি, যাপন করি। বুঝি-বোঝাই। অঙ্ক কষি না। শৈশবের বটতলায় সুর করে মুখস্থ নামতার মতো মানুষকে ভালবাসি, কাছে টানি। সময় ব্যক্তি ঘটনা- আমার অভিব্যক্তি বদলায় না, প্রকাশ বদলে যায় না। আমি আমিই থাকি, যেমনটি দেখায় তেমনই। আমার আস্তিন গোটানো লিকলিকে শরীরের কাছে, সব তুচ্ছ, সব। শহর শব্দ অভাব, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি নস্যির মতো।
রঙ রূপ নিয়ে আমার কোন ভীতি নেই, শঙ্কা নেই। পুরনো তেল বা জলরং ঝকঝকে তকতকে করতে আমি আদল মুছি না, নাড়া দেই না। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়লো কি না, তাতে কিছুই যায় আসে না আমার। আমি কখনো কিছু পেতে কোনোকিছুর বদল করি না। চায়ের কাপে যে মুখ, টেবিলের আড্ডায় যে ছায়া, সকাল দুপুর রাত- একই, একইভাবে দেখি, অনুভব করি। অনুভুতি শক্তি নিয়ে আমার কখনো কোনো দুর্বলতা নেই, দোলাচল নেই।
আমি শ্বাস বুঝি, তাকানো বুঝি। ছোট করে, অল্প শব্দে, কুয়াশার মতো অস্পষ্ট বাক্য বুঝি না। গল্পের মাঝে, কুটবাক্যজালে আমি ঢুকতে পারি না। বোকার মতো মুখ নিয়ে শুণ্য চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। রঙ মুছে বেরিয়ে আসা ফ্যাকাসে মুখ দেখি। করুনা করি না। ভালবাসি। ভালবাসতে আমার ভীষন ভালোলাগে।
আমার পছন্দ অপছন্দ আছে। আমি ভীতু বা দুর্বল নই। যা পারি না, তাতে সাহস করি না। যা সাহস করি, তা-ই পারি। আমার ভেদ-বুদ্ধি-বিবেচনা, অতটা প্রকাশ্য নয়, যতটা হলে বাজিগরের মতো মুহুর্তেই জুটে যায় হাততালি। আমার ব্যক্তি অভিধা বা ঝুলিতে চোখ ধাঁধানো কিছু নেই। আমার লিখিত কোন অর্জন নেই, পাদপীঠ নেই। আমি একা, একান্তই আমার। ভালবাসি। লোকে ভালবাসে। যে স্বজনেরা আদর করে বুকে টেনে নেয়, পিঠে মাথায় হাত বুলায়, আমি তাদের সবটুকু দেই। দুঃখ পেলে, যাতন পেলে, চলে আসি, সরে যাই, দুরে, বহুদুরে। আমি অভিশাপ দেই না। আমার পছন্দের ভেলা ভাসায় কষ্টে খনন করা জল-গহ্বরে।
আমার ঘৃনা আছে; লজ্জা অনুশোচনা আছে। ছায়াহীন মানুষ, গতর ছাড়া মানুষকে আমি ঘৃনা করি। যে মানুষের ভেতর বৃক্ষ নেই, যার শরীর থেকে গজায় না চারা, নেমে আসে না ঝুরি, যার বেদীতলে ঘুমোয় না মানুষ, এমন শরীরসর্বস্ব মানুষের জন্য আমার অনুশোচনা হয়, লজ্জা হয়। আমি অনুতপ্ত হই। ক্ষমা করি। আমি পেছন ফিরি না। ফেলে আসা ছায়া রাখি না। নতুন দিন গান মানুষে ঘর বাঁধি। ভুল মানুষের জন্য আমার কোন বিলাস নেই, অনুশোচনা নেই।
আমি জলের ভেতর আগুন জ্বালি, জ্বলি। আমি আনন্দে আগুন জলে ভাসিয়ে দেই আমার বাসনা। আমি আমারই মতো মানুষের স্বপ্ন দেখি, গল্প বুনি। আমি রোজ স্নান করি, আমারই বুকের ভেতর জমে রাখা মেঘজলে।
(৫ জানুয়ারি জন্মদিনে যারা আমাকে মনে রেখেছেন, তাদের)
৩০ জানুয়ারি ২০২০ সাল,
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা