
গতকাল দুপুর ১২টা ৫০মিনিটে ওয়েরিবি মার্সি হাসপাতালের করিডোর একের পর এক পেরোই। অবশেষে সবুজ-লাল-হলুদ ছাড়িয়ে শুধু নীল লাইনের ফলোইং-এ পৌঁছোই। মনে পড়ে গেলো অনেক চেকিং(করোনার কারণে কড়াকড়ি’র চেকিং), অনেক ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে রিসিপশনিস্ট বলে দিয়েছিলেন ‘.. এভাবে এভাবে গিয়ে, শেষে সব রঙ ফেলে শুধু নীল রঙের লাইনটি পাবে। আর তা ফলো করেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে পৌঁছে যাবে।‘ আমার অবশ্য তার ইন্সট্রাকশন ফলো না করলেও চলতো। আমার সাথে রণজিৎদা ছিলেন, শুভ্রাদির হাসব্যান্ড। ঐটুকু পথ; তবু কি দীর্ঘ! পুরোটা পথ মাথা খারাপের মতো লাগছিলো। প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে যাবার পথটি ‘নীল’ কেন?
নীল কি শান্তি’র রঙ নয়? নাকি শুধু অসহ্য বেদনার অর্থই বোঝায়? আপ্রাণ ভাবতে চেষ্টা করি – ‘শান্তি’ কিংবা ‘ছিমছাম সুখ‘ এর রঙও তো নীল! হঠাৎ শুনি রঞ্জিৎদা বিষাদ কণ্ঠে বলছেন,এসে গিয়েছি। মনে হলো সামনে কোনো দরজা নয়, রয়েছে প্রচণ্ড ভয়! আমার আতংকিত মন ভাবে, কেমন দেখবো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সদা হাস্যময়ী আমার শুভ্রাদিকে?

ঝাপসা চোখে দেখতে থাকি! কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলি, “দিদি এসেছি। এই বৃহস্পতিবারেই না, ফোনে বলেছিলেন আর একবার দেখা হলে ভালো হতো! …আমি দেখা করতে এসেছি! তাকাবেন না? কালও এসেছিলাম। জানেন, দেখা হয়নি!” এতো কথা শুনেও চোখ মেলে তাকালেন না! দূরের একটি সোফায় বসে ছিলেন শুভ্রাদি’র ছোট বৌদি। বললেন, ‘আপনি বা আমি ডাকলে হবে না। মরফিনের কড়া ডোজের উপরেই তো রয়েছে! গত দুদিন ধরে কেবল রঞ্জিতদা ডাকলেই সাড়া দিচ্ছে।’ সাথে সাথেই রঞ্জিৎদা শুভ্রাদির খুব কাছে গিয়ে মিষ্টি করে বললেন, শুভ্রা দ্যাখো, কে এসেছে! তাকাও শুভ্রা। তোমার একজন প্রিয় মানুষ এসেছেন… এই শুভ্রা, বলো তো কে এসেছেন? আমাকে অবাক করে দিয়ে শুভ্রাদি ধীরে ধীরে চোখ মেললেন। আরো অবাক করে আস্তে আস্তে বললেন “নৌ … নৌ আপু এসেছে!” বলেই আবার চোখ বুজলেন।
দাদা, রুমের বাইরে যাবার সময় ভারী কণ্ঠে বলে গেলেন “ভাবী বসেন… ওকে যা যা বলতে চান, বলেন! ও কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছে। বুঝতেও পারছে। শুধু কড়া ডোজের ওষুধের কারণে কথা বলতে পারছে না।” আমি শুভ্রাদি’র শ্বেত শুভ্র হাতটা ধরে বসে থাকি।

কত কথা মনে পড়ে যায়! সেই পরিচয়ের শুরুর দিককার কতকিছু। মনে পড়ে লাস্ট দুবছরের ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের সবকিছু। শেষের দিকে অনেক অনেক কথা হতো ফোনে। এগ্রেসিভ ক্যান্সার সেকেন্ড টাইম ব্যাক করায়, লাস্ট ৪ মাস বাসা-হাসপাতাল-বাসা’র বাইরে কোথাও যেতেন না। নিয়মিত ফোন করতেন। আমিও করতাম। তবে তুলনামূলকভাবে আমার একটু কমই ফোন করা হতো। উনি মাইন্ড করতেন না। উনি জানতেন, আমার ফোন-এলার্জি’র কথা। শুধু বেশি গ্যাপ দিয়ে ফেললে মেসেজ লিখে খোঁজ নিতেন “নৌ আপু, কেমন আছো? ঠিক আছো তো?” …চোখে স্রোতের মতো পানি আসে, এই মেসেজ কি তবে আর কোনোদিন পাবো না ?
কি মনে হলো, হঠাৎ আবার দাঁড়িয়ে যাই। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। আর ফোনে যে কথা উনি জানতে চেয়েছিলেন সেটাই বারবার বলতে থাকি, “দিদি, আমার সাধ্যমতো রুদ্রানী-সুতানতুকে আমি দেখে রাখবো। আমরা সবাই আপনার প্রানপ্রিয় বাচ্চাদের পাশে থাকবো!” মা তো। মরফিনের তীব্র ঘোরের মাঝেও দেখি তাঁর চোখের কোণে জল। শরীর নিথর। কঠিন কষ্টের মাঝে চলছে প্রতিটা শ্বাস গ্রহণ। এর মাঝেও রুদ্ধ চোখে কান্নার জল! আশ্চর্য!
চোখ মুছে দেই। নিজেরটাও মুছে নেই।
দিদির বেডের সামনে বিরাট এক জানালা। বাইরে ঘন সবুজ মাঠ। এপাশে ওপাশে গুচ্ছ কিছু ঝোপ। হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে একটা বেশ বড়সড়ো খরগোশ মাঝ মাঠে দৌঁড়ে এলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে পিছু পিছু এলো একটা বাচ্চা খরগোশও। সবুজ মাঠে খুঁজে খুঁজে কি যেন খাচ্ছে মা-মেয়ে কিংবা মা-ছেলে। আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে কি যেন দেখছেও! ..আহ, কি সুন্দর জীবনের গল্প! প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটের জানালার বাইরে। অথচ একটু ভেতরেই গল্পটা অন্য! ভয়ঙ্কর ভিন্নতায় জীর্ণশীর্ণ।
প্রায় তিন ঘন্টা পেরিয়ে যায় এর মাঝেই। আরো প্রিয়জন রয়েছেন দিদির অপেক্ষায়। একনজর দেখে শেষ বিদায় টুকু জানানো, সান্ত্বনা ওটুকুই। আমাকে উঠতে হয়। চলে আসার সময় বর্ষা আপুও ছিলেন। বিদায় নিই দুইজন একসাথে। আপু দেখালেন, দিদির চোখে জল।
এতো কষ্ট … এতো কষ্ট এমন দেখা হওয়ায়! যদিও অসাক্ষাতের আক্ষেপটি আর রইলো না! আমাকে ফোনে জানানো উনার ইচ্ছেটুকুও পূরণ হলো! তবুও ..
গত পরশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখা করতে দেয়নি শুনে, ইউসুফভাই (ভিবিসিএফ এর প্রেসিডেন্ট) জোর চেষ্টা চালিয়ে এই দেখা করার ব্যবস্থাটি করে দিয়েছিলেন। উনার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
বাসায় ফিরে আবার খুব কেমন যেন লাগছিলো। আর একবার কি দেখা হবে? শুধু আর একটাবার! আরো কিছু যে বলার ছিল। উনার প্রতি আমার নিবিড় ভালোবাসার গল্পটুকুই যে ‘না বলা’ রয়ে গেলো! উনার অদম্য মানসিকতা কতজনের কত ক্ষতের মলম ছিল। তা কি তবে উনার অজানাই থাকলো? আমাদের কতজনের কত কৃতজ্ঞতা উনার কাছে, তা কি তিনি না জেনেই চলে যাবেন? একবার যদি বলতে পারতাম, দিদি, আমাদের বাচ্চারা ভবিষ্যতে যখনই গেয়ে উঠবে ‘কেউবা বলে ধানের দেশ, কেউবা বলে গানের দেশ, আমরা বলি প্রাণের দেশ বাংলাদেশ’; আমরা তখনি চোখবুজে এক লহমায় দেখতে পাবো আপনাকে! আরো একবার বুঝতে পারবো কেমন করে প্রাণ দিয়ে বাচ্চাদেরকে কেউ গান শেখাতে পারেন।
আমরা অনেকগুলো মানুষ যে কি ভীষণভাবে ‘একটি মাত্র মিরাকল’ চেয়েছি খোদার কাছে, তা কি শুভ্রাদি জানবেন না? নাহ আর পারছি না। রাতেই ঠিক করে ফেললাম সকালে আরেকবার যাবো। আরেকবার দেখবো। উনাকে সব বলবো! সব!! কিন্তু রহস্যময় জগতের ‘ঠিক করে রাখা গল্প’টি যে সবসময় আমাদের ভাবনা’র চেয়ে অন্য, তা কি করে জানবো?
অসম্ভবের সম্ভাবনায়, সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোরের দিকে কখন যেন একটু ঘুম মতো এলো। সকালে একটি ফোন আসলো। তড়িঘড়ি উঠলাম। ঘুম ভেঙে খবর পেলাম, শুভ্রাদি আর নেই ! আমরা অনেকেই আসলে একযোগে ভুলে গিয়েছিলাম, মিরাকলের প্রাপ্তি ঘটে গল্প বা উপন্যাসেই।
আমাদের ভীষণভাবে চাওয়া সেই ‘একটা মাত্র মিরাকল’ আমরা পাইনি!
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।