গণহারে উচ্চশিক্ষা, কেতাদস্তুর সাহেবি চাকরি ও ভাতের বিনিময়ে টিউশনি । মিতা চৌধুরী

  
    

বাংলাদেশে ও আমাদের ভারতবর্ষে পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে যে কিছু ধারণা আমাদের মজ্জায় গেঁথে গিয়েছে তার অন্যতম হলো সাহেবিপনা। আর এই সাহেবিপনার অন্যতম প্রধান প্রকাশ হলো আমাদের সন্তানদের প্রত্যেককে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে নইলে একটা ভালো সরকারি চাকরি করতে হবে। সেই ইংরেজ আমল থেকেই এর চল, যখন দেশীয় বাবুরা কেতাদস্তুর ভাব নিয়ে ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতো। যারা সফল হতো স্বাভাবিক কারণেই তাদের জীবনের চেহারাও পাল্টে যেত, তারা ইংরেজ সাহেবদের কাছের লোক হতে পারতো। জীবনের এই চেহারা বদল স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রচন্ড প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করলো উঠতি শিক্ষিত লোকের মাঝে, সৃষ্টি করলো একটা প্রকট শ্রেণী বৈষম্যের উপস্থিতি। যে ইংরেজি পারে না বা জানে না সে ছোটোলোক, খেত ও অচলমাল! বলাই বাহুল্য, এটা যেমন সেই কলোনিয়াল সময়ে ছিল, ঠিক তেমনি এটা এখনো আমাদের সকলের বিশ্বাসে আছে !

সেই দেশীয় বাবুরা যারা ইংরেজিতে কাতাদস্তুর হলো, সাহেবি কায়দায় চলা শিখলো বা সাহেব হওয়ার যে প্রচন্ড এক চেষ্টা তাদের সেই মনোজগৎটাই পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে এসে আমাদের মাঝে পাকাপাকিভাবে গেঁথে গেলো। যার দরুন, আমরা সবাই চাই আমাদের প্রিতিটি সন্তান  ক্লাসের প্রথম হবে, প্রতিটি ছেলে মেয়ে হয় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা বিরাট সরকারি কর্মকর্তা হবে। ছোটবেলায় যখন ক্লাসে আমার জীবনের লক্ষ্য রচনা লিখতাম তখন শতকরা ৯০ ভাগ ছেলেমেয়েই বলতো সে একজন ডাক্তার হবে নয়তো একজন বড় প্রকৌশলী। বোধকরি এখনের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের জীবনের লক্ষ্য এখনো ঠিক এমনি আছে। এখন, এটা খুবই স্বাভাবিক, যে ছেলে মেয়েটা সেই শৈশব থেকে শুনে আসছে তার চারপাশের সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় আমলা-সচিব হবে তার কাছে অন্য সকল পেশা খুবই মানহানীকর ও অসম্মানজনক। অন্য পেশাকে শ্রদ্ধা করা ও সন্মানসহ দেখার যে মনোজগৎ তা আমাদের এখনো তৈরী’ই হয়নি, এটা আমাদের মজ্জাগত, যা থেকে আমরা আদৌ কোনোদিন বের হতে পারবো কিনা জানিনা।

নিজ জীবন থেকেই কিছু উদাহরণ দেই। আমি তখন চারুকলায় ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করছি, একদিন স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। জানতে চাইলো আমি কোথায় কোথায় ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি, বললাম শুধু চারুকলায় আর কোথাও না। বন্ধু শুনে হেসে শেষ, বললো তুই বটতলার যোগী হবি? আমি রেগে বললাম, হলে তোর কি? আরেকটা ঘটনা বলি, আমি তখন অস্ট্রেলিয়ার ক্রাউন মেলবোর্নে শেফ হিসেবে জব করি। একদিন এক দেশীয় ভদ্রলোক পরিচিত হওয়ার পর জানতে চাইলো আমি কি করি? বললাম আমি ক্রাউন মেলবোর্নে শেফ ডি পার্টি হিসেবে আছি। ভদ্রলোক বললো, “হ্যা, এই দেশেতো আপনাদের অনেক ডিমান্ড, দেশেতো আমরা শেফরে বলি বাবুর্চি”। মনে রাখা ভালো, এই ভদ্রলোকের এই উক্তি কিন্তু নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় না, বরং এটাই আমাদের মজ্জাগত মনোভাব, যা দেশ, কাল বা স্থান কিছুতেই পরিবর্তিত হয় না।

২০০৮ থেকে ২০০১২ পর্যন্ত আমার রেস্টুরেন্টে সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির ফিল্ম মেকিংয়ের এক ছাত্র ডিশ ওয়াশার হিসেবে কাজ করতো নাম হেইডেন। ফিল্ম ম্যাকিংয়ে পড়লেও হেইডেনের মূল আগ্রহ ছিল গানে। সেই হেইডেন এখনো আমার বন্ধু তালিকায় আছে যে এখন অস্ট্রেলিয়ায় বেশ নামি উঠতি শিল্পী। সুদূর মিলাদুর থেকে আরেক ছেলে আরএমএইটিতে ড্রামা এন্ড স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ে পড়তো যে আমার সঙ্গে একই রেস্টুরেন্টে কিচেন হ্যান্ড হিসেবে কাজ করতো। এখানে একটা ছেলেমেয়ে ১৪/১৫ বছর থেকেই কাজ করা শুরু করে, আর সেই ১৪/১৫ বছরের শুরুর কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুবই স্বল্প বেতনে হয় কোনো রেস্টুরেন্টে, বা সুপারশপে বা ফাস্ট ফুডের চেইন স্টোরে। স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো কাজের প্রতি ও সকল পেশার প্রতি তাই সমান সন্মান এখানে প্রতিটা ছেলেমেয়ে ধারণ করে।

পত্রিকা মারফত দেখলাম বগুড়ায় এক যুবক টিউশনি খুঁজছেন ভাতের বিনিময়ে। পত্রিকার মাধ্যমেই জানতে পারলাম ও বুঝতে পারলাম, সে তার মনমতো চাকরি পাচ্ছেনা তাই সেইসব চাকরী তিনি করছেন না, পোষাক শিল্পে উনার চাকরীর অফার ছিল কিন্তু উনি করবেন না। যাইহোক আজ পত্রিকায় দেখলাম ওই যুবকের স্বপ্নে চাকরি হয়েছে। আমি আমার অনেক পরিচিতজন এবং পরিবারের মধ্যেই দেখেছি বিসিএস না হলে অন্য চাকরী করবেন না। বিসিএস দিয়ে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারকে দেখেছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতে, ডাক্তারকে আমলা হতে, কৃষিবিদকে মেজিস্ট্রেট হতে ! তাহলে কথা হলো, কেন সরকারের টাকা খরচ করে এই স্পেসিয়ালিটি সাবজেক্টগুলোতে তাঁরা পড়তে গেলেন? কারণ সরকারি চাকরি হলো সোনার হরিণ ও স্বর্ণের ডিম পারা সেই হাঁস। এই যে সরকারি আমলা হওয়ার সোনার হরিণ বধের চেষ্টা ও প্রতিযোগিতা এর দায় আমাদের সমাজের সবার। কারণ আমরা জানি সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আসলেই নচিকেতার ‘সরকারি কর্মচারী’ গানটার মতোই। এখানে যেমন আছে ক্ষেত্রভেদে উপরি কমানোর বিশাল সুযোগ তেমনি আছে অনেকটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কারণ আমরা দেখেছি দিনের পর দিন অফিসে উপস্থিত না থেকেও দিব্যি সরকারি চাকরী টিকে থাকে। আমরা দেখেছি স্বাস্থ মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভারের টাকার পাহাড়, বন বিভাগের কর্মমচারীর উপচে পরা টাকা, ভূমিমন্ত্রণালয়ের একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীও জৌলস জীবন যাপন করে। সরকারী চাকরিতে কেপিআই নেই, সুতরাং ডাক্তার আমলা হবে, ইঞ্জিনিয়ার মেজিস্ট্রেট হবে এটাই বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্ফোরণ। শুধু যে যেখানে সেখানে প্রাক্তন কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ স্বীকৃতি দিয়েছে তাই নয় বরং যত্রতত্র গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যাদের অনেকেরই অনুমোদন নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার মান কি বেড়েছে? বিশ্বর ১০০০তম বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করলেও সেখানে বাংলাদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায় না অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২টি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আছে ১৬৮৮টি  আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অগণিত যার ১০৩টি মানসম্মত ! বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬৪.৭ মিলিয়নের (২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী) উপরে যার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২১ জন উচ্চশিক্ষা নিয়েছে। আমার বর্তমান বাসভূমি অস্ট্রেলিয়া তাই আমার তুলনাটা আমি এই দুই দেশের মধ্যেই করতে চাই। অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যা ২৫.৬৯ মিলিয়ন (২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী) যার প্রতি ১০০ জন্যে ৩০ জনের কাছাকাছি উচ্চশিক্ষা নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪০টির মতো যার ৬টি টপ ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে আছে।

তুলনাটা দেয়ার চেষ্টা করলাম এই জন্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে বা উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়ে বর্তমান এই সমস্যার সমাধান কোনোদিনই সম্ভব নয়। যেটা জরুরি তা হলো শিক্ষার মান উন্নয়ন ও বিশ্বমানের করা। বছর বছর হাজার হাজার বিসিএস ক্যাডার ও কেতাদস্তুর সাহেব তৈরী না করে, কারিগরি শিক্ষা ও অন্যান্য পেশার দিকে দৃষ্টি দেয়া। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, যা একজন শিক্ষার্থীকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রতিযোগিতার আরেকজন প্রতিযোগী না বানিয়ে সকল পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখাবে সেই সঙ্গে সৎ পথে যেকোনো পেশাকেই সন্মানজন হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখাবে।

মিতা চৌধুরী
চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, সংগঠক
প্রশান্তিকা প্রধান, মেলবোর্ন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments