গানের ভেলায় সুরের মেলায় । ফারিনা মাহমুদ

  
    
দীর্ঘ ৮ বছর সিডনী থেকে ২০১৮ সালে মেলবোর্ন শহরে আসি আমি। এ শহরটা, এ শহরের মানুষদের চিনে বুঝে উঠতে উঠতেই এলো করোণাকাল । যাহোক, সব কাটিয়ে আবার যখন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে সবদিকে, তখনি হাওয়া আর পরাণের মতো ছবি চলে আসলো প্রেক্ষাগৃহে। না দেখে কি পারি ? ফেললাম টিকেট কিনে । পরানের শো ৩ রা সেপ্টেম্বর । এক্কেবারে দল ধরে ১০ টা টিকেট কাটা হলো । কি মজা! সপ্তাহখানেক পরেই শুনি, সুরলোকের অনুষ্ঠান ৩ তারিখে । অর্থাৎ ৩রা  সেপ্টেম্বর ২০২২ মেলবোর্ন এর Keysborough. 
 
এ সুরলোক আয়োজন করছে “গানের ভেলায় সুরের মেলায়” শীর্ষক এক সঙ্গীতানুষ্ঠান। আমি পড়লাম ঝামেলায় , কি করি ? শেষমেশ পরিচালকের বানানো পরাণ সিনেমার বদলে আমার পরাণ যাহা চায় তাই বেছে নিলাম । সুরলোকের গান শুনতেই যাবো । 
 
শুনেছিলাম শুদ্ধ সংগীতের চর্চা ও পরিবেশনার জন্য সুরলোকের সুখ্যাতি আছে।  প্রমাণটা এবার হাতে নাতেই পেয়েছি । চমৎকার এই নিবেদনের শুরুতেই সুরলোক যে বার্তা দেয় শ্রোতাদের তা হলো
“অতিমারীর চোখরাঙানির ফলে দীর্ঘদিন আমরা  অবরুদ্ধ ছিলাম, মেলবোর্নে ছিল দীর্ঘ লকডাউন। সেই রুদ্ধ অবস্থা থেকে আমরা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি । আজকে আপনাদের সাথে একত্রিত হয়েছি এই মঞ্চে । এই মুক্তির-আনন্দ আমরা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই গানে গানে । সুর এবং সংগীত আমাদের হৃদয়ের কথা বলে আবার সুর ও সংগীত দিয়ে অপরকেও ছোঁয়া যায়, ভালোবাসা যায় । আজকে আমাদের গানের শিল্পীরা যে গানগুলো পরিবেশন করবে, বেশিরভাগই  আপনাদের পরিচিত এবং এই গানগুলো ঘুরে-ফিরে আমাদের স্বপ্ন, মুক্তি, প্রেম-ভালোবাসা, আনন্দ ও প্রত্যাশার কথা বলে । এই কালজয়ী গানগুলো দশকের পর দশক ধরে আমরা শুনছি, আমাদের মনকে যেন ফুলের গন্ধের মতই সুরভিত করে রেখেছে। আর কথা নয়, আসুন আমরা কথা ও সুরের মূর্ছনায় নিমগ্ন হই ।”

আমি ও আমরা নিমগ্ন হয়ে গেলাম গানে ও সুরে ।অনুষ্ঠানটি শুরু হয় সমবেত পরিবেশনা দিয়ে । বহে নিরন্তর এবং আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এর সুর  ও বাণীতে শ্রোতারা ততক্ষনে খুঁজে পেতে শুরু করেছেন নিরন্তর বয়ে চলা এ জীবনে মুক্তির আনন্দ।যে মুক্তির আনন্দ আবার ভালোবাসার স্বাদ জাগায়। ঠিক ধরেছেন, আদিলা নূর এর কণ্ঠে আবার ভালবাসার স্বাদ জাগে যেন সেই ইচ্ছের কথাই বলছিলো । ভালোবাসতে চাই রং, চাই রাঙানোর স্পৃহা । মনি কণ্ঠে ঝংকার তুললেন, মনেরো  রংয়ে রাঙাবো। রাত যদিও নামেনি তখনো কিন্তু সেই গোধূলিবেলায় শ্রোতাদের মাধবীরাতে নিয়ে গেলেন নিঝুম, ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা গানের মধ্য দিয়ে। তখনো রাত নামেনি বলেই কি দর্শকরা নারাজী আবেদন করলেন ? পার্থর কণ্ঠে বেহাগ যদি না হয় রাজি শুনে তো আমার তাই মনে হচ্ছিলো ! বেহাগ রাজি না হলেও বাঁশি কিন্তু বেজে উঠছিলো ক্ষনে ক্ষনে । আর তখনি দীপ্তি গেয়ে উঠলেন কে বাঁশি বজায় রে । এরপর আমাদের যাপিত জীবনের আনন্দ বেদনার গল্প কণ্ঠে ধরলেন সুব্রত তবে সুকৌশলে। বেদনা মধুর হয়ে যায় , তুমি যদি দাও গানটি উপভোগ করেছি পুরোদমে তবে অজানাই রয়ে গেলো কার দেয়া বেদনা আসলেই মধুর ! আবার শ্রোতাদের বাঁশির কথা শোনার পালা , শায়েরীর কণ্ঠে এবার আক্ষেপ – হায় পোড়া বাঁশি ঘরেতে! বাইরে ততক্ষনে আঁধার নেমেছে আর সেজন্যই বুঝি পিনাকী দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন আমি যামিনী তুমি শশী হে ।

মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতাদের এবার ১০ মিনিটের একটি বিরতি দেয়া হলো, আমরা চলে গেলাম ফয়ারে । চা তেহারি চলছে পুরোদমে, চলছে আড্ডা।
বিরতির পর প্রথম গান  দীপ্তি ও অর্পণ এর কণ্ঠে – এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়, গানটি আমাদের স্বপ্নমধুর মোহে আচ্ছন্ন করে ফেললো । সে ঘোরলাগা মনেই আমরা শুনলাম আমি তোমারি তোমারি তোমারি নাম গাই , সংগীতার সুমিষ্ঠ কণ্ঠে । ওদিকে শাহেদ আবার ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দে আছে, কি দেখছে সেটাই নাকি বুঝে উঠতে পারছে না । আচ্ছা বিপদে পড়ে তাই সুরে সুরে প্রমাদ গুনলো সে-  কি দেখি  পাইনা ভেবে গো ! জানেন তো, মেলবোর্নের আবহাওয়ার দুর্নাম আছে ভীষণ। ক্ষনে ক্ষনে মেঘ রোদ বৃষ্টি! আদিলা এবার কণ্ঠে ধরলেন এই মৌসুমী মন শুধু রং বদলায় । আচ্ছা, মন কি শুধু রংই বদলায় ? না না , তাহলে কি আর প্রাণের খেলা জমতো ? 
আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা – সোমার গান এবার সেকথাই বললো । অনুষ্ঠানটা রবিবারে হচ্ছিলো, দূর দূরান্ত থেকে এসেছিলেন সবাই । আরো যে অনেক কথা বলার বাকি, অনেক সুরের অর্পণ বাকি । আর তাইতো নিঝুম মনে করিয়ে দিলেন গানে গানে – প্রিয় যাই যাই বলো না। এক্ষুনি কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না কিন্তু ! কারণ অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে জমজমাট দ্বৈত পরিবেশনা নিয়ে আসলেন  সোমা ও পিনাকী  – তোর সাথে নামলাম রে । ওনাদের সাথে আমরাও নামলাম আরেকবার সুরের সাগরে । আর ঠিক তখনি জীবনের জয়গান ঝরলো সংগীতা ও সায়রীর কণ্ঠে  আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! এদিকে জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেবে নিকেশ নিয়ে নাকি একেবারেই ভাবছেন না অর্পণ । কারণ, ও ভাবনা নাকি বৃথা ! জীবনকে যাপন শুধু নয়. পুরোদমে উদযাপন করতেই তিনি গেয়ে উঠলেন  জীবনে কি পাবনা ভুলেছি সে ভাবনা । ঘড়ির কাঁটা পাল্লা দিয়ে ছুটছে, সমবেত কণ্ঠে এবার সুরলোকের পরিবেশনা  পৃথিবী আমারে চায় এবং আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের ।
 
একই আসরে নানা বয়সী শ্রোতা ধরে রাখা সহজ নয় । সুরলোক খুব দক্ষতার সাথে এ কাজটি করেছে । ওনাদের অনুশীলন আর চর্চার ছাপ ছিল পুরো অনুষ্ঠানে । ছিল নান্দনিক প্রদীপ ও ফুলের আয়োজন । যন্ত্রী দল ও উপস্থাপিকা কান্তার সমন্বয়ে এক অসম্ভব মুগ্ধতা ছড়ানো আয়োজন উপহার দিয়েছে সুরলোক। আমি তো বটেই, পুরো মেলবোর্ন অপেক্ষায় রইলো, পরবর্তী আয়োজনের।
ফারিনা মাহমুদ
প্রদায়ক সম্পাদক, প্রশান্তিকা । 
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। 
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments