শাহাদুজ্জামানের বই এলে আমি শুধু পড়িই না। খেয়ে ফেলতে চাই। ‘গুগলগুরু’ নামটা পছন্দ হয়নি বলে প্রায় এক বছর লাগলো বইটি ধরতে। প্রথমে একবার ধরে দেখলাম, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ নিয়েই এই বই। ভেবেছিলাম, ওনার লেখা তো পত্রিকায় পড়ে ফেলি আর রিপিট করার খুব দরকার আছে কি?
করোনার সময়ে আবার ধরলাম। শুধু দুটি লেখা আগে পড়েছি বলে মনে হলো। এখন মনে হচ্ছে, এতোদিন কেনো পড়লাম না, হায় !

জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে শাহাদুজ্জামান লিখেছেন ‘একজন কমলালেবু’ নামের বৃহৎ কলেবরের উপন্যাস। সেটার প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ‘একজন কমলালেবু: পেছনের গল্প’ নিবন্ধটি। লেখাটি পড়ে জানতে পারলাম কলকাতা এবং বাংলাদেশে যেখানে যেখানে জীবনানন্দ থাকতেন তিনি সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি লিখেন, “ সরু নির্জন গলি দিয়ে সেখানে গিয়ে সবুজ রঙের কাঠের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াই। দরজার মরচে পড়া লোহার কড়াটি স্পর্শ করি। অনেক রাতে কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাতে হেঁটে, আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রাম লাইন মাড়িয়ে জীবনানন্দ ফিরতেন এই বাড়িতে। এসে হাত রাখতেন এই কড়ায়।”
আবার কোথাও এই জীবনানন্দকে নিয়ে বলেছেন, “জীবন, জীবিকা, দাম্পত্য, স্বপ্ন, বাস্তবতার ঘুর্ণিঝড়ে ডানা ঝাপটিয়েছেন একটি আহত পাখির মতো।”
গুগলগুরুতে শাহাদুজ্জামান লিখলেন, “অনলাইনে একহাজার বন্ধু থাকলেও হয়তো অনলাইনে একটাও প্রকৃত বন্ধু নাই তার। অনলাইনে যে বিপ্লব জোয়ার আনে অফলাইনে সে মুখ থুবড়ে পড়ে।” ফেইসবুক নামক বস্তুকে তিনি তাই বলেছেন ফেসবুক ফ্যাসাদ নামে। অন্য আরেকজনের সংলাপে শাহাদুজ্জামান তাই বলছেন, “ভাগ্যিস মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেইসবুক ছিলোনা, তাহলে লাইক ক্লিক করে আর সহমত জানিয়েই দায় সারতো।” কথাটা কতোটা সত্যি আমরা এই করোনা কালেও এসে দেখছি। মানুষ অনলাইন, ফেসবুকে দরিদ্র মানুষের জন্য কতো কিছুই করছে। অথচ মাঠে তারা ঠিকই অভুক্ত থাকছে।
‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নিবন্ধে শাহাদুজ্জামান পাকিস্তান সময়ে নির্মিত ছবিটির কথাই বলেছেন। আমরা জানতে পারি, “ইতালিতে ডি সিকা বানিয়ে ফেলেছেন বাইসাইকেল থিভস ঠিক জাগো হুয়া সাভেরার তিন বছর আগে নির্মিত হয়েছে ভারতের সবচেয়ে সফল নিও রিয়েলিস্ট ছবি পথের পাঁচালী।” নিবন্ধের শুরুটা পড়ে আমার মনে হয়েছিলো শেষ করেই ইউটিউব থেকে উর্দু ভাষায় যেখানে অভিনয় করেছেন খান আতা এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান, দেখে ফেলবো। কিন্তু শেষে এসে ধাক্কা লাগলো এই জেনে, “এটি উপমহাদশের উল্লেখযোগ্য কিন্তু স্ববিরোধী একটি ছবির উদাহরণ যা নন্দনতাত্বিকভাবে অসাধারণ, সাংস্কৃতিকভাবে বেখাপ্পা।” এরপর আর ছবিটি দেখার ইচ্ছে জাগেনি। ছবিটি যেহেতু পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস নিয়ে। সেটি গৌতম ঘোষই ভালো বানিয়েছেন। যেখানে ছিলেন আমাদের রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা আর ওপারের গুণী মানুষ রবি ঘোষ।
গুগলগুরু পড়ে আমার সবচেয়ে উপকার হয়েছে শাহাদুজ্জামানের ‘কাঁদো নদী কাঁদে: একটি চিত্রনাট্যের খসড়া’ পড়ে। প্রথমত: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত এই উপন্যাসটি আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। এই চিত্রনাট্যে গল্পটা জানা গেলো। ওয়ালীউল্লাহ একসময় সিডনিতে সমুদ্র পাড় ঘেষে একটি সাবার্ব ভাউক্লসে থাকতেন। সেখানকার একটা রাস্তার নাম বাঙালা (Bangala road) দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠেছিলো, এই বুঝি পেরিয়ে যাচ্ছি আমাদের ‘লালসালুর’ কথকের বাড়ি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বড় ডিপ্লোম্যাট। ভেবেছিলাম নামটা তিনিই দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলে ফোন দিয়েও তার বিষয়ে জানতে পারিনি।
দ্বিতীয়ত: কোন গল্প কিভাবে সিনেমায় রূপ দিতে হয় সেটার আগের পর্বই চিত্রনাট্য। শাহাদু্জ্জামান একসময় ফিল্ম এক্টিভিস্ট ছিলেন। চিকিৎসক, গল্পকার, গবেষক, কবিতা এবং সিনেমা-সংস্কৃতির নানা পাঠ তাঁকে আলোড়িত করেছে। রাইটাররা সাধারণত চিত্রনাট্য প্রকাশ করেন না। এটা তাদের গোপনীয় একটি জিনিস। তাই আমরা যত্রতত্র চিত্রনাট্য দেখতে পাইনা। এখানে উপন্যাসটির পুরো চিত্রনাট্য পড়ে আমার মনে হয়েছে, ওহ এভাবে চিত্রনাট্য লেখা হয়, যেখানে চরিত্ররা একের পর এক শটে আসেন। একটু আফসোস থেকে গেলে এই চিত্রনাট্যটিকে সিনেমা বানালে চমৎকার একটা ছবি কিন্তু আমরা পেতাম।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি চিঠি প্রথম আলোতে পড়েছিলাম। বইটিতে আবারও পড়তে ভালো লাগলো। ইলিয়াস এবং শাহাদুজ্জামান দুজনেই আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক। দুজনের যোগসূত্রের কাহিনীও চমৎকার।
মানুষ কেনো লেখে। ৯টা ৫টা কাজ করে বাল বাচ্চা মানুষ করাই কি যথেষ্ঠ নয় ? লেখালেখিতে কয় টাকা আয় হয়? তবুও আমরা লিখতে চাই । শাহাদুজ্জামান বিষয়টা এভাবে বলছেন, “আমার আছে গণ্ডিকে অতিক্রম করার প্রবণতা। সেই থেকে শুরু। একটাই তো জীবন। এক জীবনে বহু জীবন যাপনের একটা প্রধান উপায় এই ‘লেখা’। আমি মূলত লেখার মধ্য দিয়েই এক জীবনে বহু জীবন যাপন করি।”
শাহাদুজ্জামান বাস করছেন ব্রিটেনে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করছেন। লন্ডনের একটি সেমিনারে তাঁর একটি বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয় ‘স্মৃতি এবং প্রবাসীদের আত্মপরিচয়’ নিবন্ধে। তাঁর বাবার কথা বলতে যেয়ে বলেন, “সরিষাবাড়ির কাছেই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে ফেরীতে উঠবার সময় একবার এবং নামবার সময় আরেকবার বাবার পকেটমার হয়েছিলো।” আমার মনে পড়ে একবার জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে আমাদের চরের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম। আমার দাদারা পাটের ব্যবসা করতেন। এই ঘাটের অনেক গল্প দাদার মুখে শুনেছি। তাই বারবার আমরা ফিরে যেতে চাই সেই সব স্মৃতিকাতর দেশে। শাহাদুজ্জামান বলছেন, “আমি এমন বাংলাদেশীকে চিনি যিনি বৃটেনে আসবার পরের সপ্তাহেই আবার বাংলাদেশে ফিরে যাবার জন্য স্যুটকেস গুছিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু স্যুটকেস ত্রিশ বছর ধরেই গোছানো আছে।….. এই যে ফিরে যাবার মিথ, এটা অভিবাসী অস্তিত্বের একটা অংশ।” আমার ত্রিশ বছর না হলেও ২১ বছরের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। আমার বাবার চিকিৎসার সময় কলকাতা গিয়েছিলাম। সেই সময় মারা গেলেন দেশ পত্রিকার দিকপাল সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। তাঁর স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তাঁর খুব কাছের এক সাহিত্যিক মঞ্চে এসে বললেন, সাগরময় তাঁর সারাজীবন তাঁর জন্মস্থান চাঁদপুরে আসতে চেয়েছিলেন। চাঁদপুরের কথা বলতে গিয়ে তিনি যেনো শিশু হয়ে যেতেন।
শাহাদু্জ্জামানের স্ত্রী পাপড়ীন নাহারও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক। স্বামী সম্পর্কে ‘নিকট জনের চোখে’ নামে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও যুক্ত হয়েছে এই বইটিতে। সেখানে তিনি অকপটে বলেছেন, “শুধু মাত্র কোন এক পাপড়ীন নাহারের জন্য তো শাহাদুজ্জামানের জন্ম হয়নি। …..তাঁর সব পাঠক পাঠিকাকে বঞ্চিত করার অধিকার তো আমার নেই।” আবার এটাও বললেন, “ শাহাদুজ্জামান খুব কম্পার্টমেন্টাল জীবন যাপন করে। তার জীবনে অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট আছে।এক জীবনে সে অনেক জীবন যাপন করতে চায়। সংসার তার জীবনের অনেক কম্পার্টমেন্টের একটি।”
তাঁর জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে পারি তাঁর স্ত্রীর কথায়।”সে প্রতিরাতে লিখতে বসে। রাত জাগে। যখন কোন নতুন লেখার ভেতর থাকে তখন একটা ঘোরের ভেতর থাকে। সংসারের ভেতর ঘুরে বেড়ালেও ঠিক সংসারে থাকেনা।”
আমরা ভাগ্যবান। সেই ঘোর লাগা মানুষের রস আস্বাদন করে বেঁচে থাকি, জীবন চালাই, সামনে আগাই। ঘোর লাগা মানুষের ভালো মন্দ দুটিই থাকতে পারে। আমার চোখে তাঁর মন্দ বিষয়ের ছিটেফোটাও ধরা পড়েনা।
করোনা কালে পড়া এই গ্রন্থটি আমার অনেক দিগন্ত উন্মোচিত করে। আপনারাও পড়ুন। বইটিতে মোট নিবন্ধের সংখ্যা ষোল। প্রতিটার কথা বলতে গেলে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে। তাই আর বাড়ালাম না।
গুগলগুরু। প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স। মূল্য: দুইশত টাকা।